Friday, August 23

ফেনীতে ইয়াবার ভয়ংকর বিস্তার

ফেনী: অভিজাত নেশাদ্রব্য হিসেবে পরিচিত ইয়াবার ব্যবহার ফেনীতে আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। মাদক বিক্রেতাদের নাম পরিচয় সবার কাছে ওপেন সিক্রেট হলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর এক শ্রেনীর অসাধু কর্মকর্তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ও রয়েছে। এতে শুধু অভিভাবকরাই নয় বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যদের মাঝেও উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ও অস্বস্থি বিরাজ করছে। বিশেষ করে রাজধানীর চামেলীবাগে মর্মস্পর্শী ঘটনার পর ইয়াবা তথা মাদক নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে উঠেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর, পুলিশ সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ফেনী শহরের অন্তত ৩০ টি স্পটে প্রতিদিন বিপুল পরিমান ইয়াবা কেনাবেচা হচ্ছে। শহরের মাষ্টার পাড়া, পেট্টোবাংলা, সহদেবপুর, দাউদপুর ব্রীজ, কানন সিনেমা হল, রেলওয়ে ষ্টেশান, রাজাঝি দীঘির পাড়, সদর হাসপাতাল মোড়, বিরিঞ্চি, ফারুক হোটেল, রামপুর, তাকিয়া রোড, মহিপাল শাহীন হোটেল, বাস টার্মিনাল, পাগলা মিয়া সড়ক, বিজয়সিংহ দীঘির পাড়, লালপোল, ফতেহপুর রেলক্রসিং সহ উল্লেখিত স্থানসমূহের আশপাশের এলাকায় সহজেই ইয়াবা মিলছে। এছাড়া জেলা শহরের বাইরেও উপজেলা সদর ও গ্রামের হাট-বাজারে পৌছে গেছে মরণ নেশা ইয়াবা। একটি সরকারি সংস্থার দেয়া তথ্য মতে, যেসব স্থানে মাদক দ্রব্য কেনাবেচা হয় সেখানে এখন ইয়াবাও পাওয়া যাচ্ছে। তারা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ইতিমধ্যে শহরের ২০ জন পাইকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকা জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ওই সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মতে, ফেনীতে গত এক বছরে ইয়াবার বিস্তার ঘটেছে আশংকাজনক হারে। ইয়াবা উদ্ধারে র‌্যাবের কিছু সাফল্য থাকলেও অপরাপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উল্লেখযোগ্য সফলতা দেখাতে পারছে না। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অনেকেই রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় প্রশাসনের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
সবশেষ গত মঙ্গলবার শহরের ট্রাংক রোড থেকে র‌্যাব ১শ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। আগেও এর আশপাশ থেকে র‌্যাব ইয়াবা উদ্ধার করলেও নিকটস্থ ফেনী মডেল থানা পুলিশ ছিল বেখবর। তবে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের অসহায়ত্বের নানা চিত্র। এর মধ্যে সরকার দলীয় হস্তক্ষেপকে প্রধান কারণ বলে তারা উল্লেখ করেন। এছাড়া আকারে ছোট ও বহন সহজসাধ্য হওয়ায় পুলিশ বিভিন্ন সময় চেষ্টা করেও এদের ধরতে পারেনি বলে তারা জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল ফোনে নির্দেশনার মাধ্যমে নির্দিষ্ট জায়গায় খুচরা বিক্রেতারা ইয়াবা সেবীদের কাছে চাহিদা অনুযায়ী পৌছে দেয়। এক্ষেত্রে শহর এলাকায় তাদের নির্ধারিত কিছু রিক্সা চালকও রয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ফেনী একদিকে প্রবাসী অধ্যুষিত অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেললাইনের পাশে হওয়ায় যোগাযোগ সুবিধা রয়েছে। এ সুযোগ নিয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা অল্পদিনে এখানে বিশাল বাজার গড়ে তুলেছে। ফেনী শহরের বেশিরভাগ আবাসিক হোটেলে ইয়াবা কেনাবেচা হয় বলে গোয়েন্দা সূত্রের কাছে তথ্য রয়েছে। টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম হয়ে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস অথবা যাত্রীবাহী বাস যোগে ফেনীতে পৌছে যায় বহুল আলোচিত এ মাদক। ফেনীতে ২শ’ থেকে ৬শ’ টাকার মধ্যে মিলে প্রতি পিস ইয়াবা। আর সেভেন, শম্পা সুপার, ডব্লিউ ওয়াই ও জিপি ব্র্যান্ডের ইয়াবা ফেনীতে বেশী কেনাবেচা হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক দাম জিপির। এটি ৫শ থেকে ৬শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। অপরদিকে শম্পা সুপার পাওয়া যায় ২শ থেকে ২শ ৫০ টাকার মধ্যে। গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, ইয়াবা সহজলভ্য হওয়ায় হেরোইন ও ফেনসিডিল আসক্তরা এখন উচ্চমাত্রার উত্তেজক মাদকদ্রব্য ইয়াবার প্রতি ঝুঁকছে। সাধারণত ৪ থেকে ৫মি.