Monday, September 2

নোবেলজয়ীকে হেয় করে জাতিকে ছোট করবেন না

ঢাকা : সরকারদলীয় নেতা ও মন্ত্রীদের উদ্দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক তাহসিনা খাতুন বলেছেন, দেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হেয় করে জাতিকে আর ছোট করবেন না।সোমবার এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান।

বিবৃতিতে তিনি বলেন, “দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ীকে জনসমক্ষে তার সম্মান নষ্ট করার অপচেষ্টা জাতি হিসেবে আমাদের নিজেদেরকে ছোট করা- তা বোঝার ক্ষমতাও বোধ হয় তার সম্পর্কে কটূক্তিকারী নেতা-মন্ত্রীদের নেই। আমরা এই নেতা-মন্ত্রীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, জাতিকে আর ছোট করবেন না। দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলো সমাধানের প্রতি মনোযোগী হোন, নইলে দেশের মানুষ আপনাদের ক্ষমা করবে না।”

তাহসিনা খাতুনের বিবৃতিটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

“সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে ক্ষমতাসীন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতার কিছু আক্রমণাত্মক বক্তব্য বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্র-পত্রিকা মারফত আমরা জানতে পেরেছি। গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৪ লাখ সদস্যের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে এ ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিষোদগারমূলক বক্তব্য বিষয়ে কিছু বলাটা আমরা দরকারি মনে করছি।

একজন মন্ত্রী জনসভায় বলেছেন, ড. ইউনূস নাকি সুদখোর এবং মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। উল্লেখ্য, দেশের বর্তমান সরকারপ্রধানও ইতিপূর্বে ড. ইউনূসকে আকারে-ইঙ্গিতে সুদখোর বলেছেন। কিন্তু ড. ইউনূস তো ব্যাংকের মালিক নন, তাহলে তিনি সুদখোর হলেন কীভাবে? সুদ খেলে মালিকরা খেতে পারেন। সে হিসেবে সরকারই বরং তার অংশ নিচ্ছে।

তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক, পিকেএসএফ, গ্রামীণ ব্যাংক রিভিউ কমিটি- সকলেই এই মত ব্যক্ত করেছে যে, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকই সবচেয়ে কম সুদ নিয়ে থাকে। মন্ত্রী মহোদয় নিশ্চয়ই এটা জানেন। এরপরও ড. ইউনূস সম্পর্কে এ ধরনের সস্তা বক্তব্য যে একান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বলার বলার অপেক্ষা রাখে না। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস বিষয়ে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর তদন্ত করেছে ও করছে এবং এ পর্যন্ত মানি লন্ডারিং, অর্থ আত্মসাৎ বা তহবিল অপব্যবহার জাতীয় কোন অনিয়ম তারা খুঁজে পায়নি। গ্রামীণ ব্যাংক বা ড. ইউনূস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘গ্রামীণ’ নামের কোনো কোম্পানিতে ড. ইউনূসের কোনো শেয়ার বা অংশীদারিত্বও নেই। এরপরও জনসভায় এ ধরনের কথা বলাটা ড. ইউনূস সম্পর্কে ব্যক্তিগত বিষোদগার ছাড়া আর কিছু নয় বলে আমরা মনে করি।

সরকার সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচন বিধি পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান পরিচালক নির্বাচনী বিধি দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্যাংকের ৮৪ লাখ সদস্যের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে আসছে এবং ব্যাংকের জন্য একটি কার্যকর, দায়িত্বশীল ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। সরকার নতুন যে নির্বাচনী বিধি চালু করতে চাচ্ছে তাতে গ্রামীণ ব্যাংকে শুধু রাজনীতিই নয়, দুর্নীতিও ঢুকবে- ধ্বংস হয়ে যাবে এই ব্যাংক। আমরা এই প্রস্তাবিত নির্বাচনী বিধির তীব্র বিরোধিতা করছি এবং এটা কার্যকর না করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

একজন মন্ত্রী বলেছেন, ড. ইউনূস রাজনীতিবিদ, তবে রাজনীতিবিদের পোশাক পরেন না। মন্ত্রীর কথায় মনে হচ্ছে, এদেশে দু’ধরনের মানুষ আছেন, যারা রাজনীতি বিষয়ে কথা বলতে পারবেন ও যারা রাজনীতি বিষয়ে কথা বলতে পারবেন না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং দেশ পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়ে কথা বলার অধিকার যেকোনো নাগরিকের আছে। মন্ত্রী জণগণের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি করেছেন তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং এটা জনগণ সম্পর্কে তার উন্নাসিক ও নেতিবাচক মনোভাবই প্রকাশ করে।

