Tuesday, March 4

দীর্ঘ ৫০ বছর যাবত নারায়ণগঞ্জে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে সূধীজন পাঠাগার

নারায়ণগঞ্জ: বই যদি হয় লিখিত ভাষার ভান্ডার, তাহলে নিঃসন্দেহে পাঠাগারকে বলা যায় বইয়ের ভান্ডার। যেখানে মানুষ পৃথিবীর বিচিত্র সব রক্ষিত ভান্ডারের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পায়। নিত্য নতুন উপলব্দি আর অভিজ্ঞতায় নিজেকে বিকশিত করা যায় পাঠাগারের মাধ্যমেই। জ্ঞান ভান্ডার আর অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হচ্ছে সাহিত্য। আর সাহিত্যের ভান্ডারের সঙ্গে পরিচিত করতেই এ পাঠাগারটি গঠনের উদ্যোগ নেয় শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জের একঝাঁক বই পাগল সুশিক্ষিত চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ি এবং কিছু তরুণ। তাদের গড়া সেই পাঠাগার কৈশর, যৌবন পেরিয়ে এখন পরিপূর্ণ এবং পরিণীত। ‘সুধীজন’ নামে এই পাঠাগারটিই গত ৫০ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের পাঠক প্রিয় মানুষদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। আগামী শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) পাঠাগারটির ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজন করা হয়েছে।
যেভাবে শুরু:
১৯৬৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের বই পাগল চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ি এবং তরুণ ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় ‘সুধীজন পাঠাগার’। প্রতিষ্ঠার সময় এর সদস্য সংখ্যা ছিল ২৫ জন। শুরুর দিকে পাঠাগারটির নাম দেওয়া হয়েছিল‘ আমলাপাড়া পাঠাগার’। কিন্তু এটি একটি এলাকার নাম হওয়ায় পাঠাগারটিকে একটি মহল্লার গন্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে সার্বজনীন করার লক্ষে পরবর্তীতে নামকরণ হয় ‘সুধীজন পাঠাগার’।
পাঠাগারটির স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন, তৎকালীন বাংলা একাডেমীর সহকারি প্রকাশনা অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ফজলে রাব্বি। যিনি পরবর্তীতে বাংলা একাডেমীর পরিচালকও হন। নারায়ণগঞ্জ থেকে কর্মসূত্রে ঢাকায় ট্রেনে যাতায়াতের সময় সমমনা কয়েকজন মিলে ১৯৬২ সাল থেকেই পাঠাগার গড়ার স্বপ্ন দেখেন ফজলে রাব্বি ও তার ট্রেনের সহযাত্রী কয়েকজন। তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় ৬৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। শহরের আমলাপাড়া এলাকার ১৬ হরকান্ত ব্যনার্জী রোডের রহমত উল্লাহ হাজীর মালিকানাধীন রজনী নিবাসের একটি ছোট্ট ঘর মাসিক ৫০ টাকায় ভাড়া নিয়ে শুরু হয় ‘সুধীজন পাঠাগারের’ পথচলা। ওই সময় পাঠাগারটির সম্বল বলতে ছিল, ১০টি বই, একটি আলমারি, ১টি টেবিল, ১০টি চেয়ার এবং ২টি হারিকেন। অথচ এখন পাঠাগারটিতে বিভিন্ন ধরণের বইয়ের সংখ্যা ২৫ হাজার ৯৪০টি।
পাঠাগারটির স্বপ্নদ্রষ্টা ফজলে রাব্বি হলেও প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক হন, সরকারি তোলারাম কলেজের ওই সময়কার ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ নুরুল হক। আর ফজলে রাব্বি হন প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মাধ্যক্ষ। তবে প্রতিষ্ঠাকালীন ২৫ জনের মধ্যে মাত্র ৮জন জীবিত রয়েছে। বাকিরা হয়েছেন কালের সাক্ষী। জীবিতদের মধ্যে অনেকে আবার প্রবাসে রয়েছেন।
এদিকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরুতে হয়েছে পাঠাগার প্রতিষ্ঠাকারীদের। শুরুর দিকে মাসিক ৫০ টাকা ঘর ভাড়া দিতেও এর প্রতিষ্ঠাতাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। মধ্যখানে ১৯৬৯ সালে শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের কো-অপারেটিভ ভবনে একবার স্থানান্তরিত করা হয় পাঠাগারটিকে। তবে ওই সময়ের তরুণ শিল্পপতি হোসেন জামাল পাঠাগারটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার পর তিনি পাঠাগারের একটি স্থায়ী ঠিকানা করার উদ্যোগ নেন। দেশ স্বাধীনের পর তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর সে সময়ের নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান আলী আহাম্মদ চুনকা এগিয়ে আসেন পাঠাগারটির একটি স্থায়ী রূপ দেবার জন্য। চেয়ারম্যান আলী আহাম্মদ চুনকা পৌরসভা থেকে ৬ কাঠা ৬ ছটাক জমি ৯৯ বছরের জন্য লীজ দেয়। পৌরসভার লীজকৃত জমির উপর ‘সুধীজন পাঠাগার’ ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এর কার্যনির্বাহী কমিটি। ৭৭ সালের ৮ জুলাই ঢাকা জেলার প্রশাসক এএমএম শওকত আলী এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একই সঙ্গে তিনি পাঠাগার ভবন নির্মাণের জন্য ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার একটি অনুদানও প্রদান করেন। ৭৮ সালের ২২ জুলাই ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার এম খানে আলম খান সুধীজন পাঠাগারের নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন। ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৮০৫ টাকা ব্যয়ে নিমর্তি ভবনটির জন্য ওই সময় ঢাকা জেলার প্রশাসক ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ শহর উন্নয়ন কমিটি ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করে। আর পাঠাগারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হয় ১ লাখ ৮০৫ টাকা। ওই সময়ই পাঠাগারটিকে তার নিজস্ব একতলা ভবনে স্থানান্তর করা হয়। ভবনটি এখন তিন তলা।
