Thursday, March 20

বন্যহাতির ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটে পাহাড়িদের

রাঙামাটি (লংগদু) থেকে ফিরে: রাঙামাটি পার্বত্য জেলার লংগদু, বরকল, কাওখালী উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি জনবসতি এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। বন্যহাতির আক্রমণে প্রতিদিন লক্ষাধিক পাহাড়ির দিন কাটছে শঙ্কায়, রাত কাটছে নির্ঘুম।

বন্যহাতির আক্রমণ প্রতিরোধে সরকারিভাবে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে ৩৮৮ দশমিক ৪৯ বর্গকিলোমিটার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। এর মধ্যে সোনাই, বাইট্যাপাড়া, মুসলিম ব্লক, গুলশাখালী, ভাসাইন্যাদাম, রাজনগর, বগাচত্বরসহ প্রায় ১০টি পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দা বন্যহাতির উপদ্রবে সব সময় তটস্থ থাকেন।

সাড়ে ৩ ঘণ্টা থেকে ৪ ঘণ্টার নৌ-পথে লংগদু, বরকল ও কাওখালী উপজেলাবাসীদের জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। বিশেষ করে উপজেলা সদরের সঙ্গে প্রত্যন্ত দুর্গম পাহাড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। নৌপথ ছাড়া পাহাড় ঘেঁষা পায়ে হাঁটার একমাত্র সরুপথই ভরসা। ফলে জরুরি প্রয়োজনে জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ খুবই কষ্টকর। এতে বন্যহাতির আক্রমণ মোকাবেলা করতে সরকারি কোনো হস্তক্ষেপ কাজে আসছে না। সরেজমিনে ও এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।

লংগদু উপজেলার গুলশাখালী এলাকার বাসিন্দা মো. সুলতান বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে বন্যহাতির আক্রমণ বেড়েছে। বন্যহাতির বিচরণ এলাকায় প্রয়োজনীয় খাবার নেই। ক্ষুধার্ত হলেই লোকালয়ে চলে আছে হাতির দল। আর তখনই কেউ না কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

ভাসাইন্যাদাম গ্রামে বাসিন্দা মোহাম্মদ মিয়া বলেন, ‘আমাদের জীবন জীবিকার জন্য পাহাড়ে কলা, হলুদ, আদা এবং পাদদেশের ফাঁকে ফাঁকে ধান চাষ করি। এসব ফসল খাওয়ার জন্য হাতির দল লোকালয়ে চলে আসে। স্থানীয়রা এসময় প্রতিরোধ করতে গেলেই হাতির দল তাদের ওপর চড়াও হয়। এমনকি বাড়ি ঘরেও হামলা করে।’

বন্যহাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া পূর্ব চাইতলি পাহাড়ের বাসিন্দা জয়নাল শেখ বলেন, ‘বন্যহাতির দল এতটাই ক্ষুধার্ত থাকে তাদের চলার পথে বাধা এলেই আক্রমণ করে। কোনো অবস্থায়ই আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। হাতির আক্রমণের হাত থেকে অনেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। আর এ কারণে সংসারের বাড়তি বোঝা হয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের দেয়া এক তথ্যে পাওয়া গেছে, গত এক বছরে বন্যহাতির আক্রমণে লংগদু উপজেলার রাজানগর গ্রামের বাসিন্দা রহিম ভূইয়া, পূর্ব চাইতলি গ্রামের মো. হাফিজুর রহমান, রহমতপুর গ্রামের সোরশোদ আলম, সমেদ আলী ও মাহাজন পাড়া গ্রামের আব্দুল জলিলসহ ১০ জন নিহত ও ৫১ জন আহত হয়। এছাড়া ৬০ ঘর ভাঙচুরসহ ২১ একর জমির ফসল নষ্ট করেছে হাতির দল। নিহত ৫ ও আহত ২ ব্যক্তির পরিবারকে সরকারিভাবে ১ লাখ করে মোট ৭ লাখ টাকার অনুদান দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এসএম কায়চার বাংলামেইলকে বলেন, ‘৩০ থেকে ৩৫টি বন্য হাতির দল আছে। প্রতিটি দলে ৮ থেকে ১০টি করে হাতি রয়েছে। এই হাতির দলগুলো অবস্থান নেয়া এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার না থাকায় লোকালয়ে চলে আসে। আর তখনই আক্রমণের শিকার হন স্থানীয়রা।’

তিনি আরো বলেন, ‘এসব এলাকার কৃষকরা বন্যহাতির চলাচলের পথে বাড়ি ঘর তৈরি করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে আক্রমণ চালায় বন্যহাতির দল।’

দুর্গম পাহাড়ি জনপদে যে সব বাসিন্দারা অবস্থান করছে তারা কি স্থানীয় আদিবাসী- এমন প্রশ্নের উত্তরে বন কর্মকর্তা বলেন, ‘এরা কেউ আদিবাসী নয়। বিভিন্ন এলাকার নদী ভাঙন কবলিত মানুষ। এদের মধ্যে কিছু রোহিঙ্গাও আছে। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সাধ্য অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘গত ১৪ ফেব্রুয়ারি লংগদু উপজেলার গুলশাখালী ও ভাসাইন্যাদাম এলাকায় বন্যহাতির আক্রমণে নিহত ৫ ও আহত ২ ব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭ লাখ টাকার অনুদান দিয়েছি।’

বন্যহাতির আক্রমণ মোকাবেলার জন্য সরকারি পদক্ষেপ নেয়ার কোনো ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু হাতির চলাচলের পথে কেউ বাড়ি করলে আক্রমণ করবেই।’

হাতি চলাচলের পথে তৈরি করা বাড়িঘর উচ্ছেদ করছেন না কেন এমন প্রশ্নে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমরা যদি উচ্ছেদ করি, তখন বলা হবে আদিবাসীদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। এসব কারণে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছি না।’

বাংলামেইল২৪ডটকম/

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়