Sunday, September 1

পটুয়াখালীতে ভূমিহীন জনগোষ্ঠির মানবেতার জীবন-যাপন

পটুয়াখালী:  তেঁতুলিয়া ও বুড়াগৌরাঙ্গ বেষ্টিত দক্ষিণার উপকূলীয় জেলার দশমিনা উপজেলা।  দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসরত প্রায় দেড় লাখ জনগোষ্ঠি এ উপজেলায় ৬টি ইউনিয়ন আর ছোট-বড় ১২টি চরাঞ্চল নিয়ে গঠিত।  যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুর্গম এ চরাঞ্চলে চিকিৎসাসেবা,শিক্ষাব্যবস্থাসহ মানুষের ন্যুন্যতম মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত এ অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠি। স্বাধীনতার চারদশকে কোন কিছুরই পরির্বতন ঘটেনি। তেঁতুলিয়ার  বুক চিরে জেগেওঠা চরাঞ্চলের মধ্যে চরহাদী, চরশাহজালাল, চরবোরহান, চরবাশবাড়িয়া, চরবোথাম, চরহায়দর, লালচরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৫০ হাজার বসতি। সরেজমিনে ঘুরে এসব চরে পাওয়া গেছে বিস্ময়কর তথ্যচিত্র।
খাদ্য সংকট:
মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এসব চরাঞ্চলে নেই কোন খাদ্যের নিশ্চয়তা। ১৯৮২ সালে ভূমীখাদকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রতিকূল পরিবেশে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ কৃষক ও কৃষাণী ফেডারেশনের ডাকে এসব চর ভূমিহীনদের দখলে আসে। বহু সন্তানের জনক-জননী হয়ে বসবাসরত বসতীর মধ্যে স্বল্প পরিসরের ভূমিতে ধান ফলানোর উপর নির্ভর করতে হয় যাবতীয় চাহিদা মিটাতে। অভাব অননের সংসারে অর্থ জমানোর বিপরীতে ধার-দেনা করে দিনাতিপাত করছে এসব চরাঞ্চলের মানুষের। মৌসুমে ধান বিক্রি করে ভাল ভাবে বছরের শুরু করলেও  (অতিবর্ষা) বর্ষামৌসুমে অর্ধাহার-অনাহারে মানবেতার জীবন-যাপনে অভঅস্ত  এসব মানুষেরা। চরবাঁশবাড়িয়ার কৃষক আলমগীর বলেন, বর্ষামৌসুমে খাদ্য সংকট থাকায় অনেকেই গতরে খাটুনি দিতে মূল ভূখন্ডের লোকালয়ে চলে যায়। অথচ এ সময়টাই চাষাবাদের মোক্ষম সময়। এছাড়াও বনা জলোচ্ছাসের পরে প্রতিবছরই দু'দিন থেকে এক সপ্তাহ কোন খাবর জোটেনা মহিলা শিশুসহ বৃদ্ধা-বৃদ্ধদের। 
বস্ত্র সংকট:
চরাঞ্চলের ভূমিহীন কৃষকরা ধানের মৌসুমে পরিবার পরিজনের জন্য বহুল প্রয়োজন ভিত্তিক পোষক-পরিচ্ছধ সংগ্রহ করে থাকে। অনেক কৃষকদের দেখা যায় একটি লুঙ্গি, গামছা, গেঞ্জি আর মহিলাদের একটি শাড়ি আর প্রয়োজনীয় পরিধান রয়েছে। কোন রকম টেনে-হিচড়ে পার করতে হয় বছর। চরবোরহানের আলোয়া বেগম বলেন, নতুন কাপুর কেনলে বেড়াইতে যাওয়ার লাইগ্গা রাইক্কা দেই। পুরানডা পর্ইরা ক্ষ্যাত খামারের কাম করি। বেশি লাগলে কেডা দেবে আমাগোরে ভালমোন্দ কাপুর।
অপ্রতুল বাসস্থান: চরাঞ্চলের বসতিদের টোংঘর কিংবা দোচালা ঘরে বসবাস করতে দেখা গেছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ সময়ে এসব ঘর সহজেই ভাষিয়ে নিয়ে যায় কিংবা ধ্বসে যায়। আর এর সাথে হাড়িয়ে যায় বছরে চলার সকল আন্তবস্তু। বন্যা ও জলোচ্ছাসে অতিঝুকিপূর্ণ বাসস্থানে বসবাস করে এসব চরের মানুষ। চরবোরহানের শাহজামাল বলেন, “চরে য্যাপো ঘরে মর্দ খাটুইন্না ব্যাটা বেশি হ্যাগো দু'একটা টিনের ছাউনি হইছে, নিজেগো হালের বলদ হইছে। তয় বইন্নায় থাহুন্না কোন জাগা নাই এই সোমায় আল্লাই মোগও ভরষা”।