মি. ব্যাস এবং আড়াই থেকে তিন মি.মি পুরো গোলাকৃতি ট্যাবলেট আকারে এটি তৈরী হয়। দেখতে অনেকটা ছোট আকারের ক্যান্ডির মতো। এর রঙ লালচে, কমলা কিংবা সবুজাভ। এটি আঙ্গুর, কমলা, ভ্যানিলা ইত্যাদি বিভিন্ন স্বাদ ও গন্ধের হয়ে থাকে। এ কারনে কোমলমতি শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের শক্তিদায়ক ক্যান্ডি বলে বিভ্রান্ত করে মাদকাসক্তরা সহজেই ইয়াবা ধরিয়ে দেয়। এর ব্যবহারে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা যেমন শারিরিক ও মানসিকভাবে এমন এক জগতে অবস্থান করে যেখানে বেদনা, ক্ষুধা, ক্লান্তি ও অবসাদ থাকে না তেমনি একধরনের অতি মানবিক শক্তি ভর করে। এ কারণেই দিনদিনই এর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এছাড়া বিক্রেতারাও অন্য মাদকের চেয়ে অধিক লাভের আশায় নিত্যনতুন কৌশলে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
অভিযানের নানা অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, বহনকারীরা অর্থের লোভে ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করে না। কিছুদিন আগে গোপন সূত্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ফেনী রেলওয়ে ষ্টেশনে সন্দেহভাজন এক রেল যাত্রীকে ডিবি পুলিশ তল্লাশী চালিয়ে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে নিশ্চিত হয়ে ওই যাত্রীকেই লাকসাম ষ্টেশানে নামিয়ে পায়ুপথ থেকে ১শ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। একইভাবে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে মোবাইল সেটের মধ্যে এমনকি সিগারেটের ফিল্টারেও এটি সরবরাহ করা হয়। তবে দূরবর্তীস্থানে বহনের জন্য নারীদেরকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অঙ্গে বহন করায় পুলিশ অভিযান চালিয়েও ফল হয়না। পুলিশের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, যেখানে প্রতিদিন শহর এলাকায় অন্তত দুই থেকে তিন হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট কেনাবেচা হয় সেখানে চলতি বছরের বিগত প্রায় আট মাসে র‌্যাব ও পুলিশের পৃথক অভিযানে ৫ হাজারের বেশি উদ্ধার হয়নি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের ফেনীস্থ পরিদর্শক আবু বকর ছিদ্দিক জানান, অনেক সময় তথ্য পেয়েও প্রয়োজনীয় জনবল ও পরিবহন সংকটের কারনে ইয়াবা উদ্ধার সম্ভব হয় না। সর্বশেষ মঙ্গলবারও একই কারনে ফেনী রেলওয়ে ষ্টেশনে একটি অভিযান ব্যর্থ হয়।
ফেনী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মো: রাশেদ খান জানান, ইয়াবা বিক্রেতাদের নিত্য নতুন কৌশলের সাথে পুলিশ পেরে উঠছে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইয়াবা উদ্ধারে পুলিশ বেশ তৎপর বলে তিনি জানান।
পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ বলেন, গতকাল বুধবার ফেনী পুলিশের মাসিক সভায় তিনি মাদক উদ্ধারের ব্যাপারে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। মাদক ব্যবসার সাথে জড়িতরা যেই হোক তাদের খুঁজে আইনের আওতায় আনার জন্য তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের তাগিদ দেন।
এদিকে ইয়াবার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় জেলায় অপরাধ প্রবণতাও ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। মাদকের টাকা জোগাতে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই সহ বিভিন্ন অপকর্মের সাথে মাদকাসক্তরা জড়িয়ে পড়ছে। অনেকে টাকা জোগাতে মাদক ব্যবসাকে বেছে নিচ্ছে। এছাড়া ইয়াবার অধিক ব্যবহারের ফলে উশৃঙ্খল আচার-আচরণ, উম্মত্ততা, দুশ্চিন্তা, আক্রমনাত্মকভাব এমনকি এক পর্যায়ে মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতিও ঘটছে। এতে করে পরিবার ও সমাজ থেকে তারা দিনদিনই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। যার ফলে পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাচ্ছে।  মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়েই ফেনী শহরের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে হামলা ও সংঘর্ষের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। মাদকাসক্তদের উৎপাতে অভিভাবকরা উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে।---ডিনিউজ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়