লিয়াকত হোসেন খোকন
ঢাকা: নদীর নাম ‘সন্ধ্যা’। নামটি এতোই ভাল লাগে সে জন্য আবারও সন্ধ্যা নদীর পূর্ব প্রান্তে পায়ে হেঁটে এলাম। নদীর এপার থেকে ওপার দেখা যাচ্ছে। মেঘলা আকাশ। পেছনে নারকেল সুপারির বাগান। সন্ধ্যা নদীর একদিকে স্বরূপকাঠি আরেকদিকে ইন্দেরহাট। বসে বসে দেখছি, ওই যে সূর্য অস্ত যাচ্ছে-নীড়ে ফিরছে কতনা পাখি। ওই সূর্যটা এই ৩েয ডুবছে-জীবন প্রদীপটাও একদিন এ ভাবেই নিভে যাবে। আকাশ পানে তাকাতে তাকাতে দেখি সূর্য অস্ত চলে গেছে, মনে হলো সন্ধ্যা নদীতেই বুঝি ডুবেছে সূর্যটা। দেখি এক নৌকো চালক-সামনেই হারিকেন, নদী তীর ঘেঁষে এগিয়ে আসছে। নৌকা চালানোর ঢংটাই বেশ ভিন্ন ওর। বৈঠা হাতে মাঝির কন্ঠে শুনতে পেলাম-‘আমার গহীন জলের নদী/আমি তোমার জলে রইলাম ভেসে জনম অবধি/তোমার বানে ভেসে গেল আমার বাঁধাঘর/চরে এসে বসলামরে ভাই ভাসহেল সে চর/এখন সব হারিয়ে তোমার জলেরে আমি ভাসি নিরবধি/আমার ঘর ভাঙ্গিলে ঘর পাব ভাই/ভাঙলে কেন মন/হারালে আর পাওয়া না যায় মনের মতন/জোয়ারে মন ফেরে না আররে/ভাটিতে হারায় যদি/তুমি ভাঙ যখন কূলরে নদী ভাঙ একই ধার/আর মন যখন ভাঙরে নদী দুই কূল ভাঙ তার/চর পড়ে না মনের কূলেরে/একবার সে ভাঙে যদি. . .’ গানটা শেষ হতেই—এই যে রঙিলা নায়ের মাঝি, কোথায় চলছো-নদীর বিরুদ্ধে তোমার এতো অভিযোগ কেন? মাঝি-এতো গানের কথা, মনের কথা নয়। কেন! আপনি কি জানেন না, কত না মানুষ অন্যের মন ভেঙে দেয়! বলুন তারা কী ভাল! নিশ্চয়ই না। বললাম, কোথায় তোমার বাড়ি, নামটি তোমার কী ই বা? হেসে-একটু খানি শ্যামল ঘেরা কুটিরে মোর বাড়ি। জানেন, সেখানে একদা দেখা দিতো ধানের শেষে ইশারাতে পিড়ি পেতে বসতো আর বাবা সবখানি মন উজাড় করে। দিতো তারে খানাপিনা আমার কিষানী মা সেই কাহিনী শোনাই শোন. . .। এবার গান ধরলো মাঝি—‘ঘুঘু ডাকা ছায়ায় ঢাকা/গ্রামখানি কোন মাথায় ভরে। শ্রান্তজনের হাত ছানিতে/ডাকতো তারে আদর করে সোহাগ ভরে/নীল শালুকে দোলন দিয়ে রঙ ফানুসে ভেসে/ঘুম পরা সে ঘুম পাড়াত এসে কখন যাদু করের/ভোমরা যেত গুণগুণিয়ে ফোটা ফুলের পাশে. . .।’ গানখানি শুনে যেনো মাঝির প্রেমে পড়ে গেলাম। এই নামটি বলোনা?-আমি যে রঙিলা নায়ের মাঝি, আমায় ‘রঙিলা’ নামে ডাকতে পারেন. . .। বললাম, এই যে রঙিলা নায়ের মাঝি, তোমার নৌকোয় বেড়ায়ে রাতটা কী আজ পার করা যায়? ওই যে দেখা যায়, আকাশেতে অগণিত তারা। শুয়ে শুয়ে না হয় গুণবো। কী নৌকায় নিবে? মাঝি— আসুন, আসুন উঠে বসুন। আপনি যে নামার মেহমান. . .।
