Saturday, September 14

বর্ষায় ঝড়-তুফানে কুতুবদিয়া দ্বীপে


ঢাকা: বর্ষাকালেই তো ঝড়-তুফান হয়। অথৈ বঙ্গোপসাগরে ভাসছে কুতুবদিয়া দ্বীপ। সাগরে কীই না তুফান— এই বুঝি ঝড় নেমে আসবে। বসে আছি কুতুবদিয়া দ্বীপের সাগর মোহনায়। অথৈ জলরাশি দেখে ভাবলাম, পড়ন্ত বিকালে সাগরের বুকে নৌকায় ভেসে বেড়ালে কেমন হয়। এদিকে বর্ষাকাল। মোহনায় একটু দূরে এক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কত না বৃক্ষ। বৃষ্টি আসুক, নামুক ঝড়—দেখি না, ঝড়-তুফানে সাগরের জল কতই না উত্তাল হতে পারে। আকাশে সেই ক্ষণে ছিল হালকা মেঘ। বেশিটা সময় লাগেনি আকাশ গর্জে উঠতে। দু-তিন মিনিট যেতে না যেতে দেখি মেঘ যেন ধেয়ে আসছে চারিদিকজুড়ে। হঠাত্ দেখি নৌকাতে বসে এক যুবককে গাইতে, ‘সাগরকূলের নাইয়ারে অপর বেলায় ও মাঝি কোথায় চলছ বাইয়ারে...।’ তখন সাগরের প্রতি আরও আকর্ষণ বেড়ে গেল। কিছু সময়ের জন্য বৈঠা নিতে দোষ কোথায়। দৌড়ে এলো পনেরো বছর বয়সী তিনটি ছেলে, ‘কাকা, চলুন, সাগরে নৌকো ভাসাই। আমরা সবাই ভেসে যাই। তখন কুতুবদিয়ার রূপে মুগ্ধ না হয়ে কি পারবেন!’
বললাম, ঝড়-তুফান আসবে, তোমাদের কি ভয়ডর নেই! একটি ছেলে হাসতে হাসতে বলল, ‘ঝড়-তুফান পরোয়া করি না।’ একটি ছেলে গেয়ে উঠলো, ‘ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা/সাম্পানওয়ালার বাবরি চুল, হরে নিলো জাতির কুল... কুতুবদিয়া বন্ধুর বাড়ি... বিচ্ছেদ জ্বালা সইতে না পারি। বাহার মারি যায়রে সাম্পান, কিবা ভাটি কিবা উজান, ঝড়-তুফানে পরোয়া করে নারে সাম্পানওয়ালা...।’ এই গানটি গাইতে গাইতে ছেলেটি আমার হাত স্পর্শ করে বলল, ‘উঠুন সাম্পানে।’ একে একে পরিচিত হলাম সবার সঙ্গে। প্রদীপ, মণি আর হুমায়ূন ওদের নাম। ওরা কেউই স্কুলে যায় না। 
সাম্পান অথৈ সাগরের বুকে এগিয়ে চলছে। একদিকে কুতুবদিয়া দ্বীপের গাছপালা, আরেক দিকে দেখা যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের জলরাশি। প্রদীপ গান ধরল, ‘মাঝি বাইয়া যাওরে/অকূল দরিয়ার মাঝে/আমার ভাঙা নাও ওরে/ভ্যানা কাষ্ঠের নৌকাখানি মাঝখানে তার গুঁড়া। নৌকার আগোয় থাইকা পাছায় গ্যালে গলুই যাবে খইয়ারে মাঝি.../শিক্ষাদীক্ষা না হইতে আগে করছো বিয়া/তুমি বিনে খতে গোলাম হইলে/গাইডের টাকা দিয়ে/বিদেশে বিপাকে যারও বেঠা মারা যায়/পাড়া-পড়শি না জানিয়ে জানে তার মায়...।’ গানটা শেষ হতেই প্রদীপকে জিজ্ঞেস করলাম, এ গান তুমি কার কাছে শিখেছ? এলাকার বড় ভাইদের মুখে শুনে শুনে। আর শিল্পী কে জানেন—আব্বাস উদ্দিন আহমেদ। 