অপর একজন মন্ত্রী বলছেন, ড. ইউনূস নাকি খানকাহ শরীফ খুলে বসেছেন, হেকিমি দাওয়াই দিচ্ছেন। এখন থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে বাংলাদেশের এক কোণে এক অজপাড়াগাঁয়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে ড. ইউনূস গ্রামের দরিদ্র মানুষদের সংগঠিত করেছেন। গ্রামের বাজারে, চায়ের দোকানে গরিব মানুষদের সঙ্গে মিটিং করেছেন, গরিব মহিলাদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের সমস্যার কথা শুনেছেন, সমাধানের উপায় খুঁজেছেন। কোথাও কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখলে ছুটে গেছেন। তারই পরিণতি আজকের এই গ্রামীণ ব্যাংক। রাজধানীতে সুরম্য অট্টালিকায় শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কক্ষে মিটিং করে গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম হয়নি, যার মডেল আজ পৃথিবীর প্রায় সব দেশে অনুসরণ করা হচ্ছে। ড. ইউনূসের ‘হেকিমি দাওয়াই’ ছাড়া নোবেল বিজয়ী এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম হতো না।

সম্প্রতি ড. ইউনূস বলেছেন, নির্দলীয় সরকার ছাড়া এই মুহূর্তে দেশে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। তার এই বক্তব্যকে ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো মন্ত্রী মহোদয় সরকার-বিরোধিতা, সংবিধান-বিরোধিতা, এমনকি রাষ্ট্র-বিরোধিতা বলে তাকে জেলে পাঠানোরও সুপারিশ করেছেন! এই মন্ত্রী মহোদয়েরা জানেন না বা জানতে চান না যে, দেশের অধিকাংশ মানুষের মতামতই ড. ইউনূসের কথায় প্রতিফলিত হয়েছে।

একজন মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, ড. ইউনূস জাতির কোনো দুর্যোগে কখনো এগিয়ে যান না। শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধে যান না। তিনি রানা প্লাজায়ও যাননি। আমরা অবাক হয়ে যাই মন্ত্রী-মহোদয়ের অপপ্রচারে। ড. ইউনূস আজীবন ব্যক্তিগত প্রচার এড়িয়ে চলেছেন। শহীদ মিনার ও স্মৃতি সৌধে তার ছবি অনেকেই দেখেছেন, পত্রিকায়ও এসব ছবি ছাপা হয়েছে। দেশের প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় তার ও তার গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান আছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পরই তিনি সেখানে ত্রাণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণের জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। তার লেখা প্রবন্ধ দেশে ও বিদেশের পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি আন্তর্জাতিক উদ্যোগও সৃষ্টি করেছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের এই মন্ত্রীরা এসব চোখে দেখেন না, অথচ বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য ড. ইউনূস যখন কথা বলতে গেলেন, তখন তারা তাকে ‘রাজনৈতিক, ‘দলীয়’, এমনটি ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বানিয়ে ফেলতেও কুণ্ঠা বোধ করলেন না!

কোনো কোনো মন্ত্রী মহোদয় বলছেন, ড. ইউনূসের জন্য নাকি এদেশে বিদেশি সাহায্য আসছে না, তার জন্য নাকি পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেছে। কোন কারনে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে বিরত হলো, সে ‘আবুল কাহিনী’দেশের কার না জানা আছে। তারপরও ড. ইউনূসের কাঁধে দায়িত্ব চাপানোর যে চেষ্টা সেটা যে খুবই অসহায় চেষ্টা, তা বুঝতে কারো দেরি হয়নি।

ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক তৈরি করে এদেশের লাখ লাখ দরিদ্র পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং এদেশের লাখ লাখ দরিদ্র নারীর ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত করেছেন। তার গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য এদেশ নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছে। তার সম্পর্কে কোনো কটূক্তি বা তার বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং আমরা এদেশের নারী সমাজের পক্ষ থেকে এর তীব্র বিরোধিতা করছি। দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ীকে জনসমক্ষে হেয় করার, তার সম্মান নষ্ট করার অপচেষ্টা যে   প্রকারান্তরে জাতি হিসেবে আমাদের নিজেদেরকে ছোট করা - তা বোঝার ক্ষমতাও বোধ হয় এসব নেতা-মন্ত্রীদের নেই। আমরা এই নেতা-মন্ত্রীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, জাতিকে আর ছোট করবেন না। দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলো সমাধানের প্রতি মনোযোগী হোন, নইলে দেশের মানুষ আপনাদের ক্ষমা করবে না।”---ডিনিউজ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়