Wednesday, September 4

সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি ‘তাজমহল’

ঢাকা: এগারোবার আগ্রায় গিয়ে তাজমহল দেখা- এতো কম ভাগ্যের কথা নয়। আমার কাছে মনে হয় আগ্রাতো তাজমহলের নগরী। এই তাজমহলের টানে ওখানে গিয়ে সকালে বিকেলে ছুটে যেতাম তাজমহলে। এবার জয়পুর থেকে আগ্রায় পৌঁছতে বিকেল চারটে বেজে গেল। সঙ্গে ছিল আমার ছেলে অলি শাহরিয়ার হাসান। ঈদগাহ রোডে বাস রাখতেই রাস্তার অপর পাশে গেলাম এক হোটেলে। সেখানে লাগেজ রেখেই স্কুটার ভাড়া করে ছুটলাম তাজমহলের দিকে। ১০ কি ১২ মিনিট পরে এসে পৌঁছলাম তাজমহলের কাছে। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম তাজমহল দেখতে। দেখি অসংখ্য ট্যুরিস্টের ভিড়। শুধু ভারতীয় নয়, ইউরোপ, আমেরিকা মহাদেশ থেকেও দলে দলে ভিড় করেছে ট্যুরিস্টরা। সবারই উদ্দেশ্য তাজমহল দেখা। জুতা রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম তাজমহলে। রোদের তাপে ফ্লোর এতোই গরম ছিল যে জন্য পা পর্যন্ত রাখতে পারছিলাম না। মনে হলো পা যেনো পুড়ে যাচ্ছে। ভাবলাম, তাতে কী- তাজমহল তো আবারও দেখছি। ভাবলাম, মোগল সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি ‘তাজমহল’ সৃষ্টির কথা। সম্রাট তাঁর স্ত্রী বেগম মমতাজের সমাধির ওপর তৈরি করান প্রেমের এই সৌধ। শ্বেত মর্মরের এই সৌধটি আজ ভুবন বিখ্যাত। ওখানে পরিচয় হলো, এক বাঙালি ট্যুরিস্টের সঙ্গে। উনি থাকেন লে তে। বয়স প্রায় সত্তর। তিনি জানালেন, এ নিয়ে তিনি তাজমহলে ৫০ বার এসেছেন। তিনি আর যা যা বললেন তা এবার তার মুখেই শোনা যাক : ‘অক্টোবরের প্রথম দিকে পূর্ণিমাতে তাজ যেন সজীব হয়ে ওঠে। তখন তাজ দেখার জন্য ছুটে আসি আগ্রাতে। জানেন, পূর্ণিমার রাতে ন ত্র আলোকিত রাতে বা উষাকালে তাজের সৌন্দর্য দেখার স্মৃতি আজও যে ণে ণে জেগে ওঠে। দুগ্ধধবল রূপালি রঙ নেয় উষায়, রূপালি থেকে গোলাপি-লালে। চাঁদের আলোয় মনে হবে পরীর দেশের জাহাজ ভাসছে যমুনার জলে ...। আমার কাছে কিন্তু তাই-ই মনে হয়েছিল।’ কথাগুলো শুনে মুগ্ধ না হয়ে কী পারা যায়। ওই ট্যুরিস্টের সঙ্গে বেশ সখ্য হলো। তার নাম মুনির খান। দূর সম্পর্কে তিনি কণ্ঠশিল্পী তালাত মাহমুদের আত্মীয়ও হন। মুনির খান কথায় কথায় বললেন, বাংলার মেয়ে আরজুমান বানু উত্তরকালে ভারত সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী হয়েছিলেন, এই আরজুমান বানুর নামই হলো- ‘বেগম মমতাজ মহল’। ১৭ বছরের বিবাহিত জীবনে ১৪তম সন্তানের জননী হতে গিয়ে ৩৮ বছর বয়সে ১৬৩১ সালের ১৭ জুন মারা যান তিনি। মৃত্যুর ৬ মাস পরে স্থানান্তরিত হন বুরহানপুরের সাময়িক সমাধি থেকে আগ্রায়। মমতাজের মৃত্যুর এক বছর পর তাজমহল নির্মাণের কাজ শুরু করান শাজাহান। শেষ হতে লাগে ১৮ বছর। কর্মীর সংখ্যা ছিল ২০ হাজার, খরচ পড়ে ৪০ লাখ পাউন্ড। টিটানস নামে এক স্থপতির নকশায় পারস্য থেকে আসা ওস্তাদ ঈশা তৈরি করেন এই তাজ। জনশ্রুতি দ্বিতীয়টি গড়ার ভয়ে নির্মাতার হাত দুটি কেটে চোখও অন্ধ করে দেন সম্রাট শাহজাহান। এসব অজানা কথা শুনে মুনির খানের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

