মাজহার মান্না : কথাটা এ কান ও কান হয়ে পাঁচ কান হয়েই গেল! কান মারফত কথাটা তালেবদের বাড়িতেও পৌঁছাল সন্ধ্যা নাগাদ। তালেবের মা সবেমাত্র অষ্টাদশী ভাতিজির বানানো পানটি মুখে পুরেছিলেন। বিষম খেয়ে কাশতে লাগলেন খক খক করে।
হাফিজ উদ্দিন পুকুরঘাট থেকে খুব সতর্কতার সাথে অজু বানিয়ে এসেছেন। তার ভেতরে একটা পূতঃপবিত্র ভাব লুকোচুরি খেলছে। তিনি বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইলেন কাশেম মিয়ার দিকে।
হাফিজ উদ্দিন গেল বছর হজ্জ করে এসেছেন। সম্মানটাও বেড়ে গেছে তার সেই সাথে। নামের সাথে জুৎ করে হাজি শব্দটার সদ্ব্যবহার করছেন। সামনে ইউপি মেম্বার ইলেকশনে দাঁড়াবার ইচ্ছেটা এখন পর্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেননি কারো কাছে। শুধু একান্ত দু’একজন বিশ্বস্ত লোক ছাড়া। কাশেম মিয়া সেই বিশ্বস্ত লোকদের তালিকাতে পড়ে।
এ সময় ঠিক এই সময়টায় যদি ছেলেটা উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসে, তাহলেই সর্বনাশ! তিল তিল করে গড়ে ওঠা গ্রামের ভেতর তার অবস্থানটুকু এক নিমিষেই ধুলোয় লুটাবে। তাই ছেলের বিয়ের কথাটা তিনি ভাবছিলেন জোরেশোরেই। আর এই সময়েই কি-না এমন একটা কলঙ্ক নামের সাথে জুড়ে বসবে! তিনি ভাবতেই পারছেন না।
কাশেমের মুখ থেকে কথাটা শুনে মনে হলো, হাফিজ উদ্দিনের পায়ের নিচ থেকে ক্রমেই মাটি সরে যাচ্ছে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল তার। সামলে নিয়ে খেকিয়ে উঠলেন,
-চুপ! মিছা কতা! এক্কেরে মিছা কতা! এইডা আ মাইনষের কু-কতা! আমি বিশ্বাস যাই না!
-রহিমের পোলায় বোলে দ্যাখছে! ওইডাই তো গাইয়া বেড়াইতাছে!
রহিমের ছেলেকে তিনি চেনেন ভালো করেই। কাজকর্ম নেই, সারাটা দিন টো টো করে সারা গায়ে ঘুরে বেড়ায়! আর সুযোগ পেলেই বাড়ির বউ-ঝিদের উত্তক্ত করে। সেই ছেলে কি-না তার সোনার টুকরো ছেলের নামে ‘গীবত’ গেয়ে বেড়াচ্ছে! হাফিজ উদ্দিন চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
-ওই হারামজাদারে ধইরা পানিতে চুবান দরকার!
-জ্বে, তাইলে ঠিক অয়!
মনের পূতঃপবিত্র ভাবটি আগেই উধাও হয়েছে তার। ধ্যানের সাথে আর নামাজটা আদায় করতে পারলেন না। চরম অস্বস্তি নিয়ে যন্ত্রচালিতের মতো কোনো রকমে উঠলেন আর বসলেন। নামাজ শেষ করেই জোরে জোরে দু’টো গলা খাকারি দিলেন তিনি। এটাই সংকেতÑতালেবের মা’র উদ্দেশ্যে। গলা খাকারি শুনেই তিনি নিজে এসে নাস্তা-পানি দিয়ে যান। আজ তার নাস্তা-পানি খাওয়ার ইচ্ছেটা উবে গেছে। তবে তালেবের মা’কে থামানো দরকার। কিছু জরুরি কথাও রয়েছে।
নামাজে বসা থেকেই শুনতে পেয়েছেন তার স্ত্রী চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে। এখনো থামাথামির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উৎসাহদাতারাও কম নেই আশেপাশে। তালেবের চাচীরা তো এক পায়ে দাঁড়িয়ে তথ্য-উপাত্ত থেকে বাক্যবাণের রসদ যোগাচ্ছেই। তিনি ঘরে বসেই টের পেলেন।
এখনো কানে আসছে তালেবের মা’র চড়া গলা, ‘তগো কী আছে রে! অ্যাঁ? আমার চান্দের লাহান পোলাডারে ... এ্যাই ছেমড়ির চাল-চলন ছোডোকাল থনেই বালা না! আমগো দেইক্যা আইতাছি না!’
