Thursday, September 19

বিছনাকান্দি: জল-পাথর আর মেঘপাহাড়ের হাতছানি

:: রাশেদীন ফয়সাল ::
আকাশে শরতের দলছুট মেঘেদের ছোটাছুটি, ওপারে সারি সারি পাহাড় আর পাহাড়ের বুক চিরে পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ সবুজ জলে ভেসে ওঠা লাবণ্যপূর্ণ প্রাকৃতিক জলছবিই বলে দেবে এটা বিছনাকান্দি। যেখানে বড় বড় পাথরের ফাঁকে স্বচ্ছ জলের শক্তিশালী মায়া স্রোত আর সেই স্রোতের বুকে গা ভিজিয়ে রোমাঞ্চকর অনুভুতি আপনাকে দিতে পারে সাগরের ঢেউ খেলানো আনন্দ। পুরো সীমান্ত এলাকাই যেন এক মায়াবী সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি।

এখানে দাঁড়িয়ে দেখতে পাবেন এপাড়ের প্রকৃতি যেন ওপাড়ের পাহাড়ের সাথে মিতালী করছে গভীর মমতায়। কিন্তু সীমান্তহীন মেঘনীল আকাশ এখানে বড় উদার, নিজেকে মেলে ধরেছে উজাড় করে। সেই আকাশে সাদা বকেরা উড়ে যাচ্ছে নীলিমার খোঁজে, ছায়া দেখা যায় পিয়াইনের সবুজ জলে। রয়েছে পাথর আহরণের সারি সারি নৌকার ঝাঁক, সীমান্তবাসীরা এই পাথরের বোঝাই থেকেই জীবন চলার পাথেয় আহরণ করেন।

নদীর দু’পাড়েই বালিয়াড়ী হাঁসের ঝুপঝাপ-লাফালাফি, বিবাগী বাতাসে উদ্ভাসিত কলমী ফুলের হাসির ফাঁকে হঠাৎ চোখে পড়তে পড়ে কোন পল্লীবালা স্নান শেষে কলসী কাঁখে জল নিয়ে যাচ্ছে, আপনাকে দেখে সে লজ্জায় লাল হবে, আঁচল টেনে মুখ ঢাকবে। এখানে সারাদিন কেটে যায় গাঁয়ের দুষ্ট ছেলেদের পিয়াইনের বুকে সাঁতার কেটে। নদীর পাড়ে ধানের তে যেন ঢেউ খেলে যায় অবারিত সবুজের গালিচায়। এমন সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আপনার মন আনমনে গেয়ে উঠবে “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি / সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি”...

অপার সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি সিলেটের প্রান্তিক জনপদ গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা বিছনাকান্দির প্রকৃতি যেন তার রূপ মেলে ধরেছে আরো উদার করে। বাংলাদেশ ও ভারতের মিলনস্থল এই এলাকার কিছু অংশ না-মানুষী এলাকা (নো-ম্যানস্ ল্যান্ড) হিসেবে পরিচিত।

সেই প্রকৃতির মাঝে অবগাহন করতে ভ্রমণপিপাসু সিলেট ভিউ পরিবার গত ১৩ সেপ্টেম্বর ঘুরে এলো জল-পাথররাজ্য নামে খ্যাত বিছনাকান্দিতে। জিন্দাবাজারস্থ নেহার মার্কেটে সিলেট ভিউ অফিসের সামনে পূর্ব নির্ধারিত সকাল ৯টায় সবাই এসে উপস্থিত হন। দু’টি গাড়ি করে আমরা ছুটে চললাম জল-পাথর আর মেঘপাহাড়ের খোঁজে। সিলেট শহর থেকে বের হয়েই দেখা যায় সবুজের আস্তরে ঢাকা আঁকাবাঁকা পথ। যতই এগিয়ে চলেছি ততই সহযাত্রীরা ভোগছেন সীমাহীন আনন্দে। শুধু আনন্দে ভাটা পড়তো তখনই যখন জীর্ণ-ভঙ্গুর রাস্তার হেচকা টান পড়তো।

