Tuesday, July 9

গাজীপুরে পরাজয় : প্রধানমন্ত্রী ফিরলেই ‘বিভীষণ’দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

ঢাকা : হতাশ-হতবিহ্বল শাসক দল আওয়ামী লীগে নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। চলছে ব্যর্থতা-সফলতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার চুলচেরা বিশ্লেষণ। জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একের পর এক পরাজয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়া দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করে তুলতে বিকল্প পথের অনুসন্ধানেও ব্যস্ত আওয়ামী নীতিনির্ধারকরা। দলের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, সমন্বয়হীনতা ও ধারাবাহিক ফল বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসা মাত্রই দলের সর্বোচ্চ ফোরামের বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। একইসঙ্গে মহাজোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গেও কার্যকর বৈঠক করে তাদের মান-অভিমান, দুঃখ-কষ্ট মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধ করার সিদ্ধান্তও হয়েছে দলটির উচ্চ পর্যায় থেকে।
সূত্র জানায়, পুরো রমজান মাসে কেন্দ্রীয় নেতাদের দেশব্যাপী ধারাবাহিক গণসংযোগ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল দ্বন্দ্ব নিরসন ও বিপর্যস্ত সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে হতাশাগ্রস্ত দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। এদিকে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দলের প্রার্থীদের পরাজয়ে ভূমিকা রাখা এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে প্রবলভাবে। নিজেদের বিরোধিতা আর বিদ্রোহের কারণে সিটি নির্বাচনে এমন ধারাবাহিক পরাজয়ে ফুঁসে উঠেছে দলটির তৃণমূল নেতারা।
মাঠের নেতারা কঠোর হস্তে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সারাদেশেই শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার তাগিদ দিচ্ছেন নীতিনির্ধারক নেতাদের। ‘দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল’ এই প্রবাদটি মাথায় রেখে জাতীয় নির্বাচনের আগেই দলকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শও দিয়েছেন তাঁরা। মাঠের নেতাদের ক্ষোভের সঙ্গে সহমত পোষণ করে নীতিনির্ধারকরা দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেই বৈঠক করে এ বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলের একাধিক সিনিয়র নেতা লন্ডনে থাকা দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন। আলাপকালে প্রধানমন্ত্রীও এ পরাজয়কে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন। দলের কোন কোন নেতা নিজেদের প্রার্থীকে পরাজয়ে ভূমিকা রেখেছেন তাও সিনিয়র নেতাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন। সবকিছু শুনে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরেই এ নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে জানিয়েছেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দলের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার দিকগুলো চিহ্নিত, পরাজয়ের মূল কারণ শনাক্ত এবং দল গোছানোর প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যও দলের সিনিয়র নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ একাধিক সিনিয়র নেতা এ সম্পর্কে সাংবাদিকদের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে আসার পর দলীয় ফোরামের বৈঠক ডেকে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করা হবে। পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানের পর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হবে।
‘হলমার্ক, ডেসটিনি ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি ইত্যাদির কারণে জনগণ আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দেয়নি’ এমন বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত নন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তাঁদের মতে, সরকারকে যদি দুর্নীতির কারণেই ভোট না দেয়, তাহলে তো বিরোধী দলের চিহ্নিত ও প্রমাণিত দুর্নীতিবাজদের ভোট দিয়ে বিজয়ী করত না। আজমত উল্লাহ খানের মতো একজন ‘ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে বাদ দিয়ে হজের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মন্ত্রিত্ব হারানো বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নানকে ভোট দিত না। আসলে গাজীপুরে দলের মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ-দ্বন্দ্বই দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের প্রধান কারণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ধানম-ির দলের সভানেত্রীর কার্যালয়সহ সারাদেশেই শাসক দলটির কার্যালয়ে ধারাবাহিক এমন পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানে চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত নেতাকর্মীরা। আর তাতে পাঁচ সিটি কর্পোরেশন এলাকাতেই স্থানীয়ভাবে দলের বিভক্তির কথা যেমন এসেছে, পাশাপাশি সাংগঠনিক কার্যক্রম ও প্রচার কাজে ‘দুর্বলতার’ কথাও এসেছে। এদিকে চার সিটি নির্বাচনের পরাজয়ের ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গাজীপুরের নির্বাচনের পরাজয়ের তীব্র ঝাঁকুনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তৃণমূল নেতারা। আর সাংগঠনিক এমন বিপর্যয়ে মাঠের নেতাদের অভিযোগের তীর এখন দলের সাধারণ সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে। তাদের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীর সামনে মাঠের প্রকৃত চিত্র তারা তুলে ধরতেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অদক্ষতা, অবহেলা আর দলের পরিবর্তে সরকারী কাজে অধিক মনোযোগী হওয়ার কারণেই প্রাচীণ এ দলটির অবস্থা আজ এমন বেহাল।
এদিকে ধারাবাহিক পরাজয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধা শরিক নেতারাও উদ্বিগ্ন। অনেক আগে থেকেই কাগজে-কলমে সীমিত ছিল মহাজোটের কার্যক্রম। সরকারের শরিক থাকলেও রাজনৈতিক কর্মকা-ে ও জোটগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মহাজোটে জাতীয় পার্টিকে অদৃশ্য করেই রাখা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বরং জাপা প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকারবিরোধী দৌড়ঝাঁপ মহাজোটের কাগুজে অবস্থানকেই আরও দুর্বল করে তুলেছে। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকেশ নিয়ে সরকারের শেষ মেয়াদে এসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির সম্পর্কের আরও মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। যার ফলে পরাজিত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেই জাপার মাঠের নেতাকর্মীদের মহাজোটের প্রার্থীর পরিবর্তে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষেই প্রকাশ্য নির্বাচনী প্রচার ও ভোট প্রদানের দৃশ্য দেখা গেছে।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক জোট বলে পরিচিত চৌদ্দ দলের মধ্যেও রয়েছে মান-অভিমান। ক্ষমতার সাড়ে চার বছরেই আওয়ামী লীগের ‘একলা চলো নীতি’র কারণেই এ অবস্থা। মুক্তিযুদ্ধেরবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে অস্তিত্বের খাতিরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এখনও দৃশ্যত একাট্টা হয়ে চললেও কার্যত শরিক দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনের মাঠে কোন ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব, আর মহাজোটের মধ্যে সৃষ্ট অনৈক্যের কারণেই আওয়ামী লীগকে পাঁচ সিটি নির্বাচনেই বড় ধরনের মাসুল দিতে হয়েছে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, দল, সরকার ও জোটের মধ্যে সৃষ্ট দুর্বলতা, অনৈক্য ও ব্যর্থতার দিকগুলো বিশ্লেষণ করেই রমজানজুড়ে সাংগঠনিক পুনর্গঠনের পাশাপাশি জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির অধিকাংশ নেতাই এই বলে স্বীকার করছেন গাজীপুরের পরাজয় আওয়ামী লীগের জন্য সতর্কবার্তা। এর থেকে শিক্ষা নিয়েই আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে চান তাঁরা। নেতাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সিটি নির্বাচনে পরাজয় আগামী জাতীয় নির্বাচনে কিছুটা প্রভাব ফেললেও বড় কোন প্রভাব পড়বে না। বাকি সময়ে আওয়ামী লীগ ও সরকার ভুলত্রুটি চিহ্নিত করেই কাজ করে জনগণের আস্থা-বিশ্বাস ফের ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।- জনকণ্ঠ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়