তালেবের মা’র দৃষ্টি আকর্ষণের সব প্রচেষ্টা বিফল হলো। তার কানে এখন অন্য কোনো শব্দ ঢুকবে নাÑ তিনি নিশ্চিত। তাই অস্বস্তি নিয়ে কাচারির ভেতর পায়চারি করতে লাগলেন। আরো জোরে দুটো গলা খাকারি দিলেন। এবার ঠিক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে নয়। মনে হচ্ছে তার গলার ভেতর যেন একটা ব্যাঙ ঢুকে বসে রয়েছে। সেটাকে বের করার জন্যে-এ প্রাণান্তর চেষ্টা।
বিছানার এককোণে সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা হাজি রুমালটা একটানে তুলে নিয়ে জোরে জোরে ঝাড়লেন কয়েকবার। যেন ঘর থেকে সমস্ত দূষিত বাতাস ঝেটিয়ে বিদায় করতে চাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত রুমালের ওপর থেকেও তার মন উঠে গেল। ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বিছানার ওপর; আগের অবস্থান লক্ষ করে। রুমালটা যথাস্থানে না পৌঁছে গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। তিনি ফিরে তাকালেন না। বাম হাত মুঠো করে ডান হাতের খোলা তালুতে ঘুষি মেরে আক্রোশের সাথে উচ্চারণ করলেন,
-শালা গম চোর! পোলারে লেলাইয়া দিছো আমার পোলার পিছনে!
এখনো কথার তুবড়ি ছুটছেই তালেবের মায়ের মুখ দিয়ে, ‘ধেঙ্গি মাইয়া! দিন দুফুইরে পেত্যেকদিন কী করে পুস্কুনির ঘাডে? আমি বুঝি না? যেমন তরো মা, মাইয়াডাও হইছে হেমুনই ...’
একটু পরেই এলো আফিজ উদ্দিন। হাফিজ উদ্দিনের ছোট ভাই। একগাল দাড়ি নাড়িয়ে মুখ দিয়ে বুলেট ছুঁড়তে ছুঁড়তে সাঁই করে ঢুকে গেলে কাচারিতে। বলল,
-মিয়া ভাই! এইডার একটা বিহিত করতেই অইব!
হাফিজ উদ্দিন পায়চারি থামিয়ে চোখ কুঁচকে তাকালেন ছোট ভাইয়ের দিকে। তারও মাথা গরম হয়ে আছে, তবে ঠান্ডা করে রেখেছেন বহু কষ্টে। মনে মনে ভাবছেনÑ পলিটিক্সে তো নামতে হবেই! এখন থেকেই মাথা ঠান্ডা রাখার ট্রেনিংটা নিয়ে রাখা ভালো। তাই অনুত্তেজিত গলায় আফিজ উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বললেনÑ তুই আইছোত বালাই অইছে। বয়।
ধুলো জমে থাকা টুলটা পরিষ্কার করে টেনে ওতেই ধপ করে বসে পড়ল আফিজ উদ্দিন। জোর করে ধরে রাখা ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে সে একটুও কার্পণ্য করছে না। ঘন ঘন দাড়িতে হাত বোলাচ্ছে। তার সন্দেহÑ দিন দিন তার দাড়ির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাই দাড়িতে হাত দিয়ে কমে যাওয়ার পরিমাণ আন্দাজ করাটা তার মনের অজান্তেই একটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি হয়ে গেছে। তবে এখন-এ মুহূর্তে সেই সন্দেহকে উপেক্ষা করে গজ গজ করলÑ ‘দবির মুন্সিরে গেরাম ছারাকরন লাগবো! হালার পুতে বহুত বাড়ছে! মাইয়া দিয়া ব্যবসা শুরু করছে! আমি কই কি ...’
-আহ!
হাফিজ উদ্দিন থামিয়ে দিলেন ছোট ভাই আফিজ উদ্দিনকে। দবির মুন্সি, তারই সুমুন্দি। গরিব আত্মীয়। তিন বাড়ির পরেই তার বাড়ি। এক সময় এরা খুবই প্রভাবশালী ছিল। যখন প্রতাবশালী ছিল তখন দবির মুন্সির উদ্যোগেই তার ছোট বোনের সাথে হাফিজ উদ্দিনের বিবাহকার্য সমাধা হয়েছিল। তিনি ভুলে যাননি তা। আস্তে আস্তে দবির মুন্সিদের প্রভাব প্রতিপত্তি কমেছে। কমতে কমতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। রয়েছে শুধু ভিটেমাটি। তাও নিঃশেষ হওয়ার পথে। দবির মুন্সির প্রতি তার একটা দরদ এখনো রয়েছে। এতটা নিষ্ঠুর তিনি হতে পারবেন না তার প্রতি। তাছাড়া যেহেতু আত্মীয়ের মধ্যে পড়েÑ ভিটেছাড়া করলে লোকে নিন্দা করবে। আর নিন্দে জিনিসটা তার দু’চোখের বিষ। সামনেরবার মেম্বার ইলেকশন করবেনই। মনের এই গোপন বাসনাটা ঠিক রেখে তাকে পা ফেলতে হবে। দবির মুন্সিকে ভিটেছাড়া করলে দবির মুন্সির জ্ঞাতিগোষ্ঠী এখনো যে কয়েক ঘর রয়েছে, সেই ভোটগুলো তিনি নির্দ্বিধায় হারাবেন। এত বড় ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।
