মাসুম সায়ীদ
রাত সাড়ে দশটা। ঢাকায় কোনো রাতই না। কিন্তু সাতছড়ি জঙ্গলে এ যেন মধ্যরাত। সন্তর্পণে ডাকবাংলো ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। মাথার ওপর দুদিনের ক্ষয়া চাঁদ। দুই ঘড়ি ঘুমিয়ে এখন সে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মিটিমিটি হাসছে। চারদিক নীরব নিস্তব্ধ। নভেম্বরের তীব্র শীতে ঝিলি্ল মেয়েরাও মুখ লুকিয়েছে। নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা গায়ে মেখে আমরা এসে দাঁড়ালাম তিন ঘণ্টার হাঁটা পথের মুখে। এই পথটা ধরেই আজ সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত আমরা হেঁটেছি। সাতটি ছড়ি বা ছড়া (পাহাড়ি জলের ধারা) আছে বলে এ বনের নাম 'সাতছড়ি'। এখানে হাঁটার ট্রেইল মাত্র তিনটি। তিন ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা আর আধা ঘণ্টার। আঁকাবাঁকা এই পথগুলো আসলে কোনো পথই নয়। ঘন অরণ্যের বুক চিরে চলে যাওয়া নিচু একটি রেখা মাত্র। মাথার সিঁথির মতো। খুবই দুর্গম।পায়ে পায়ে আমরা বনের সাতটি ছড়ার একটিতে নেমে এলাম। এটাই সবচেয়ে বড় আর প্রশস্ত। শুকনো বালুতে ভরা তলা। পা দেবে যায় বলে ছড়া ধরে স্বচ্ছন্দে চলা যায় না। আবার বৃষ্টি-বাদলার সময় যখন পাহাড়ি ঢল নামে এরাই হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী। চাঁদের আলোয় জমাট অরণ্যে ছড়াটিকে মনে হচ্ছিল পল্লীবালার কোমরে বাঁধা রুপোর বিছে। অদ্ভুত মায়াবী এক পরিবেশ। গভীর রাতে গহিন অরণ্যে এ যেন গোপন অভিসার। বুকটা ঢিপ ঢিপ করছিল কেন কে জানে?
সকাল বেলায় যখন হাঁটছিলাম তখন ট্রেইলের মুখে বাঁশঝাড়ে চোখে পড়ছিল বানর। তারপর বনের ভেতরের দিকে লম্বা লেজওয়ালা হনুমানের দল। এখানকার আকাশছোঁয়া চাপালিশ গাছ চোখে পড়ার মতো। ডুমুরগাছের রকমফেরে এ বনের জুড়ি নেই। দেশের সবচেয়ে বড় ডুমুরগাছটিও চোখে পড়ে এই ট্রেইলে। এক সময় চোখে পড়ল এক জোড়া ভিমরাজ। ক্যামেরায় দুবার ক্লিক করতে না করতেই দে ছুট। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক ফসিল। এটা এ বনের একটা বিশেষ দিক। বছরের বেশির ভাগ সময় শুকনো থাকে বলে আর মাটিতে একটি বিশেষ উপাদান বেশি থাকায় মরা গাছ দ্রুত ফসিলে পরিণত হয় এখানে।
একপর্যায়ে স্রেফ কৌতূহলবশত আমরা মূল ট্রেইল ছেড়ে নেমে যাই অফ ট্রেইলে। চলতে থাকি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। দুপুর ১টার মধ্যে ফিরে আসার কথা থাকলেও আমাদের বেজে গেল ৩টা। আগের রাত ছিল নির্ঘুম। তাই বিকেলটা কাটল বাংলোর বিছানায়।
সন্ধ্যার মুখে নেমে এলো রাত। ঠিক আল মাহমুদের কবিতার মতো- এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন। মহুয়া তলায় বাঁশের মাচায় লাল চায়ের সঙ্গে জমে উঠল আড্ডা। চা শেষ হতে না হতেই দীপু ভাই আঙুল নৃত্য শুরু করল গিটারের তারে। টুংটাং শব্দের সঙ্গে দীপু ভাইয়ের ভরাট গলায় যেন মহুয়ার নেশা ঝরছে। পুরো জমে গেলাম আমরা।
মায়াবন বিহারিণী হরিণী, নির্ভানার দ্য ম্যান হু সোল্ড দ্য ওয়ার্ল্ড, বাদ গেল না নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর বনলতা সেন। রাত সাড়ে ৯টায় আসর ভাঙতে হলো রাতের খাবারের পর চাঁদের আলোয় বনে ঢুকব বলে।
ঘাস আর গাছের পাতায় মুক্তার ঝিলিক নিয়ে সকাল এলো। কুয়াশা থাকতে থাকতেই বড় একটা শালিকের ঝাঁক নেমে এসেছে বাংলোর সবুজ চত্বরে। ক্যামেরা হাতে বাইরে বেরিয়ে আসতেই উড়ে গেল সব। আহ্! খয়েরি ডানার নিচে সাদা পালকের সে কী দ্যুতি! কাকে দেখানোর জন্য?
