কক্সবাজার: চিকিৎসার জন্য শেষ আশ্রয় জমি টুকু বিক্রি করতে না পেরে মৃত্যুর পদযাত্রী আবদু শুক্কুর। রামুগোয়ালিয়া পালং এলাকার বাসিন্দা তিনি। মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রির টাকা নিয়েছে ঝিলংজার দরিদ্র আবদুল খালেক। কিন্তু জমি রেজিষ্ট্রি দিতে না পেরে কন্যার বিয়ে দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এ ধরনের আরো বহুবিদ সমস্যা আর আপদকালীন সময় শেষ সম্বল টুকুও বিক্রি করতে না পেরে এখন চরম হতাশা গ্রস্ত হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। শুধু কক্সবাজার জেলার ৩৩ টি মৌজায় জমি বেচা কেনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারীর মাধ্যমে। সরকার কক্সবাজারকে নিয়ে মহাপরিকল্পনার কথা বলে এক দেশে দুই আইন করা নিয়েও বির্তক উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। কক্সবাজারকে নিয়ে সরকারের বৈষম্য মুলক আচরণ নিয়েও কোন নেতা কিংবা জনপ্রতিনিধি জনগণের পক্ষে কথা না বলায় এসব নেতাদের বয়কট করার ঘোষণাও এসেছে অনেক সুত্রে।
সুত্রে জানা যায়, গত ২০১২ সালের ২০মে সরকারী নির্দেশে ঢালাও ভাবে জমি ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করায় জমি বিক্রেতাদের ভোগান্তি চরমে উঠে। পাশাপাশি সরকার এ খাত থেকে প্রতি মাসে অনন্ত ৬ কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জেলার কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া,টেকনাফ ও মহেশখালী এই ৫টি উপজেলায় সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে আগে যেখানে জমি ক্রয়-বিক্রয় উপলক্ষে প্রচুর জনসমাগম হতো সেখানে অফিস ও অফিস প্রাঙ্গন ফাঁকা। আশেপাশের দোকান পাট, দলিল লিখকের কার্যালয় সবই নিষ্প্রাণ। এমনকি অফিসের কর্মকর্তাগন কর্ম ব্যস্ততায় নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত করতে পারতেনা তারাও বর্তমানে অনেকটা নিষ্কর্ম ওঅলস দিন কাটাচ্ছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সিনিয়র সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান স্বাক্ষরিত স্বারক নং- পত্র সংখ্যা ০৩০৭৩০৪৬২৫০০০০৮২০১১-১১৮ তারিখ- ২০ মে ২০১২ মূলে কক্সবাজার টাউন এন্ড সি-বীচ আপ টু টেকনাফ মহা পরিকল্পনাভূক্ত এলাকার পরিকল্পিত উন্নয়ন এবং উক্ত এলাকার জমি ক্রয় বিক্রয় বিষয়ক একটি চিঠি কক্সবাজার জেলা প্রশাসক বরাবরে ইস্যু করা হয়। এতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের স্বারক নং শাখা-৭/বিবিধ-২/২০০৭/১০৬৬ তারিখ ৭/০৮/২০১১ইং এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের স্বারক নং প্রশা- ৬/চউক-২/২০০৯(অংশ)/৫১৪,তারিখ ২৩/০৮/২০১১ ইং মূলে ২টি সুত্র উল্লেখ করা হয়েছে। এই চিঠিতে বলা হয় রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ এর ৪(১) ধারা মোতাবেক এ আইনের উদ্দেশ্য পূরন কল্পে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার নিবন্ধন ও এ আইনে বর্নিত অন্যান্য দায়িত্ব পালনের নিমিত্ত কক্সবাজার জেলার সমগ্র এলাকার জন্য ১ নং সুত্রস্থ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে এবং ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কক্সবাজার টাউন এন্ড সী-বীচ আপ টু টেকনাফ মহা পরিকল্পনাভূক্ত এলাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ণ কর্মকান্ড বন্ধ রাখার জন্য ইমারত নির্মাণ (বিসি) কমিটি গঠন করে ২ নং সুত্রের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়েছে। এমতাবস্থায় পরিকল্পিত নগরায়ণ ও পর্যটন মহাপরিকল্পনা সুষ্টুভাবে বাস্তবায়নের নিমিত্ত কক্সবাজার টাউন এন্ড সী-বীচ আপ টু টেকনাফ মহা পরিকল্পনাভূক্ত এলাকার অর্šÍভূক্ত মহেশখালীর গোরকঘাটা মৌজা, হামিদারদিয়া, পুটিবিলা, ঠাকুরতলা,কক্সবাজার মৌজা, ঝিলংজা,তেতৈয়া, খুরুস্কুল, পাটালী মাছুয়াখালী, খুরুলিয়া,তোতকখালী, ভারুয়াখালী, রাম ুচেইন্দা, জঙ্গলখুনিয়া পালং, পেচারদ্বীপ,ধোয়াপালং,গোয়ালিয়া পালং, জঙ্গল গোয়ালিয়াপালং, উখিয়ার জালিয়াপালং,রুমখাপালং, মারিচ্যাপালং, উখিয়ারঘাট, পালংখালী, ঘুমধুম, ইনানী, টেকনাফ উপজেলা ১১টি মৌজার মধ্যে ৮ টি মৌজা উক্ত আদেশের গ্যাড়াকলে পড়েছে । এতে রয়েছে শীলখালী মৌজা, বড়ডেইল, লেঙ্গুরবিল, টেকনাফ পৌরসভা, শাহপরীরদ্বীপ, সাবরাং, উত্তর হ্নীলা ও জিনজিরা (সেন্টমার্টিন) মৌজা। জেলার ৫টি উপজেলার এই ৩৩টি মৌজার জমি ক্রয় বিক্রয় এবং কোনরূপ স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনায় প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সকলকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের অনুমোদন গ্রহন করতে হবে।