রহিম বক্স! তার সন্দেহ রহিম বক্স তার বাসনাটি অনুমান করে নিয়েছে। তার কাজকর্মে, আচার-আচরণে, কথাবার্র্তায় বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন নয়। সে পথ তিনি ইচ্ছে করেই খোলা রেখেছিলেন। তাই রহিম বক্স ঠিক সময়ে ঠিক চালটিই চেলেছে! ভিলেজ পলিটিক্স আর কাকে বলে! বংশে কলঙ্ক গেঁথে দিতে পারলে লোকে মুখ ফিরিয়ে নেবেই। রহিম বক্স তার রাজনীতির সম্ভাবনাটিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্যেই এমন চাল চেলেছে তার ছেলেকে দিয়ে। তার তা-ই ধারণা।
তিনি এখনো বিশ্বাস করেনÑ তার ছেলে এমন কাজ করতেই পারে না। রহিমের কুলাঙ্গার ছেলের অপপ্রচার এটা। পনেরো বছর মধ্যপ্রাচ্যে ছিল তালেব। তাছাড়া শহুরে শিক্ষিত, রুচিবান। বিদেশ যাওয়ার আগে তালেবকে তিনি বি.এ্র পর্যন্ত পড়িয়েছেন। অথচ রহিম বক্সের ছেলে প্রাইমারির গন্ডিটাও পেরোতে পারেনি।
পয়লা খবরটা লইয়াইলো কেডা? ভ্র-কুঁচকে তাকালেন তিনি ছোট ভাই আফিজ উদ্দিনের দিকে।
‘আর কেডা? আমাগো গোমস্তা হাসেইম্মা।’
‘হাসেইম্মারে এট্টা খবর দে। আর ফাইজুদ্দিরেও আইতে ক। কতা আছে।’
হাসেম মিয়া আর ফাইজুদ্দিনকে খবর দেয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছাল তারা। ফাইজুদ্দিন অর্থাৎ হাফিজ উদ্দিনের ছোট কিন্তু আফিজ উদ্দিনের বড়Ñ হেলতে হেলতে কাচারিতে ঢুকেই বলল,
-মিয়া ভাই! সবই তো হোনলাম। কি করবার চান এহন?
-এইডার লাইগ্যাই তো ডাকছি। বয়।
কাশেম মিয়া এককোণায় দাঁড়িয়ে রইল সসম্ভ্রমে। তাকে উদ্দেশ্য করে হাফিজ উদ্দিন বললেন,
-কাশেম মিয়া! ঘটনাডা কি? আবার কও দেহি হুনি।
কাশেম মিয়া সবিস্তারে বলল। শুনে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন হাফিজ উদ্দিন। টুপি খুলে বারবার মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। শেষে টুপিটার ভেতর একটা ফুঁ দিয়ে আবার মাথায় চাপালেন। আফিজ উদ্দিন আর ফাইজুদ্দিন দু’জনেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেÑ তিনি কিছু একটা বলবেন-এ প্রত্যাশায়।
হাফিজ উদ্দিন বললেন,
-কাশেম মিয়া! কেডায় কেডায় দ্যাখছে?
-হুজুর ওই রহিম বক্সের পোলায়।
-আর কেডায় ?
-আর কেউ না।
-তুমি কিছু দ্যাখছো?
এ প্রশ্নে কাশেম মিয়া সতর্ক হলো। এদের তেল নুন খেয়েই তার চলে। বেফাঁস কোনো মন্তব্য করা যাবে না। যদিও তালেবকে সে বেশ কয়েক দিনই পুকুরঘাটে দেখেছে, মালতির সঙ্গে কথা বলতে। যখনই দেখত তখনই তার সন্দেহ হতো, দু’জনের ভেতর কোনো সম্পর্ক তৈরি হলো কি না! সে নগণ্য মানুষ। তাই নিজের পিঠ বাঁচাতে এসব গোপণ করেই তাকে চলতে হয়। তা না হলে তাকে বিপদে পড়তে হবে।
রহিম বক্সের ছেলে দবির খুব সকালবেলা যা দেখেছে, সেটা সে নিজে না দেখলেও খুব একটা অবিশ্বাসযোগ্য নয়। আর কেউ বিশ্বাস না করলেও সে করে। কিন্তু সে কথা বলে কি এখন সে নিজের নিশ্চিত জীবিকাটুকু নষ্ট করবে? সে সাবধানে বলল,
-আমাগো তালেব বাবাজির মন এত ছোডো না। হে বলদের মতোন কামকাজ করে না।
-হুম। আর তোমাগো কী মত?’ ভাইদের দিকে তাকালেন হাফিজ উদ্দিন। ভায়েরাও সতর্ক। গত কয়েক বছরে তাদের বড় ভাইয়ের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেড়েছে। বেশ টাকা-পয়সার মালিক হয়েছেন তিনি তালেবের কল্যাণে। ছেলেকে অনেক কষ্টে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়েছিলেন। সে বিমুখ করেনি বাবাকে। বিদেশ-বিভূঁইয়ে হাড়-ভাঙা পরিশ্রম করে দু’হাতে কামিয়েছে সে। যা কামিয়েছে সবই বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। গত বছর অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জাহাজ ভর্তি করে অবৈধ শ্রমিক ফেরত পাঠিয়েছিল। তালেবের প্রত্যাবর্তনও সেভাবেই। তবে আসার পূর্বেই সে তার ভবিষ্যত গড়ে নিয়েছে। সুতরাং আগে তারা মিয়া ভাইকে যে চোখেই দেখুক না কেন, এখন সামলে না চলে তাদের উপায় নেই।
আফিজ উদ্দিন বুঝতে পারছে মিয়া ভাই কী শুনতে চাচ্ছে। তাই সে জোর গলায় বললÑ তালেব এই কাম করতেই পারে না!