বারবার দেখে যাচ্ছি তাজমহলের ঝলমলে রূপ। লাল বেলে পাথরের তোরণে তাজের প্রবেশ, এখানে উৎকীর্ণ হয়েছে আরবিতে লেখা অনেক কথা। দেখলাম, এখানে আটকোনৎণা ঘররূপী প্রবেশ দ্বারের শিরে ২২টি মিনার রয়েছে। মুনির খান বললেন, হোটেলে ফিরে যাচ্ছি, কালকে সকালে এলে দেখা পাবেন। ও হ্যাঁ- আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট তথা শহরমুখী পশ্চিমে শাহজাহানের আর এক বেগমের স্মারকরূপী ফতেপুরী মসজিদ রয়েছে, ওখানে যেতে যেনো ভুল না করেন। তেমনি শহরের পূবের প্রবেশদ্বারের কাছে বেগম শিরহিন্দির সমাধিসৌধ আর দক্ষিণ দ্বারে গেলে দেখবেন মমতাজের সহচরীর স্মারক সৌধ। মনে রাখবেন, প্রতিটি প্রবেশদ্বারই মোগলি স্থাপত্যে অনবদ্য ...।

তাজমহলের একটু দূরে গেটের কাছেই দেখলাম তাজ মিউজিয়াম। দূর থেকে তাকিয়ে আছি তাজমহলের দিকে। এখানে প্রশস্ত বাগিচায় ফোয়ারার সারি বেয়ে দেবদারু ও সাইপ্রাসের ছায়ায় পথ চলে গেছে। ফোয়ারার জলাধারেও দেখা মেলে তাজমহল। একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ওয়েটার এসে বললো, কি খাবেন? বললুম চিকেন ফ্রাই সঙ্গে কোল্ড ড্রিংকস দিও। তখনও বারবার মনে পড়ছিল তাজমহলের কথা। শ্বেতপাথরের জালি পর্দার মাঝে দিয়ে আলো এসে পড়ে পাশাপাশি শায়িত সম্রাট শাজাহান ও বেগম মমতাজের কবরে বেসমেন্টে। বারবার ভাবছি, এটা কি ভাবে সম্ভব! সত্যিই সবই সম্ভব করে গেছে মোগলরা। আজকে আমরা দেখলাম শ্বেতপাথরের জালি, অথচ অতীতে এখানে ছিল মণি-মাণিক্যখচিত সোনার ঝালর।

তাজমহল কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে এসে স্কুটার ধরে ফিরলাম হোটেলে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে তাই রাতে আর বের হলাম না। একজন গাইড এলেন রাত ৯টায়। তিনি জানালেন, ১৫০১ সালে সিকান্দর লোদীর রাজধানী হয় প্রথমে এই আগ্রায়। আবার বাবর দখল করেন ১৫২৬ সালে। তবে বাবরের পৌত্র আকবরের হাতেই আগ্রার সমৃদ্ধি ঘটে। জাহাঙ্গীরের আমলে আগ্রাই ছিল রাজধানী। এরপরে শাহজাহান আগ্রা দুর্গে একাধিক সুদৃশ্য হর্ম্যসহ তাজমহল নির্মাণ করেন। ১৬৫৮ সালে অসুস্থ অবস্থায় রাজ্যচ্যুৎ হয়ে পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দি থাকেন তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যšত আগ্রা দুর্গে। ১৬৬৬ সালে বৃদ্ধ বন্দি সম্রাট শাজাহান ৭৪ বছর বয়সে তাজের দিকে তাকিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আগ্রা দুর্গে।