শিক্ষা ব্যবস্থাহীন: প্রায় ৫০ হাজার বসতির এসব চরে নেই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করলেও এসব চরাঞ্চলের ৫ম শ্রেনী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত প্রায় ১১ হাজার শিশু। প্রাথমিক শিক্ষার সূযোগ না থাকায় চরাঞ্চলের ৫ হাজার শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিশুরা শিক্ষার সূযোগ না পেয়ে হালচাষ, মাছধরা, পাতাকাটা ও মহিষের পালকসহ বিভিন্ন ঝুকিপূর্ন ও গ্রাম্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে থাকে। চরশাহজালালের আনছার মিয়ার সাথে কথা বলেন, “আমাগো চরে কয়েকটা স্কুল হইছে এসব স্কুলে কোন মাষ্টার বা ছাত্রছাত্রী নাই। তয় য্যারা করছে আমাগোরে যানাইছে সরকারে অনুমতি দিয়া বেতন দিলে স্কুল চালাইবে। আবার কিছু যাগা আমাগোরে দিয়া নিছে যেহানে কোন স্কুল অয়নাই, তয় অনেকে কয় নিশ্চিহ্ন এই স্কুলে নাকি ম্যোলা  ছাওয়াল ভর্তি অইয়া ক্লাস করে আর শিক্ষ নেবে”। অপরদিকে, বসতিদের সাথে কথা বলে ও বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে, এসব চরে কোন প্রকার ক্যাচমেন্ট এরিয়া জড়িপ বা বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা জড়িপ চালানো হয়না। এ চরাঞ্চলে একাধিক কুচক্রিমহল নামে বেনামে স্কুল  প্রতিষ্ঠা দেখিয়ে কোন ছাত্রছাত্রী বা স্কুল প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ছাড়াই অনুমোদনের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসারের গন্ডি পেড়িয়ে মন্ত্রনালয় অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবায় বঞ্চনা: একটি বেসরকারী সংস্থার জরিপে দশমিনার চরাঞ্চলে ৫০ হাজার ভূমিহীন ও ছিন্নমূল মানুষ বসবাস করে। এসব মানুষ স্বাস্থ্য সেবা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত রয়েছে। বিভিন্ন রোগ বালাইতে ওঝা, ফকিরের ঝার-ফু পানি পড়ার ওপর র্নিভর করে জীবনের ঝুকি নিতে হচ্ছে। এছারা জরুরী ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা নিতে তেতুলিয়া/বুড়াগৌরাঙ্গ নদী পাড়ি দিয়ে উপজেলা হাসপাতালে পৌছতে নৌকা যোগে ৭/৮ ঘন্টা এবং  ট্রলার যোগে ২/৩ ঘন্টা সময় লাগে ততক্ষনে রোগী  মৃত্যুর কোল ঢলে পরার অহরাহ ঘটনা শোনা গেছে। এছারা চরাঞ্চলে অশিক্ষিত মানুষ যানেনা জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি। হাত বাড়ালে না  পাওয়া জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি।ফলে দিন-দিন বাড়ছে জনসংখ্যার হার। 
যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন: এসব চরে যোগাযোগ ব্যাবস্থা না থাকায় চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে চরাঞ্চলের মানুষকে। এখনো কোন সড়ক, পুল গড়ে উঠেনি এসব চরে। নদীর পাড় বা ফসলি জমির মধ্য দিয়ে যাতায়ত এ জনবসতিদের। ছোট বড় খাল দিয়ে বিচ্ছিন্ন চরগুলোতে সাতাঁর কাঁটা আর ছোট নৌকাই ভরষা।
পানীয় জলের অভাব: চরাঞ্চলে  পানীয়-জলের চরম অভাব লক্ষ্য করা যায়। খাল বা নদীর পানি ফিটকিরি দিয়ে পান করতে দেখা গেছে। হাতে গোনা কয়েকটি টিউবওয়েল বন্যা, জলোচ্ছাস আর যতেœর অভাবে দীর্ঘদিন রয়েছে অকেজো। তাই নদী বা খালের পানিই তাদের এক মাত্র ভরসা। 

অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার ও বাল্য বিয়ে এবং কু-সংস্কার: গণসচেতনতার অভাবে চরাঞ্চলে বাল্য বিয়ে ক্রমশই বাড়ছে। চরাঞ্চলের  মানুষের ধারনা কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলে ছেলে পক্ষের কাছে মেয়ের সমাদর থাকে। তাই ১০/১২ বছর বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগে তার পরিবার। প্রতিটি ঘরেই দেখা মেলে কিশোরী বধুর। কম বয়সে সন্তান ধারণ ও অধিক সন্তান অধিক আয় ভিত্তিক ধারণার কারণে জনসংখ্যা বাড়ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। চরাঞ্চলের মানুষেরা মনে করেন,কন্যা সন্তানকে স্কুলে পাঠাবার দরকার নাই। কারন এরা ঘরের বাহির হলে বদনাম হয়। এরই পেক্ষিতে পিয়ারা খাতুন বলেন, “আমাগো পরা ল্যাহার কাম কি ল্যাহা পরা করলে কেউ টাহা দেয়না। কাম করলে ম্যালা টাহা হয়”। এরই ফল¯্রুতিতে তার দুই কন্যা আম্বিয়াও রিজিয়াকে বিদ্যালয়ে পাঠাইনি। মায়ের হাত কাজ করে অন্যলোকের ফসলি জমিতে। তিনি আরো বলেন মাইয়া জন্মায় পরের ঘর করোনের লইগ্যা। এভাবেই চরাঞ্চলের প্রতিটি ঘরের মানুষ আটকে আছে কু-সংস্কারের বেড়াজালে। 

 বন্যা, জলোচ্ছাস ও ফসলহানি: চরাঞ্চলে কোন প্রকার  বেঁড়িবাধ না থাকায় বন্যা ও জলোচ্ছাসের সময় সহজেই প্লাবিত হয় এ অঞ্চল।প্রতি বছর দক্ষিণা উপকুলে বয়ে যাওয়া একের পর এক বন্যা, জলোচ্ছাস ও অতিবৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক দূর্যোগে ঘটে প্রাননহানী। এছাড়াও রয়েছে ব্যাপক ফসলহানির ঘটনা। ফসলহানির কারণে মাঝারি কৃষকে পরিনত হওয়া কৃষকরা পূণঃদরিদ্রতার কষাঘাতে দিনাতিপাত করে।

ভূমি দালাল ও খাদকদের দৌরাত্ব্য: চরাঞ্চলের ভূমিহীনরা নিজভূমে পরবাসে দিনাতিপাত করছে। দীর্ঘ ২৩/২৪বছরেও প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে খাসজমি স্থায়ী বন্দোবস্ত না হয়ে রাজনৈতিক, ভুমিদস্যু ও ঘুষ দূর্ণীতির বিনিময়ে সচ্ছল পরিবারের মধ্যে বন্দোবস্ত হয়ে আসছে। আর ভূমিহীনরা থেকে যাচ্ছে বঞ্চিত। খাস জমি চাষাবাদ করে ঘরে ধান তোলার মৌসুমে যোদ্ধা-লাঠিয়ালদের কর্তৃক ফসল লুটের ঘটনা ঘটছে  প্রতিমৌসুমে।----ডিনিউজ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়