ফাইজুদ্দিন আরেক কাঠি সরেস। বলল,
-তালেবের মাথা খারাপ অইছে নিÑহে এই কাম করতে যাইব? মালতির বাবারে এট্টা উচিত শিক্ষা দিতে অইব! ব্যাডাডা বহুত খারাপ। মাইয়াডা গছাইতে চাইতাছে।’
‘থাম তুই! আমি কই কি ...’ দু’ভাই ও কাশেম মিয়াকে হাফিজ উদ্দিন ইশারা করলেন এগিয়ে আসার জন্যে। তারা এগিয়ে এলে তিনি প্রায় ফিস্ফিস করে কথাগুলো একটানা পাঁচ মিনিট ধরে বলে গেলেন।
শুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেল দু’ভায়ের। বেশ কিছুক্ষণ তারা কথাই খুঁজে পেল না। তবে এমন ধুরন্দর বুদ্ধিতে বেশ খুশিই হলো। ফাইজুদ্দিন বলল,
-মিয়া ভাই! ঠিক বুদ্ধিই করছেন! উচিত কাম অইব তইলে! আচ্ছা মতোন শিক্ষা পাইব রহিম বক্স। বদমাইশ পোলাডারে লইয়া কি করে এইডা পর দেহন যাইব!
আফিজ উদ্দিন বলল,
-হ, রহিম বক্সরে ফাঁসানোর এমুন সুযোগ আর পাওয়া যাইব না! তয় মালতির বাবারেও একটা কিছু কওনের দরকার।
হাফিজ উদ্দিন অনেক ভেবেচিন্তে বলল,
-মালতির বাবারে কী কওন লাগব না লাগব এইডা আমি বুঝুম নে। আমারৈ তো আত্মীয়! কিছু কইতে গেলে মাইনষে মন্দ কইব। হেইডা ছাড়া মালতি মাইয়াডা তো খারাপ না। আমাগো চোখের সামনেই তো বড় অইছে। অর বিয়া-শাদির ব্যাপারে পরে চিন্তা করন যাইব। ভালো পোলা পাইলে বিয়া দিয়া দিমু নে। আগে এই গ্যাঞ্জামডা শেষ অউক। ফাইজু, আফিজ! খাইয়াই চেয়ারম্যানের বাইত্তে রওনা দে। যাওনের সময় আমার কাছ তোনে দশ হাজার ট্যাকা নিয়া যাবি। চেয়ারম্যান সাবের হাতেই দিবি, গোপণে কইলাম! আর কাশেম মিয়া! তুমি অহনই কাজে লাইগা যাও। য্যামনে য্যামনে কইছি, ঠিক হ্যামনে হ্যামনেই মাইনষের কাছে কইবা।
কাশেম মিয়া বিরস মুখে ছুটল পাল্টা কুৎসা রটাতে। রহিমের পোলা দবির সাত-সকালেই জড়াইয়া ধরছিল মালতিরে। আর তালেব যাইয়া তারে বাঁধা দিছে। তা না অইলে সাত-সকালে হে দশ বাড়ি পার হইয়া রহিম মিয়ার পুকুরঘাডে কী করতে আইছে! দবিরের বিচার চায় সবাই। সকালবেলা চেয়ারম্যান আইতাছে।
ছড়াতে বেশিক্ষণ লাগল না। রাতের অন্ধকারে যে কোনো রমরমা খবর বোধহয় আরো বেশি ছড়ায়। সুতরাং গ্রামের প্রতিটি বাড়ির বেড়ার ফাঁক দিয়ে গুজুর গুজুর-ফুসুর ফাসুর শোনা যেতে লাগল।
সন্ধ্যায় ভাইদের হাতে একদফা মার খেয়ে মালতি বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিল এক ঘন্টা। দ্বিতীয় দফা গুজব কানে আসতেই বাপ ইদ্রিস মিয়া নিজে উঠলেন গরু খেদানো লাঠি হাতে। তাঁর বেদম প্রহারে মালতির দাঁতে-দাঁত লেগে গেল। উপুড় হয়ে পড়ল উঠোনের মাঝখানে। মালতির মা ধরতে এলে ইদ্রিস মিয়া হাতের লাঠি দিয়ে তাকেও দু’ঘা লাগিয়ে দিলেন।
মালতি কতক্ষণ উঠোনে পড়ে ছিল কেউ জানে না। মাঝরাতের দিকে একবার ওর কান্নাসহ চিৎকার শোনা গিয়েছিল,
-মা! বাজান। আমারে মাপ কইরা দ্যান!