গাইডের পরামর্শ অনুযায়ী পরদিন তার সঙ্গে রওয়ানা দিলাম সিকান্দ্রায়। আগ্রা থেকে সিকান্দ্রার দূরত্ব ১০ কিমি উত্তরে। এখানে গিয়ে দেখলাম আকবরের সমাধিসৌধ। ৯৯ ধর্মমতের দেবতাদের নাম উৎকীর্ণ হয়েছে এই সমাধিগাত্রে। আকবরের হাতে এর নির্মাণ শুরু... সম্পূর্ণতা পায় পুত্র জাহাঙ্গীরের হাতে ১৭১৩ সালে। আকবরের সমাধি সৌধ দেখে এবার গেলাম মরিয়মের সমাধি দেখতে। মরিয়ম হলেন সম্রাট আকবরের গোয়ানিজ বেগম। এই সমাধি সৌধের চারপাশে দেখলাম ফুলের বাগিচা। বিকেলে গেলাম আগ্রা থেকে ৫৬ কিমি দি ণ-পশ্চিমে ফতেপুৃর সিক্রি দেখতে। ওখানে গিয়ে শুনলাম, আকবরের ছিল অনেক বেগম, ৮০০ পূরণারী- তবুও নিঃসšতান। অবশেষে এখানে এসে মুসলিম ফকির শেখ সেলিম চিস্তির দোয়ায় পুত্র লাভ করেন। যে জন্য ফকিরের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশে তাঁরই গ্রাম ফতেপুরের শিরে রাজধানী স্থানাšতর করেন আকবর। গড়ে ওঠে দুর্গ তথা রাজধানী শহর ১৫৬৯ সালে মোগল সম্রাট আকবরের হাতে। তবে, জলাভাব হেতু ১৬ বছর পরে আবার স্থানাšতর ঘটে রাজধানীর। পুত্রের নামও রাখেন সেলিম-উত্তরকালে তিনি হয়েছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর।

গাইড এবার একে একে দেখিয়ে দিলেন- দেওয়ানি-আম, শাহী দরওয়াজা, ইবাদতখানা, দেওয়ানি খাস, মিনার, মসজিদ, আকবর জননীর সুনহারা মহল, জাহাঙ্গীর জননী যোধা বাঈয়ের প্রাসাদ, আকবরের খ্রিস্টান বেগম মরিয়মের গোল্ডেন প্যালেস,রুমি সুলতানা বা তুরস্কের বিবি সুলতানা বেগম, কুঠি, বীরবলের বাড়ি, হাওয়া মহল, পাঁচ মহল, সেলিম চিস্তির দরগা ...। সিকান্দ্রা দেখা শেষ করে আগ্রায় পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

পরদিন সকালে এলাম আগ্রা দুর্গে। তাজমহলের ২ কিমি উত্তর-পশ্চিমে যমুনার কিনারায় এই দুর্গ। এখানে এসে দেখলাম- আকবর মহল, জাহাঙ্গীর মহল, যোধাবাঈ মহল, মন্দির, শাহজাহানী মহল, শীশ মহল, হামাম, মিনা

মসজিদ, দেওয়ানি আম ...। গাইড জানালেন, ওই যে দেখুন একটি মহল। এই মহলটি শাহজাহান নির্মাণ করান বেগম মমতাজের জন্য। অথচ দুর্গের এই মহলে পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দি হয়ে অশ্রু সজল চোখে তাজমহলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেহ রেখেছিলেন সম্রাট শাহজাহান ...। এ কথা শুনে মনটা ব্যথিত হয়ে উঠলো। ভাবলাম সম্রাট শাহজাহানের ছেলে আওরঙ্গজেব এতো নিষ্ঠুর হয়েছিল কেন! এই আওরঙ্গজেবই তো হত্যা করেছিল আপন ভাই দারা, সুজা ও মুরাদকে ...। ইস্ মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় কী ভাবে! বাবা ও ভাইদের চেয়ে গদি কী এতোই বড়!!

এক বিকেলে গেলাম ইৎমদ উদ-দৌলা সৌধি দেখতে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের উজির বা প্রধানমন্ত্রী মির্জা বেগের রূপসী কন্যা হলেন নূরজাহান। তিনি তার বাবা ও মায়ের মৃত্যুর পরে ইৎমদ-উদ-দৌলা সৌধ নির্মাণ করিয়েছিলেন। ওই ইৎ মদ উদ-দৌলায় রয়েছে নূরজাহানের বাবা মির্জা গিয়াসউদ্দিন বেগ এবং তার মাতার সমাধি। আগ্রা দুর্গ থেকে ১ কিমি উত্তর-পশ্চিমে যমুনার ওপারে এই সমাধি সৌধ দেখে মনে হলো তাজমহলের চাইতে এটিও বা কম কিসে। গাইড বললেন, দেখুন দেখুন ইৎ মদ উদ-দৌলা। তাজমহলের পূর্বসূরি এটি। আর মোগল সম্রাটদের হাতে শ্বেতমর্মরে তৈরি সৌধ এটিই প্রথম। পার্সিয়ান ছাপ রয়েছে এর ইন্দো-ইসলাম স্থাপত্যে। সম্রাট শাজাহান অনুপ্রাণিত হন তাজমহল তৈরিতে ইৎ মদ-উদ-দৌলা সৌধ থেকেই। আগ্রায় এগারোবার গিয়েও মনে হয়, আগ্রা দেখা যেনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেল ...।---লিয়াকত হোসেন খোকন

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়