এছাড়া নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর “প্রিপারেশন অবডেভেলপমেন্ট প্ল্যান অব কক্সবাজার টাউন এন্ড সী-বীচ আপ টু-টেকনাফ” শীর্ষক এলাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড বন্ধ রাখার জন্য ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৮২ এর অধীন প্রণীত ইমারত নির্মাণ আওতায় গত ২০১১ সালের ২৩ আগষ্ট ইমারত নির্মাণ (বিসি) কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে ৮ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হচ্ছে,সহকারী কমিশনার (ভুমি) কক্সবাজার, শহর পরিকল্পনাবিদ ( কক্সবাজার পৌরসভা) , সহকারী প্রকৌশলী (টেকনাফপৌরসভা), সহকারী প্রকৌশলী ( মহেশখালীপৌরসভা), সিনিয়র প্ল্যানার/ প্ল্যানার ( নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর), বনবিভাগের একজন প্রতিনিধি ও নির্বাহী প্রকৌশলী ( কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগ)।
হঠাৎ করে সরকারী এ নিষেধজ্ঞার ফলে চিকিৎসার জন্য শেষ আশ্রয় জমি টুকু বিক্রি করতে না পেরে মৃত্যুর পদযাত্রী আবদু শুক্কুর। রামুগোয়ালিয়া পালং এলাকার বাসিন্দা তিনি। মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রির টাকা নিয়েছে ঝিলংজার দরিদ্র আবদুল খালেক। কিন্তু জমি রেজিষ্ট্রি দিতে না পেরে কন্যার বিয়ে দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। জমি বিক্রেতারা তাদের অতি জরুরী প্রয়োজনে জমি বিক্রি করতেদ না পেরে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। অপরদিকে জমি ক্রেতারাও বেকায়দায় পড়েছেন।
একটি দায়িত্বশীল সুত্রে জানাগেছে, স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের আমল পর্যন্ত কক্সবাজারকে ঘিরে ৫টি মাষ্টারপ্ল্যান অনুমোদন হয়। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ ৪২টি বছর কেটে যাচ্ছে কিন্তু এই মাষ্টারপ্ল্যান গুলোর এক ইঞ্চত বাস্তবায়ন হয়নি।
সচেতন মহলের মতে, এক দেশে দুই ধরনের আইন হতে পারেনা। দেশের কুয়াকাটা সহ অন্যান্য স্থানেও রয়েছে পর্যটন এলাকা। কিন্তু সেখানে এ ধরনে আইন নেই বা করাও হয়নি। সেখানে ঠিকই জমি কেনা বেচা হচ্ছে। রেজিষ্ট্রিও করছে। সরকার পাচ্ছে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব। কিন্তু কক্সবাজার জেলায় এ বিষয়ে কথা বলার জন্য স্থানীয় ভাবে কিংবা মহান জাতীয় সংসদেও কোন নেতা নেই। সচেতন মহল ও সংক্ষুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্থরা জেলার সব দলের রাজনৈতিক নেতাদের বয়কট করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়,জেলার কক্সবাজার সাব রেজিষ্ট্রি অফিস, টেকনাফ সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, উখিয়া, মহেশখালী ও রামু সাব রেজিষ্ট্রি অফিস প্রতিমাসে ৩৫০ থেকে ৪০০টি দলিল সম্পাদন হতো। এ হিসাবে প্রতি মাসে ১৬’শ থেকে অনন্তত ২ হাজার দলিল সম্পাদন হয়ে আসছিল। এ খাতে সরকার প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ৬কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আয় করতো। কিন্তু হঠাৎ করে জমি বেচা-কেনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জমি ক্রেতারা অত্যন্ত বেকায়দায় পড়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের অনুমোদন বিষয়টি বাধ্যবাদকতা আরোপ করায় উভয় পক্ষ আরো বেশী হয়রানী এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন।
দলিল লিখক মোহাম্মদ মহসিন, ফয়েজ উদ্দিন সহ অনেকেই এ বিষয়ে বলেন, সরকারের উদ্দেশ্য অবশ্যই প্রসংশনীয়। কিন্তু ঢালাও ভাবে পুরো এলাকার যাবতীয় মৌজার জমি বেচা কেনার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় মানুষ চরম হয়রানী, ভোগান্তি ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন। সরকারের মহা-পরিকল্পনাভূক্ত মৌজায় সু-নির্দিষ্ট দাগগুলো চিহ্নিত করে প্রজ্ঞাপন বা নিষেধাজ্ঞা জারী করা হলে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি ও হয়রানীর ছোবল থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা সহজেই রক্ষা পেত।
তিনি আরো বলেন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের পরিবর্তে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে এ দায়িত্ব দেয়া হলে মানুষ হয়রানী থেকে অনেকাংশে রক্ষা পেত ও আর্থিক সাশ্রয় হত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কক্সবাজারের কয়েকজন সাব-রেজিষ্ট্রার বলেন, সরকারের নির্দেশ মতে তারা কাজ করছে। সরকার প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা তারাও স্বীকার করেন।---ডিনিউজ
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়