ইদ্রিস মিয়ার কড়া নিষেধে কেউ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। এরপর গোয়াল ঘর থেকে কিছু খুটকাঠ শব্দ ভেসে এসেছিল।
খুব ভোরবেলা তালেবের মা পুকুরঘাটে অজু করতে গিয়ে দেখেন ওপাড়ে শজনের নিচু এক ডালে কিছু একটা দোল খাচ্ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল তার। পতন ঠেকাতে পারলেন না কোনোক্রমেই। কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ বিকট এক চিৎকারে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
হাফিজ উদ্দিন পুকুরঘাট থেকে খুব সতর্কতার সাথে অজু বানিয়ে এসেছেন। তার ভেতরে একটা পূতঃপবিত্র ভাব লুকোচুরি খেলছে। তিনি বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইলেন কাশেম মিয়ার দিকে।
হাফিজ উদ্দিন গেল বছর হজ্জ করে এসেছেন। সম্মানটাও বেড়ে গেছে তার সেই সাথে। নামের সাথে জুৎ করে হাজি শব্দটার সদ্ব্যবহার করছেন। সামনে ইউপি মেম্বার ইলেকশনে দাঁড়াবার ইচ্ছেটা এখন পর্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেননি কারো কাছে। শুধু একান্ত দু’একজন বিশ্বস্ত লোক ছাড়া। কাশেম মিয়া সেই বিশ্বস্ত লোকদের তালিকাতে পড়ে।
এ সময় ঠিক এই সময়টায় যদি ছেলেটা উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসে, তাহলেই সর্বনাশ! তিল তিল করে গড়ে ওঠা গ্রামের ভেতর তার অবস্থানটুকু এক নিমিষেই ধুলোয় লুটাবে। তাই ছেলের বিয়ের কথাটা তিনি ভাবছিলেন জোরেশোরেই। আর এই সময়েই কি-না এমন একটা কলঙ্ক নামের সাথে জুড়ে বসবে! তিনি ভাবতেই পারছেন না।
কাশেমের মুখ থেকে কথাটা শুনে মনে হলো, হাফিজ উদ্দিনের পায়ের নিচ থেকে ক্রমেই মাটি সরে যাচ্ছে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল তার। সামলে নিয়ে খেকিয়ে উঠলেন,
-চুপ! মিছা কতা! এক্কেরে মিছা কতা! এইডা আ মাইনষের কু-কতা! আমি বিশ্বাস যাই না!
-রহিমের পোলায় বোলে দ্যাখছে! ওইডাই তো গাইয়া বেড়াইতাছে!
রহিমের ছেলেকে তিনি চেনেন ভালো করেই। কাজকর্ম নেই, সারাটা দিন টো টো করে সারা গায়ে ঘুরে বেড়ায়! আর সুযোগ পেলেই বাড়ির বউ-ঝিদের উত্তক্ত করে। সেই ছেলে কি-না তার সোনার টুকরো ছেলের নামে ‘গীবত’ গেয়ে বেড়াচ্ছে! হাফিজ উদ্দিন চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
-ওই হারামজাদারে ধইরা পানিতে চুবান দরকার!
-জ্বে, তাইলে ঠিক অয়!
মনের পূতঃপবিত্র ভাবটি আগেই উধাও হয়েছে তার। ধ্যানের সাথে আর নামাজটা আদায় করতে পারলেন না। চরম অস্বস্তি নিয়ে যন্ত্রচালিতের মতো কোনো রকমে উঠলেন আর বসলেন। নামাজ শেষ করেই জোরে জোরে দু’টো গলা খাকারি দিলেন তিনি। এটাই সংকেতÑতালেবের মা’র উদ্দেশ্যে। গলা খাকারি শুনেই তিনি নিজে এসে নাস্তা-পানি দিয়ে যান। আজ তার নাস্তা-পানি খাওয়ার ইচ্ছেটা উবে গেছে। তবে তালেবের মা’কে থামানো দরকার। কিছু জরুরি কথাও রয়েছে।
নামাজে বসা থেকেই শুনতে পেয়েছেন তার স্ত্রী চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে। এখনো থামাথামির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উৎসাহদাতারাও কম নেই আশেপাশে। তালেবের চাচীরা তো এক পায়ে দাঁড়িয়ে তথ্য-উপাত্ত থেকে বাক্যবাণের রসদ যোগাচ্ছেই। তিনি ঘরে বসেই টের পেলেন।
এখনো কানে আসছে তালেবের মা’র চড়া গলা, ‘তগো কী আছে রে! অ্যাঁ? আমার চান্দের লাহান পোলাডারে ... এ্যাই ছেমড়ির চাল-চলন ছোডোকাল থনেই বালা না! আমগো দেইক্যা আইতাছি না!’
তালেবের মা’র দৃষ্টি আকর্ষণের সব প্রচেষ্টা বিফল হলো। তার কানে এখন অন্য কোনো শব্দ ঢুকবে নাÑ তিনি নিশ্চিত। তাই অস্বস্তি নিয়ে কাচারির ভেতর পায়চারি করতে লাগলেন। আরো জোরে দুটো গলা খাকারি দিলেন। এবার ঠিক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে নয়। মনে হচ্ছে তার গলার ভেতর যেন একটা ব্যাঙ ঢুকে বসে রয়েছে। সেটাকে বের করার জন্যে-এ প্রাণান্তর চেষ্টা।
বিছানার এককোণে সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা হাজি রুমালটা একটানে তুলে নিয়ে জোরে জোরে ঝাড়লেন কয়েকবার। যেন ঘর থেকে সমস্ত দূষিত বাতাস ঝেটিয়ে বিদায় করতে চাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত রুমালের ওপর থেকেও তার মন উঠে গেল। ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বিছানার ওপর; আগের অবস্থান লক্ষ করে। রুমালটা যথাস্থানে না পৌঁছে গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। তিনি ফিরে তাকালেন না। বাম হাত মুঠো করে ডান হাতের খোলা তালুতে ঘুষি মেরে আক্রোশের সাথে উচ্চারণ করলেন,
-শালা গম চোর! পোলারে লেলাইয়া দিছো আমার পোলার পিছনে!