বাংলোর পেছন দিয়ে বয়ে গেছে বড় ছড়াটি। ওপারে একটি পাহাড়ে ত্রিপুরা জাতির বসতি। পাহাড়ের ধাপে ধাপে এক একটি বাড়ি। মাটির দেয়ালের ঝকঝকে তকতকে ঘর। বেড়ানোর জন্য সকালটাই ভালো, তবে অনুমতি নিয়ে।
দুই ঘণ্টার ট্রেইলটি ফরেস্ট অফিসের পূর্বদিকে পামবাগান, আলবেজিয়া, মালাকানা, কদম, কাঞ্চি কলম বাঁশ-বাগান আর জলপাই বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে ছনখোলা পর্যন্ত। ছনখোলার কাছে বিশাল এক জলপাই গাছ। কত দিনের পুরনো কে জানে? দ্বিতীয় দিনে আমরা সেই পথেই হাঁটছি।
বুনো পথ মিশে গেল শুকনো একটি ছড়ায়। ছড়ার বুকে বুনো পশুর পায়ের চিহ্ন। বেশির ভাগই শূকরের। হঠাৎ আমাদের খুব কাছ থেকে উড়ে গেল একটা বনমোরগ। গেল তো গেলই। তারপর আশপাশটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর তার টিকিটির দেখা মিলল না।
অনেকক্ষণ থেকে বেশ তীক্ষ্ন একটা ডাক শুনে আসছিলাম। ছনখোলায় এসে তার দেখা মিলল। একটা ঈগল। নীল আকাশে চক্কর কাটছে আর ডেকে যাচ্ছে। ট্রেইলটা পশ্চিমে বাঁক নিয়ে ফিরে গেছে ডাকবাংলোতে। আমরা সেদিকে না গিয়ে এবারও ট্রেইল ছেড়ে চললাম উল্টো দিকে। সবুজে মোড়া সারি সারি টিলা আর পাহাড়। উপত্যকা ভরে আছে লম্বা লম্বা ছনে। এখন ছন কাটার সময়। লোকেরা ছন কাটছে। তারই বুক চিরে আঁকাবাঁকা পায়ে চলার পথ। আমরা চলছি যে যার মতো। আনমনে। মাথার ওপর দুপুরের রোদ। মনেই হচ্ছে না এটা শীতকাল। দেখতে দেখতে সংরক্ষিত বনভূমির উত্তর-পূর্ব সীমানায় চলে এলাম আমরা। এখান থেকে শুরু হয়েছে চা-বাগান। বাগানটি বেশ পুরনো। একটা ত্রিমোহনায় এসে গাইড রাসেল দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু যেন দ্বিধা ওর মধ্যে। আসলে ও নিজেও কখনো আসেনি এদিকটায়। হাটুরে কয়েকজন গ্রামবাসীর কাছে জানা গেল পথের খবর। সোজা পথটি ধরে আমরা দক্ষিণ দিক থেকে এসেছি। পশ্চিম দিকের রাস্তাটা চলে গেছে উত্তর-পশ্চিমে দেউরগাছ, পাইকপাড়ার দিকে। এ পথে ফরেস্ট অফিসে যেতে হলে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আর পূর্ব দিকের পথটি বাগান পেরিয়ে কুলি-কামিনদের বস্তির মধ্য দিয়ে চলে গেছে চুনারুঘাটের দিকে। বস্তি পার হলেই বড় রাস্তা। সেখান থেকে গাড়ি, রিকশা বা টেম্পোতে করে সহজেই ফেরা যাবে বাংলোতে। সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁটার ইচ্ছে আমাদের কারো নেই।
সেই মহুয়া তলায় আজও বিকেলে বসেছি আমরা। কিন্তু কালকের মতো আড্ডা জমল না। বিষাদের ছায়া যেন আঁচল পেতেছে। রাত ১২টায় আমাদের গাড়ি। সন্ধ্যার পরপরই আমরা ত্রিপুরাপল্লীতে গেলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক ছিলাম ওদের সঙ্গে। প্রথম প্রথম ওরা কিছুটা দ্বিধান্বিত থাকলেও সহজ হতে সময় লাগল না। দুটো মেয়ে ওদের ভাষায় গান গেয়ে শোনাল। ভারি মিষ্টি ওদের গলা। কথাগুলোও ভারি সুন্দর- 'এই পাহাড় সুন্দর/সূর্য সুন্দর/ চাঁদ-তারা সুন্দর/ সুন্দর এখানে জীবন।'
ফিরে দেখি রেঞ্জার মনির আহমদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রথম দিনই দেখেছি তাঁর হাতে ক্ষতচিহ্ন। ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল মোটরসাইকেলে। বন আর প্রকৃতিপাগল মানুষটা বারবার দুঃখ করলেন আমাদের যথেষ্ট সময় দিতে না পারার জন্য।
রাত সাড়ে ১০টায় আমরা ম্যাক্সিতে উঠলাম শায়েস্তাগঞ্জের উদ্দেশে। ফরেস্ট অফিস ছাড়িয়ে রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে। বাঁকের মুখে এসে শেষবারের মতো তাকালাম পেছন ফিরে। দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে। সঙ্গে বাইরের আলোও। এরই মধ্যে আবছা আঁধার আর কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে শূন্য বাংলো আর তার চারপাশের প্রকৃতি। শুধু চেকপোস্টের দেয়ালে ঝুলন্ত হারিকেনটা তখনো জেগে আছে প্রেমিক চিলের লালচক্ষু নিয়ে।
ছবি : লেখক
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে শায়েস্তাগঞ্জ। ভাড়া জনপ্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। শায়েস্তাগঞ্জ নতুনবাজার চৌমুহনী (ঢাকা-সিলেট রোডে) থেকে ম্যাক্সি বা সিএনজি রিজার্ভ করে সাতছড়ি বন। ভাড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, তবে দরদাম করে নিতে হবে। থাকার জন্য বন বিভাগের বাংলো ও নিসর্গের একটি ডরমেটরি আছে। এখানে থাকতে হলে আগে থেকেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গলে থাকা যাবে। ১২-১৪ জনের একটি দলের তিন রাত দুদিনের জন্য জনপ্রতি খরচ পড়বে ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকার মতো।
খবর বিভাগঃ
দর্শনীয় স্থান
সর্বশেষ সংবাদ
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়