কথায় কথায় হুমায়ূন বলল, কুতুবদিয়া দ্বীপের মানুষের জীবনে কি আর নিরাপত্তা আছে? যখন-তখন এই দ্বীপ সাগরে তলিয়ে যেতে পারে। কত বান-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস হয়ে গেল, তবুও টিকে আছে কুতুবদিয়া দ্বীপ। সবই কুতুব আউলিয়ার দোয়া। 
সাম্পানে বসে ভাবছি, শুধুই কুতুবদিয়া দ্বীপকে নিয়ে। এখানে আছে নতুন বাতিঘর, শাহ আবদুল মালেক মহিউদ্দিনের দরগা শরিফ, সাগর থেকে ভেসে ওঠা প্রাকৃতিক পাথর, সবুজ লতায় ঢাকা বালির টিলা, জামে মসজিদ, লবণ ফ্যাক্টরি। এগুলো তো দেখেছি আগেই। হঠাত্ মণি বলল, কুতুব আউলিয়ার নামানুসারে নাম হয়েছে ‘কুতুবদিয়া’। ষোলোশ’ শতকের শেষদিকে এখানে গড়ে ওঠে জনবসতি। দেখুন, কত অপরূপ কুতুবদিয়া, অথচ এখানে আজও গড়ে ওঠেনি পর্যটন কেন্দ্র। রাত্রি যাপন করার জন্য নেই কোনো ভালো আবাসিক হোটেল...। 
কথাগুলো শুনে মণির মুখপানে তাকিয়ে আবার দু’নয়ন ভরে দেখে যাচ্ছি সাগরের রূপ। মনে পড়ল, মগনামা ঘাটের কথা। ওদের বললাম, আমার যে যেতে হবে মগনামা ঘাটে। ওখানে আজ রাতে এক বন্ধুর বাড়িতে থাকব।
একথা শুনে হুমায়ূন বলল, আজকে যেতে পারবেন না। আমাদের বাড়িতে থাকতেই হবে। কুতুবদিয়া দ্বীপের ঘাটে সাম্পান এনে রাখল ওরা। নেমে এলাম কূলে। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। পায়ে হেঁটে চলছি ওদের পিছু পিছু। কিছুদূর যেতেই দেখি ‘বাতিঘর’। এই বাতিঘরই সমুদ্রের পথ দেখায়। সেই মুহূর্তে কুতুবদিয়ার সমুদ্রে চলে যাওয়া এ বাতিঘরটির কথা মনে পড়ল। ১৮২৮ সালে নির্মিত সেই বাতিঘরটি ১৯৭৮ সালে সাগরে বিলীন হয়। ১৯৭৬ সালে এখানে এসে সেই বাতিঘর দেখার স্মৃতি বারবার মনে পড়ছিল। থানা ভবনের সামনে এসে দেখলাম, একটি দীঘি। এর চারদিকে গাছগাছালি। এদিকে রাত ৮টা। দেখি আকাশে বিদ্যুত্ চমকাচ্ছে। হুমায়ূন বলল, এখন ঘরে ফিরে যাই। ঝড় আসতে পারে। 
রাতটা কাটল হুমায়ূনের বাড়িতে। সকালে বের হলাম কুতুবদিয়া দ্বীপ দেখতে। আঁকাবাঁকা পথ ধরে হেঁটে চলছি। হুমায়ূন বলল, এই দ্বীপবাসীর জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন হলো ধান, লবণ আর মাছ। একটু পরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল। আশ্রয় নিলাম একটি দোকানের মধ্যে। প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট যেন ডুবে যাচ্ছে, এমনটিই মনে হলো। ভাবলাম এই বর্ষায় কুতুবদিয়া দ্বীপে না জানি ক’দিন আটকে থাকি। মণি, প্রদীপ এরাও এসে গেছে। প্রায় দুই ঘণ্টা পরে বৃষ্টি থামল। আবার বেরিয়ে পড়া। এবার বাজার হয়ে এলাম সাগরের কাছে। ওখানে কত না গাছপালা। প্রায় তিন ঘণ্টা বসেছিলাম আমরা চারজন। অথৈ সাগর দেখে কী যেন এক তৃপ্তি খুঁজে পেলাম। সারাটা দিনই চষে বেড়ালাম কুতুবদিয়া দ্বীপ। বিকাল ৪টা বাজতেই হুমায়ূনকে বললাম, ‘আজকে চলি।’ 
একটু হেসে হুমায়ূন বলল, আজকে থাকুন। দেখুন আকাশে কত যে মেঘ। এবার একটু গানের ভঙ্গিমায়, ‘বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো... আউশের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো, কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে...।’
ঘাটে এসে ওরা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠিয়ে দিলেন। নৌকা ছাড়তেই হুমায়ূন, প্রদীপ ও মণি হাত নেড়ে বলল, ‘আবার আসবেন কুতুবদিয়া দ্বীপে।’ বারবার ভাবছি, কুতুবদিয়া দ্বীপের কথা! আহা ওখানকার মানুষ কত না সহজ-সরল। চেনা নেই, জানা নেই—এক রাত রেখেছিলেন ওরা। ওপারে পৌঁছতেই দেখি প্রায় সন্ধ্যা। শুরু হলো বৃষ্টি। তখন বারবার মনে পড়লো, ‘আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, গেলরে দিন বয়ে। বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে’—কবিতার এই লাইনগুলো।
কুতবদিয়া দ্বীপে ৩ থেকে ৪ দিন সময় হাতে নিয়ে যাবেন। সড়ক পথে চট্টগ্রাম গিয়ে এর পরে আবার বাস ধরে আসুন পেকুয়া। তার পরে ইঞ্জিন চালিত নৌকোয় যাবেন কুতুবদিয়া দ্বীপে। এ ভ্রমণে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা নিয়ে গেলেই চলবে।----লিয়াকত হোসেন খোকন(ডিনিউজ)




শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়