এখনো কথার তুবড়ি ছুটছেই তালেবের মায়ের মুখ দিয়ে, ‘ধেঙ্গি মাইয়া! দিন দুফুইরে পেত্যেকদিন কী করে পুস্কুনির ঘাডে? আমি বুঝি না? যেমন তরো মা, মাইয়াডাও হইছে হেমুনই ...’
একটু পরেই এলো আফিজ উদ্দিন। হাফিজ উদ্দিনের ছোট ভাই। একগাল দাড়ি নাড়িয়ে মুখ দিয়ে বুলেট ছুঁড়তে ছুঁড়তে সাঁই করে ঢুকে গেলে কাচারিতে। বলল,
-মিয়া ভাই! এইডার একটা বিহিত করতেই অইব!
হাফিজ উদ্দিন পায়চারি থামিয়ে চোখ কুঁচকে তাকালেন ছোট ভাইয়ের দিকে। তারও মাথা গরম হয়ে আছে, তবে ঠান্ডা করে রেখেছেন বহু কষ্টে। মনে মনে ভাবছেনÑ পলিটিক্সে তো নামতে হবেই! এখন থেকেই মাথা ঠান্ডা রাখার ট্রেনিংটা নিয়ে রাখা ভালো। তাই অনুত্তেজিত গলায় আফিজ উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বললেনÑ তুই আইছোত বালাই অইছে। বয়।
ধুলো জমে থাকা টুলটা পরিষ্কার করে টেনে ওতেই ধপ করে বসে পড়ল আফিজ উদ্দিন। জোর করে ধরে রাখা ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে সে একটুও কার্পণ্য করছে না। ঘন ঘন দাড়িতে হাত বোলাচ্ছে। তার সন্দেহÑ দিন দিন তার দাড়ির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাই দাড়িতে হাত দিয়ে কমে যাওয়ার পরিমাণ আন্দাজ করাটা তার মনের অজান্তেই একটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি হয়ে গেছে। তবে এখন-এ মুহূর্তে সেই সন্দেহকে উপেক্ষা করে গজ গজ করলÑ ‘দবির মুন্সিরে গেরাম ছারাকরন লাগবো! হালার পুতে বহুত বাড়ছে! মাইয়া দিয়া ব্যবসা শুরু করছে! আমি কই কি ...’
-আহ!
হাফিজ উদ্দিন থামিয়ে দিলেন ছোট ভাই আফিজ উদ্দিনকে। দবির মুন্সি, তারই সুমুন্দি। গরিব আত্মীয়। তিন বাড়ির পরেই তার বাড়ি। এক সময় এরা খুবই প্রভাবশালী ছিল। যখন প্রতাবশালী ছিল তখন দবির মুন্সির উদ্যোগেই তার ছোট বোনের সাথে হাফিজ উদ্দিনের বিবাহকার্য সমাধা হয়েছিল। তিনি ভুলে যাননি তা। আস্তে আস্তে দবির মুন্সিদের প্রভাব প্রতিপত্তি কমেছে। কমতে কমতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। রয়েছে শুধু ভিটেমাটি। তাও নিঃশেষ হওয়ার পথে। দবির মুন্সির প্রতি তার একটা দরদ এখনো রয়েছে। এতটা নিষ্ঠুর তিনি হতে পারবেন না তার প্রতি। তাছাড়া যেহেতু আত্মীয়ের মধ্যে পড়েÑ ভিটেছাড়া করলে লোকে নিন্দা করবে। আর নিন্দে জিনিসটা তার দু’চোখের বিষ। সামনেরবার মেম্বার ইলেকশন করবেনই। মনের এই গোপন বাসনাটা ঠিক রেখে তাকে পা ফেলতে হবে। দবির মুন্সিকে ভিটেছাড়া করলে দবির মুন্সির জ্ঞাতিগোষ্ঠী এখনো যে কয়েক ঘর রয়েছে, সেই ভোটগুলো তিনি নির্দ্বিধায় হারাবেন। এত বড় ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।
রহিম বক্স! তার সন্দেহ রহিম বক্স তার বাসনাটি অনুমান করে নিয়েছে। তার কাজকর্মে, আচার-আচরণে, কথাবার্র্তায় বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন নয়। সে পথ তিনি ইচ্ছে করেই খোলা রেখেছিলেন। তাই রহিম বক্স ঠিক সময়ে ঠিক চালটিই চেলেছে! ভিলেজ পলিটিক্স আর কাকে বলে! বংশে কলঙ্ক গেঁথে দিতে পারলে লোকে মুখ ফিরিয়ে নেবেই। রহিম বক্স তার রাজনীতির সম্ভাবনাটিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্যেই এমন চাল চেলেছে তার ছেলেকে দিয়ে। তার তা-ই ধারণা।