এর আগে ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে দেশের জ্ঞানী গুনী, শিল্পী আর সাহিত্যিকদের নিয়ে সুধীজন পাঠাগার নারায়ণগঞ্জে আয়োজন করে সপ্তাহব্যাপি গ্রন্থমেলা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে সেটিই ছিল সবচে বড় অনুষ্ঠান, যা আজও শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।
বিভিন্ন ধরণের বইয়ের বিশাল ভান্ডার:
মাত্র ১০টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সুধীজন পাঠাগারে বর্তমানে বই রয়েছে প্রায় ২৬ হাজার (২৫ হাজার ৯৪০টি)। এমন কোন বই নেই যা এই পাঠাগারে নেই। গল্প, কবিতা, সাহিত্য, ভ্রমন কাহিনী, জীবনী, ধর্মীয়, সাইন্স ফিকশন, কিশোর থ্রিলার, খেলাধূলা, চলচিত্র, সাধারণ জ্ঞান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণে পাঠপুস্তকও রয়েছে এখানে। প্রতিবছর একুশের বই মেলা থেকে পাঠাগারের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বই সংগ্রহ করা হয়। আর বছর জুড়ে বই সংগ্রহতো করা হয়ই। পাঠাগারে রক্ষিত বইয়ের মধ্যে সব ধরণের মোট বাংলা বই রয়েছে ১৯ হাজার ৭৪৭টি এবং মোট ইংরেজি বই রয়েছে ৬ হাজার ১৯৩টি।
এছাড়া কোন সদস্য বা শিক্ষার্থী যদি প্রয়োজনীয় কোন বই চায় আর সেটি যদি পাঠাগারে না থাকে তাহলে ওই বইটি সংগ্রহ করে ওই সদস্যকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এ ধরণে নিয়ম আর কোন পাঠাগারে নেই। অর্থ্যাৎ পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী এই পাঠাগার কর্তৃপক্ষ বই সরবরাহ করে থাকে। জানালে পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং সাবেক পরিচালক আখতারুজ্জামান। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের ম্যাগাজিন এবং দৈনিক পত্রিকা রাখা হয় নিয়মিত।
পাঠাগারের নিজস্ব প্রকাশনা:
সুধীজন পাঠাগারের রয়েছে নিজস্ব কিছু প্রকাশনা। যেগুলোতে উঠে এসেছে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্য। প্রকাশনা গুলোর মধ্যে রয়েছে, নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস, বাংলা সংস্কৃতির শতবর্ষ এবং অধ্যক্ষ খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্মারকগ্রন্থ। এসব বইয়ে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
সদস্য সংখ্যা:
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে মাত্র ২৫ জনকে নিয়ে পাঠাগারটি যাত্রা শুরু হলেও এর সদস্য সংখ্যা কিন্তু ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ৫০ বছরে এর সদস্য সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১১৫ জনে। এরমধ্যে ছাত্র সদস্য ৫ হাজার ২৪৫ জন এবং সাধারণ সদস্য ১ হাজার ৮৭০ জন। পাঠাগারটির সদস্য হতে শিক্ষার্থীদের বাৎসরিক ১২০ টাকা এবং সাধারণকে ১৮০ টাকা চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া প্রতিদিন সদস্যদের বাইরেও উল্লেখ যোগ্য সংখ্যক পাঠক পাঠাগারে বসে পত্রিকা এবং বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগ পান।
মেধাবীদের জন্য ৭টিসহ মোট ৮টি বৃত্তি প্রকল্প:
শহরের মেধাবী অথচ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করতে এবং পাঠাগার প্রতিষ্ঠাসহ শিক্ষা-সাহিত্য ও সমাজ সেবায় অবদান রাখার জন্য ‘সুধীজন পাঠাগারে’ মোট ৮টি বৃত্তি চালু রয়েছে। বৃত্তিগুলোর মধ্যে ৬টি প্রয়াত বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে এবং ২টি বৃত্তি চালু রয়েছে পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক নুরুল হক ও তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের নামে। বৃত্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে-হোসেন জামাল স্মৃতি বৃত্তি, অধ্যাপক নুরুল হক বৃত্তি, হেদুন বেপারী স্মৃতি বৃত্তি, হাজী মোঃ ইলিয়াছ স্মৃতি বৃত্তি, হাজী রহমতউল্লাহ ও সাহারা খাতুন স্মৃতি বৃত্তি, আলী আহাম্মদ চুনকা স্মৃতি বৃত্তি, এএ আবদুল আলী ও সৈয়দা সুলতানা বানু স্মৃতি বৃত্তি এবং আনোয়ারা বেগম বৃত্তি।
বৃত্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র হোসেন জামাল স্মৃতি বৃত্তি প্রদান করা হয়, শিক্ষা-সাহিত্য, সমাজ সেবা এবং গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য। আর বাকী বৃত্তি গুলো শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরিদ্র অথচ মেধাবীদের মধ্যে প্রদান করা হয়।
সুর্বণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠান:
আগামী শুক্রবার পাঠাগারটির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুর্বণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দিনব্যাপি ওই অনুষ্ঠানে পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখায় ১৪তম হোসেন জামাল পুরষ্কার তুলে দেওয়া হবে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আমিরুল আলম খানের হাতে। অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভী, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. হায়াৎ মামুদ, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক কবি অসীম সাহা, বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ড. করুণাময় গোস্বামী অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়