শুয়ে শুয়ে দেখছি আকাশের লক্ষ তারা। গুণে কী আর শেষ করা যায়। কী সুন্দর পৃথিবী। এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। এক তীরে দেখি গাছপালা-সর্বত্র নির্জন নিরিবিলি। নেই কোনো মানুষের পদচারনা। জোনাক পোকা জ্বলে জ্বলে নিভে যায়-মনে হয় এ যেনো ঝিকিমিকি তারার মিছিল। তখনতো মনে হলো—‘স্বপ্ন ভরা স্বপ্ন মায়ায়/নিবিড় কালো আঁধার ছায়ায়। সন্ধ্যা নামে নীল গগনে হায়/রাত্রি নামে ঐ জ্যোছনা ভরা. . .’ গানের কথাগুলিই। এই রঙিলা নায়ের মাঝি, নামটি কী বলবে না?-যখন রঙিলা বলে ডেকেছেন-ওটাই না হয় থাক। জিজ্ঞেসা- বয়স কতো হলো? সতেরো পেরিয়ে আঠারো পড়েছে ভাদ্র মাসের ১৫ তারিখ থেকে। ‘তা এবার কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছো?’ রঙিলা মাঝি-আকাশের তারা গুণতে থাকুন-একশ’ তারা গুণা শেষ হলেই ফিরিয়ে নিয়ে আসবো আপনার বসে থাকা সেই নদীর কূলেতে। বললাম, রঙিলা, আজ রাতটুকু না হয় তোমার বাড়িতেই রাখো। ভ্রমণটা বেশ জমবে! হাসলো রঙিলা নায়ের মাঝি। আরে কী যে বলেন, গরীবের বাড়ি যাবেনতো! নাকি তামাশা করছেন! বললাম, তা হবে কেন! তোমাকে দেখে খুউব ভালো লেগেছে বলেইতো তোমার নায়ে উঠলাম। এই যে ধরো দেখতে তুমি কী ইনা সুন্দর! তুমি যে নায়ের মাঝি-এটা তো বিশ্বাসই হয় না। কী যেনো ভাবলো রঙিলা মাঝি—জানিনা জানিনা আমার এ মন কেন রাঙালে! যার পথ চেয়ে দিন গুণেছি-আজও তার পদধ্বনি শুনেছি. . . সে কী আপনি-আপনি! ওর কথাগুলো শুনে বার বার অবাক হলাম। এই যে রঙিলা তুমি কী কাউকে ভাল বসো! “ও হ্যাঁ মনে পড়ছে ভালবাসার সেই মেয়েটির কথা।’ মেয়েটি অষ্টম শ্রেণীতে পড়তো। নামটি ছিল তার ‘চন্দনা’। আহা কী না ছিলো রূপ। ওকে প্রায়ই বলতাম, ‘চন্দন বনে মন হারাতে দোষ কোথায়! রেখেছি যে দু’টি ভিরু হাত তোমারই হাতে. . .।’ এ কথাগুলো বলতেই চন্দনা বেশ লজ্জা পেতো। আসলেই চন্দনা ছিলো লাজুক লতা। প্রায়ই ওকে নিয়ে সন্ধ্যা নদীতে নৌবিহার করতাম। চন্দনার বাবা-মা এটা মেনে নিতে পারেনি কখনও। যখনই তারা জেনেছে, ঘরের বাইরে ওকে আর যেতে দেয়নি। বহুবার মার খেয়েছে আমারই জন্যে। যাতনা সইতে না পেরে চন্দনা একদিন আত্মহত্যা করলো. . . কথাগুলো বলে রঙিলা মাঝি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আমার পাশে এসে বসলো। হাতটা স্পর্শ করে-বলুন, এখন আমি কী করবো? আমার জীবনটাই যে বৃথা! কেউ আমাকে বুঝলো না, জানতে চেষ্টাও করলো না। সে সময় যে কারোরই নেই. . .। পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর।
সন্ধ্যা নদীর ওপারে ইন্দেরহাটের কাছাকাছি নৌকো এসে গেছে। বললাম, তোমার গাঁয়ে নিয়ে চলো। দু’ চোখের জল মুছে— ঐ যে খালটা দেখছেন, এরই দেড় কিলোমিটার দূরে আমার বাড়ি। নির্জন কুটিরে একাই যে থাকি। কাছে পিঠে নেই কোনো বাড়িঘর। নিজেই রান্না করি-খেতে পারবেন তো? - কেন নয়? বললো, থাকবেনতো আমার সাথে!-কী যে বলো রঙিলা মাঝি। যাবো তোমার গাঁয়ে, দেখবো তোমার কুঠির! হাসলো রঙিলা, একটা গান শুনুন-‘আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি/তুমি এ ঘাট লাগায়ারে নাও/লিগুম কথা কইয়া যাও শুনি/তোমার ভাইটাল সুরের সাথে সাথে কাদে গাঙের পানি/ ও তার ঢেউ লাগিয়া যায়/ভাসিয়া কাঙ্খের কলসখানি/পূবালী বাতাসে তোমার নায়ের বাদাম ওড়ে. . .’ গানটা শেষ না করেই রঙিলা মাঝি বললো, ঐ যে দেখছেন বাগান-বাবা মারা যাওয়ার সময় ওটাই রেখে গেছেন। ওখানে রয়েছে কতনা ফুল গাছ। চলুন, দেখবেন। ওর পিছু পিছু চললাম. . .। ভাবলাম, গাঁয়ের বাগান রাতের আঁধারে ঘুরে দেখা সে কীইনা আনন্দের। এমন আনন্দ এ জীবনে কী আর পাবো! রঙিলা মাঝি— দেখুন ওই যে আম গাছে আম ফলে, সময় এলেই ফল ধরবে। জাম গাছেও জাম ধরে। বললাম, এই আঁধার রাতে এ সব কথা কেন, অন্য কথা শুনাও। কেন আপনি কী ঐ গানটা শোনেননি, “আম গাছে আম ফলে, জাম গাছে জাম হায়রে, জাম গাছে জাম আমি পথের পানে চাইয়া থাকি না আসিল শ্যাম প্রাণ-কোকিলারে. . . বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে নলের বেড়া. . .।’ হ্যাঁ শুনেছি-বাহ্ কতইনা চমত্কার এই গানটা। এবার আমার পানে চোখ দু’টো বড় বড় করে তাকিয়ে—সামনেই শ্মশান ঘাট। ওখানেই আমার বাবা-মা আর চন্দনাকে দাহ করা হয়েছিলো। কথাটা শুনে একটু ভয় ভয় লাগলো। শ্মশান ঘাট দেখাবে-এই রাতে, তা রাতের আঁধারে ভ্রমণে এসে কী ই না জ্বালায় পড়লাম। এ যে কোথায় এলাম- কোন মায়াপুলতে। এদিকেই বা কেন নিয়ে এলো. . .। ভয়ে বুকটা দূরু দূরু করছিলো। ঠিক সেই ক্ষণে রঙিলা মাঝি আমাকে বুজে জড়িয়ে-ভয় পাচ্ছেন কেন? রাতের আলো-আঁধারিতে গাঁয়ে ভ্রমণ— এ যে হবে আপনার জীবনে এক দারুণ স্মরণীয় ঘটনা। কী তাই না! ভয় নেই. . .। চলুন, কুঠিরে ফিরে যাই। রঙিলা মাঝিকে দেখে বার বার কেমন জানি মনে হলো। ভাবলাম কেনই যে ওর সঙ্গে দেখা, কেনই যে ওর সঙ্গে এই গাঁয়ে আসা! বুদ্ধি করে বললাম, ওই যে পথের ধারে কামিনী গাছটা দেখছি ওখান থেকে এক গুচ্ছ ফুল নিবো! জামিনী ফুল যে আমার খুব প্রিয়. . .। হঠাত্ দোিখ তিন জন লোক এগিয়ে আসছে। তারা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন? বললাম, ওই যে নৌকায় এক মাঝি আছে-নাম ‘রঙিলা’ ওর গাঁয়ে যাবো। একজন বললেন, কোথাওতো কোনো নৌকা নেই। বলুন, কীভাবে এলেন এই পথে।
সব কথা খুলে বলতেই একজন বললেন, সে কি আপনাকে ঐ বাগানে নিয়ে গিয়েছিলো. . .। ‘হ্যাঁ’ বলতেই ভদ্রলোক তিন জন এক বাক্যে বললেন, আপনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। ওদিকে যে শ্মশানঘাট। এই তো কিছুদিন আগে আত্মহত্যা করেছিলো একটি ছেলে, একটি মেয়ে—ওরা একে অপরকে ভালবাসতো। মেয়েটির নাম ‘চন্দনা’। ছেলেটির নাম ‘হৃদয়’। একজন হিন্দু, আরেকজন মুসলমান। সবাই বলে ওরা নাকি ভূত হয়ে গেছে। ঐ ভূতের সঙ্গেই যে আপনার দেখা। এখন আর ভয় নেই চলুন আমাদের বাড়িতে। রাতটা না হয় থাকবেন— কালকে চলে যেতে চাইলে যাবেন. . .। সকাল বেলা বাড়ির মালিক আমার সামনে ‘৬৪ জেলা ভ্রমণ’ বইটি দেখিয়ে বললেন-এই বইতো আপনি লিখেছেন, আপনি ভ্রমণ বিলাসী. . .আপনাকে আমার বাড়িতে কয়েকদিন থাকতেই যে হবে!