তিনি এখনো বিশ্বাস করেনÑ তার ছেলে এমন কাজ করতেই পারে না। রহিমের কুলাঙ্গার ছেলের অপপ্রচার এটা। পনেরো বছর মধ্যপ্রাচ্যে ছিল তালেব। তাছাড়া শহুরে শিক্ষিত, রুচিবান। বিদেশ যাওয়ার আগে তালেবকে তিনি বি.এ্র পর্যন্ত পড়িয়েছেন। অথচ রহিম বক্সের ছেলে প্রাইমারির গন্ডিটাও পেরোতে পারেনি।
পয়লা খবরটা লইয়াইলো কেডা? ভ্র-কুঁচকে তাকালেন তিনি ছোট ভাই আফিজ উদ্দিনের দিকে।
‘আর কেডা? আমাগো গোমস্তা হাসেইম্মা।’
‘হাসেইম্মারে এট্টা খবর দে। আর ফাইজুদ্দিরেও আইতে ক। কতা আছে।’
হাসেম মিয়া আর ফাইজুদ্দিনকে খবর দেয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছাল তারা। ফাইজুদ্দিন অর্থাৎ হাফিজ উদ্দিনের ছোট কিন্তু আফিজ উদ্দিনের বড়Ñ হেলতে হেলতে কাচারিতে ঢুকেই বলল,
-মিয়া ভাই! সবই তো হোনলাম। কি করবার চান এহন?
-এইডার লাইগ্যাই তো ডাকছি। বয়।
কাশেম মিয়া এককোণায় দাঁড়িয়ে রইল সসম্ভ্রমে। তাকে উদ্দেশ্য করে হাফিজ উদ্দিন বললেন,
-কাশেম মিয়া! ঘটনাডা কি? আবার কও দেহি হুনি।
কাশেম মিয়া সবিস্তারে বলল। শুনে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন হাফিজ উদ্দিন। টুপি খুলে বারবার মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। শেষে টুপিটার ভেতর একটা ফুঁ দিয়ে আবার মাথায় চাপালেন। আফিজ উদ্দিন আর ফাইজুদ্দিন দু’জনেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেÑ তিনি কিছু একটা বলবেন-এ প্রত্যাশায়।
হাফিজ উদ্দিন বললেন,
-কাশেম মিয়া! কেডায় কেডায় দ্যাখছে?
-হুজুর ওই রহিম বক্সের পোলায়।
-আর কেডায় ?
-আর কেউ না।
-তুমি কিছু দ্যাখছো?
এ প্রশ্নে কাশেম মিয়া সতর্ক হলো। এদের তেল নুন খেয়েই তার চলে। বেফাঁস কোনো মন্তব্য করা যাবে না। যদিও তালেবকে সে বেশ কয়েক দিনই পুকুরঘাটে দেখেছে, মালতির সঙ্গে কথা বলতে। যখনই দেখত তখনই তার সন্দেহ হতো, দু’জনের ভেতর কোনো সম্পর্ক তৈরি হলো কি না! সে নগণ্য মানুষ। তাই নিজের পিঠ বাঁচাতে এসব গোপণ করেই তাকে চলতে হয়। তা না হলে তাকে বিপদে পড়তে হবে।
রহিম বক্সের ছেলে দবির খুব সকালবেলা যা দেখেছে, সেটা সে নিজে না দেখলেও খুব একটা অবিশ্বাসযোগ্য নয়। আর কেউ বিশ্বাস না করলেও সে করে। কিন্তু সে কথা বলে কি এখন সে নিজের নিশ্চিত জীবিকাটুকু নষ্ট করবে? সে সাবধানে বলল,
-আমাগো তালেব বাবাজির মন এত ছোডো না। হে বলদের মতোন কামকাজ করে না।
-হুম। আর তোমাগো কী মত?’ ভাইদের দিকে তাকালেন হাফিজ উদ্দিন। ভায়েরাও সতর্ক। গত কয়েক বছরে তাদের বড় ভাইয়ের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেড়েছে। বেশ টাকা-পয়সার মালিক হয়েছেন তিনি তালেবের কল্যাণে। ছেলেকে অনেক কষ্টে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়েছিলেন। সে বিমুখ করেনি বাবাকে। বিদেশ-বিভূঁইয়ে হাড়-ভাঙা পরিশ্রম করে দু’হাতে কামিয়েছে সে। যা কামিয়েছে সবই বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। গত বছর অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জাহাজ ভর্তি করে অবৈধ শ্রমিক ফেরত পাঠিয়েছিল। তালেবের প্রত্যাবর্তনও সেভাবেই। তবে আসার পূর্বেই সে তার ভবিষ্যত গড়ে নিয়েছে। সুতরাং আগে তারা মিয়া ভাইকে যে চোখেই দেখুক না কেন, এখন সামলে না চলে তাদের উপায় নেই।
আফিজ উদ্দিন বুঝতে পারছে মিয়া ভাই কী শুনতে চাচ্ছে। তাই সে জোর গলায় বললÑ তালেব এই কাম করতেই পারে না!