ঘন্টা খানিক চলার পর আমাদের গাড়ী থামলো গোয়াইঘাটের বঙ্গবীর এলাকার খাইরাই-এ। সিলেট ভিউ’র অন্যতম শুভাকাঙ্খী ও সিলেটের জনপ্রিয় কলামিস্ট জিবলু ভাই’র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জান্নাত ট্রেডিং এর সাইট অফিসের সামনে। জিবলু ভাইসহ অফিসের কর্মকর্তারা ভ্রমণযাত্রীদের অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁদের উষ্ণ ও আন্তরিক আতিথেয়তায় আমরা সকালের নাস্তা সারলাম। দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণও আমাদের গ্রহণ করতে হলো। নাস্তা পর্ব শেষ হতেই পীরেরবাজারের উদ্দেশ্যে আবারও গাড়ী চলতে শুরু করলো। ২০ মিনিট পর আমরা পৌঁছে গেলাম পীরেরবাজার।


বিছনাকান্দি যেতে হলে পীরেরবাজার থেকে নৌকায় যেতে হবে। যথারীতি আমরাও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে বসলাম। মাথার উপর প্রচন্ড রোদের মধ্যেও সিলেট ভিউ সম্পাদক নবেল ভাইয়ের দুই মেয়ে শ্যামা ও মৌমীকে প্রথম নৌকাভ্রমণে বেশ উচ্ছসিত মনে হলো। অনেকদিন পর নৌকাযাত্রী হয়ে বাকীরাও যে যার মতো আনন্দ করতে লাগলেন। কেউবা নৌকা থেকে হাত বাড়িয়ে পিয়াইন নদীর পানির সাথে দুষ্টুমি করতে লাগলেন।

সিলেট ভিউ’র আলোকচিত্রী সুজন ভাইয়ের ক্যামেরাও থেমে নেই। একের পর এক ক্লিক করে পিয়াইন নদীসহ তার আশপাশকে বন্দি করতে লাগলেন তার ক্যামেরায়। সবাই তখন সুজন ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যস্ত, এমন মায়াময় প্রকৃতিতে নিজের একটি হলেও ছবি তোলার তাগিদ অনুভব করতে লাগলেন। নিবেদিতপ্রাণ সুজন ভাইও কাউকে নিরাশ করেননি, নৌকাপথের সময়টা তিনি ছবি তোলেই আনন্দ করতে লাগলেন।

ঘন্টাখানিকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত সীমান্তের কাছাকাছি বিছনাকান্দিতে। নৌকা থেকে নামার আগেই অনেকে কাপড় বদলাতে লাগলেন। আমরা ছুটতে লাগলাম না-মানুষী সীমানায়। কিছুদুর হেঁটে গিয়েই অনেকেই নিজেকে সঁপে দিলেন অবারিত আনন্দের ফটিক জল-পাথর আর ক্ষীপ্র স্রোতের শীতল বুকে। দীর্ঘণ রোদে পুড়ার পর সীমাহীন উচ্ছাসে ঝাঁপাঝাঁপিতে মত্ত হলেন সিলেট ভিউ পরিবারের সদস্যরা। বড় বড় পাথরের মাঝ দিয়ে স্রোত ভেসে আসছে উজানের দেশ ভারত থেকে। এই স্রোতের সাথে ভেসে আসে পাথর।

বিছনাকান্দির পানিতে নামতে হলে আপনাকে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ভারত থেকে আসা স্রোতের বেগ এতো বেশী ক্ষীপ্র থাকে যা স্বচ্ছ জলের জন্য ডাঙ্গায় থেকে পরিমাপ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এজন্যই না বুঝে নেমে পড়লে প্রচন্ড স্রোতের বেগ আর পাথরের ফাঁকে পড়ে গিয়ে মারাত্মক দূর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। এজন্য হালকা কাপড় (সুইমিং কষ্টিউম) নিয়ে নামতে পারেন। আমরাও সাবধানী পা দিয়ে ধীরে ধীরে পানিতে নেমে পড়লাম। জল খেলায় মেতে উঠলেন সবাই। বিছনাকান্দির জলখেলা দেখলে মনে হয় এটা কোন সমুদ্র সৈকতের ছবি।