ভদ্রলোকের নাম আহম্মদ আলী -তিনি এক সময় সরকারি চাকরি করতেন। তাঁরই ছোট ছেলে সবুজের সঙ্গে চললাম, সবুজ গাঁও দেখতে। যে দিকে পথ চলা সেদিকেই চোখে পড়ছে নার্সারী আর নার্সারি। কামিনী, জবা, রজনীগন্ধা, গোলাপ, হাসনা হেনা, জুঁই, চামেলি কতনা ফুল গাছ। ফুলে ফুলে ভরা সন্ধ্যা নদীর দুই কূল। সবুজ আমার হাতে একটি গোলাপ তুলে দিয়ে বললো, ‘ভ্রমণে এসেছেন দেবার কী আছে. . .এই টুকু ভালবাসা নিন. . .’ বলেই গানের ভাষায় জানালো—‘গোলাপের বুকে বিহগীর মুখে জাগে, ভুবনের পথে আমরা শুনেছি নতুনের আহ্বান. . .’। পায়ে হেঁটে এলাম সন্ধ্যা নদীর তীরে। দেখি এই কূলে ইন্দেরহাট আর ঐ কূলে স্বরূপকাঠি— নদী এঁকে বেঁকে চলে গেছে। মন জুড়ানো বাতাস তখন মনে করিয়ে দিলো—“ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে/বল কোথায় তোমার দেশ/তোমার নাই কি চলার শেষ ও নদীরে. . .” গানের এই কথাগুলি। বাহ্ কতই সুন্দর এই জনপদ!!
ইন্দেরহাট-স্বরূপকাঠি: সবুজ শ্যামল রূপ রয়েছে সন্ধ্যা নদীর এপার ওপার ইন্দেরহাট আর স্বরূপকাঠিতে। দক্ষিণের জনপদ এই দুই জায়গা থেকে বেড়িয়ে আসা যায়। যেদিকে যান না কেন সুপারি, নারকেল আর পেয়ারা বাগান। নার্সারি আর নার্সারি দেখে বলবেন, এ যে ফুল ও ফসলের দেশ। ঢাকার সদরঘাট থেকে ছাড়ে শহীদূত, রাজদূত, আঁচল, অগ্রদূত, টিপুসহ কয়েকটি লঞ্চ। বানারিপাড়ার পরেই ঈদের হাট-এখানেওই নামুন। স্বরূপকাঠি আর ইন্দেরহাটের সন্ধ্যা নদীতে এবং খাল-বিলে বেড়ানোর জন্য ডিঙ্গি, পানসি, বজরা নৌকা পাবেন। নার্সারিগুলো ঘুরে দেখার জন্য আরামকাঠি, মাহামুদকাঠি, কুড়িয়ানা, আটঘর প্রভৃতি গ্রামে যাবেন। কোড়িখাড়ায় গেলে দেখবেন এখানে তৈরি হয় ক্রিকেটের ব্যাট, কাছি, দড়ি, পাপোশ, ফ্লোর ম্যাট, ফুলের ঝাড়ু, নারকেল শলার ঝাড়ু, কাঠের লাঠিম। শুধু কৌড়িখাড়ায় নয়, সুঠিয়াকাঠি, সোহাগদল, রাজাবাড়ি, বরছাকাঠি, আলকির হাটে গেলেও এ সব তৈরির কারখানা দেখা হয়ে যাবে। কাঠের আড়ত আছে এই স্বরূপকাঠিতে। এখানকার নদী বন্দরে দেখবেন- সুন্দরবনের গোলপাতা দিয়ে সুন্দর সুন্দর ঘর। প্রতিটি বাড়িতে দেখবেন নারকেল-সুপারির বাগান। কৌড়িখাড়া রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, কুমারখালী কালীমন্দিরও দেখার মতো, রাত যাপন করার জন্য সন্ধ্যা নদীর দুই পাড়ে আবাসিক হোটেলও রয়েছে। এই ভ্রমণে জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা নিয়ে গেলেই চলবে। গাঁয়ের সীমানায় গেলে কারোবা জীবনে ঘটতে পারে রোমাঞ্চকর ঘটনা-এ জন্য মনটা চাই অবশ্যই রোমান্টিক।----ডিনিউজ
কৌড়িখাড়া ও রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ বাড়ি (আঠারো শতকের) এটা খুজে পাচ্ছি না। এখানে কিভাবে যাবো বলতে পারবেন?
ReplyDelete