ফাইজুদ্দিন আরেক কাঠি সরেস। বলল,
-তালেবের মাথা খারাপ অইছে নিÑহে এই কাম করতে যাইব? মালতির বাবারে এট্টা উচিত শিক্ষা দিতে অইব! ব্যাডাডা বহুত খারাপ। মাইয়াডা গছাইতে চাইতাছে।’
‘থাম তুই! আমি কই কি ...’ দু’ভাই ও কাশেম মিয়াকে হাফিজ উদ্দিন ইশারা করলেন এগিয়ে আসার জন্যে। তারা এগিয়ে এলে তিনি প্রায় ফিস্ফিস করে কথাগুলো একটানা পাঁচ মিনিট ধরে বলে গেলেন।
শুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেল দু’ভায়ের। বেশ কিছুক্ষণ তারা কথাই খুঁজে পেল না। তবে এমন ধুরন্দর বুদ্ধিতে বেশ খুশিই হলো। ফাইজুদ্দিন বলল,
-মিয়া ভাই! ঠিক বুদ্ধিই করছেন! উচিত কাম অইব তইলে! আচ্ছা মতোন শিক্ষা পাইব রহিম বক্স। বদমাইশ পোলাডারে লইয়া কি করে এইডা পর দেহন যাইব!
আফিজ উদ্দিন বলল,
-হ, রহিম বক্সরে ফাঁসানোর এমুন সুযোগ আর পাওয়া যাইব না! তয় মালতির বাবারেও একটা কিছু কওনের দরকার।
হাফিজ উদ্দিন অনেক ভেবেচিন্তে বলল,
-মালতির বাবারে কী কওন লাগব না লাগব এইডা আমি বুঝুম নে। আমারৈ তো আত্মীয়! কিছু কইতে গেলে মাইনষে মন্দ কইব। হেইডা ছাড়া মালতি মাইয়াডা তো খারাপ না। আমাগো চোখের সামনেই তো বড় অইছে। অর বিয়া-শাদির ব্যাপারে পরে চিন্তা করন যাইব। ভালো পোলা পাইলে বিয়া দিয়া দিমু নে। আগে এই গ্যাঞ্জামডা শেষ অউক। ফাইজু, আফিজ! খাইয়াই চেয়ারম্যানের বাইত্তে রওনা দে। যাওনের সময় আমার কাছ তোনে দশ হাজার ট্যাকা নিয়া যাবি। চেয়ারম্যান সাবের হাতেই দিবি, গোপণে কইলাম! আর কাশেম মিয়া! তুমি অহনই কাজে লাইগা যাও। য্যামনে য্যামনে কইছি, ঠিক হ্যামনে হ্যামনেই মাইনষের কাছে কইবা।
কাশেম মিয়া বিরস মুখে ছুটল পাল্টা কুৎসা রটাতে। রহিমের পোলা দবির সাত-সকালেই জড়াইয়া ধরছিল মালতিরে। আর তালেব যাইয়া তারে বাঁধা দিছে। তা না অইলে সাত-সকালে হে দশ বাড়ি পার হইয়া রহিম মিয়ার পুকুরঘাডে কী করতে আইছে! দবিরের বিচার চায় সবাই। সকালবেলা চেয়ারম্যান আইতাছে।
ছড়াতে বেশিক্ষণ লাগল না। রাতের অন্ধকারে যে কোনো রমরমা খবর বোধহয় আরো বেশি ছড়ায়। সুতরাং গ্রামের প্রতিটি বাড়ির বেড়ার ফাঁক দিয়ে গুজুর গুজুর-ফুসুর ফাসুর শোনা যেতে লাগল।
সন্ধ্যায় ভাইদের হাতে একদফা মার খেয়ে মালতি বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিল এক ঘন্টা। দ্বিতীয় দফা গুজব কানে আসতেই বাপ ইদ্রিস মিয়া নিজে উঠলেন গরু খেদানো লাঠি হাতে। তাঁর বেদম প্রহারে মালতির দাঁতে-দাঁত লেগে গেল। উপুড় হয়ে পড়ল উঠোনের মাঝখানে। মালতির মা ধরতে এলে ইদ্রিস মিয়া হাতের লাঠি দিয়ে তাকেও দু’ঘা লাগিয়ে দিলেন।
মালতি কতক্ষণ উঠোনে পড়ে ছিল কেউ জানে না। মাঝরাতের দিকে একবার ওর কান্নাসহ চিৎকার শোনা গিয়েছিল,
-মা! বাজান। আমারে মাপ কইরা দ্যান!
ইদ্রিস মিয়ার কড়া নিষেধে কেউ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। এরপর গোয়াল ঘর থেকে কিছু খুটকাঠ শব্দ ভেসে এসেছিল।
খুব ভোরবেলা তালেবের মা পুকুরঘাটে অজু করতে গিয়ে দেখেন ওপাড়ে শজনের নিচু এক ডালে কিছু একটা দোল খাচ্ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল তার। পতন ঠেকাতে পারলেন না কোনোক্রমেই। কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ বিকট এক চিৎকারে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
mazharmanna@gmail.com-----ডিনিউজ
খবর বিভাগঃ
সংস্কৃতি
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়