সাংবাদিক ওহি আলম রেজা ভাই কিছুটা অসুস্থ থাকায় প্রথমে নামতে চাইলেন না, কিন্তু সবার উচ্ছ্বাস দেখে তিনিও হাঁটু ভেজালেন। সাথে নামলেন জিবলু ভাই। নবেল ভাই’র স্ত্রী অর্থ্যাৎ আমাদের প্রিয় ভাবী পাড়ের একটা পাথরে বসে মৌমীকে পানিতে দোল খাওয়াচ্ছেন। প্রচন্ড স্রোতের বেগ এক বিন্দু ভয় জাগাতে পারেনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া শ্যামাকে। বরং সে তার মায়ের সাবধানী চোখকে ফাঁকি দিয়ে বড় একটা পাথরে হেলান দিয়ে পানিতে বসে রইল।

আমি সুজন ভাই, মিসবাহ ভাই স্রোতের মাঝে পড়ে পাভেল ভাইয়ের উদ্দেশ্যে চিৎকার শুরু করলাম ছবি তোলার জন্য। বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী পোষাক লুঙ্গী পরে পানিতে নামায় সবার দৃষ্টি থাকে নবেল ভাই ও পাভেল ভাই এর উপর। কারণ এর আগে দুজনের কাউকেই লুঙ্গী পরিহিত দেখা যায়নি। সাত্তার বেশীণ পানিতে থাকতে পারলো না তার পায়ের তের জন্য।

দেবু’দা স্রোতের সাথে পেরে উঠতে পারেননি, পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে হাতে চোট পান, তাতেও তিনি অখুশি নন বরং আরো কিছুণ পানিতে থাকার আবেদনও করেন, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা সেই আবেদন খারিজ করে দেয়।

দুই ঘন্টা পানিতে বিছনাকান্দির জল-পাথরের সাথে থাকা, অনেকাংশে অপূর্ণই বলা যায়। তবুও ফিরতে হবে। মাঝির নৌকা ছেড়ে হাল ধরে বসে রইলেন। একটু আগে ঘটে যাওয়া টুকরো টুকরো স্মৃতি নিয়ে সবাইকে বেশ উল্লাসিত মনে হলো। চোখে-মুখে সারাদিনের কান্তির ছাপ থাকলেও বিছনাকান্দির জল যেন সব ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে। আকাশে তখনও দুর্দন্ড প্রতাপে রৌদ্রদেব বিরাজমান। প্রখর রৌদ্রের তেজ প্রায় সবাইকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে।

দুইবছর বয়েসী মৌমী তো কান্নাকাটি শুরু করলো। নৌকাযাত্রায় অর্ধেক আসার পর স্থানীয় বাজার থেকে ঠান্ডা পানীয় নেয়া হলো। সবার মধ্যে যেন নতুন করে প্রাণ সঞ্চারিত হলো ঠান্ডা পানীয়ের বদৌলতে। যাত্রাবিরতি শেষে যথারীতি নৌকা চলতে শুরু করলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পীরেরবাজারে ফিরে এলাম। মাঝির কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের গাড়ী চললো জিবলু ভাইয়ের অফিসের উদ্দ্যেশে। সেখানে আমাদের জন্য দুপুরের খাবার অপো করেছ। ক্ষুধার্ত থাকায় হুড়হুড় করে সবাই গাড়ী থেকে নেমেই খেতে বসলাম। চমৎকার এবং মজাদার সব আয়োজন ছিল খাবারে। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন সবাই। এমন আয়োজনের জন্য সবাই জিবলু ভাইকে অভিনন্দিত করলেন।

খাওয়া দাওয়া শেষে বাড়ী ফেরার জন্য চলতে থাকলো আমাদের গাড়ী। পরম তৃপ্তির নিয়ে বাড়ী ফিরছে আর পেছনে পড়ে রইলো উচ্ছ্বাসময় একটি দিনের স্মৃতিবিজড়িত বিছনাকান্দি।


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়