মৌলভীবাজার: রমজানের ঈদ শেষে ছুটি কাটাতে বা সময় কাটাতে চলে আসতে পারেন কমলগঞ্জে। মৌলভীবাজারের গারো, মণিপুরী, চাশ্রমিক, খাসিয়া, সাওতাঁল নানা জাতিগোষ্টীর নৃতাত্ত্বিক সমন্বয়ে সমৃদ্ধ সবুজ জনপদ কমলগঞ্জ।
ঢাকা থেকে ট্রেনে সরসরি কমলগঞ্জের ভানুগাছ অথবা শমসেরনগর ষ্টেশনে নামতে পারেন। যদি বাসে আসেন তবে শ্রীমঙ্গল বা মৌলভীবাজার নেমে সেখান থেকে প্রাইভেট কার,ট্যাক্সি বা সি,এন,জি,যোগে চায়ের পাতার সুঘ্রাণ নিয়ে লাউয়াছড়ার বনারণ্যে পাখ-পাখালীর কুহুরব শুনে শুনে হামহাম, মাধবপুর লেক আর বর্ণিল সংস্কৃতির কমলগঞ্জে চলে আসা যায়। সেখানে হামহাম,মাধবপুর লেক,ক্যামেলিয়া ছাড়াও দেখে আসতে পারেন পৃথিবীর এক অনন্য ও অন্যরকম নৃতাত্বিক যাদুঘর কমলগঞ্জের মণিপুরী যাদুঘর।
এক উদাসীন কবি, লোক গবেষক ও মণিপুরী সংস্কৃতিকর্মী হামোম তনুবাবু মণিপুরী লোক সংস্কৃতির অতীত ঐতিহ্য ও নিদর্শন সামগ্রীর সমন্বয়ে কমলগঞ্জের আদমপুরের ছনগাও গ্রামে তার নিজবাড়িতে তৈরি করেছেন মণিপুরী জাদুঘর ‘চাউবা মেমোরিয়াল মণিপুরী ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রপার্টি মিউজিয়াম’।
সনাতন ধর্মালম্বীদের মধ্যে মণিপুরী একটি সমৃদ্ধ জাতি গোষ্ঠী। যাদের রয়েছে বিশাল ইতিহাস। রয়েছে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। কিন্তু কালের ধারায় আজ তা প্রায় বিলুপ্ত। মণিপুরী সম্প্রদায়ের অনেক নতুন প্রজন্মরাও জানে না তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এই বিষয়গুলোকে ধরে রাখতে কমলগঞ্জের সংস্কৃতিযোদ্ধা হামোম তনু বাবু শুরু করেন মণিপুরী ঐতিহ্যে লালিত প্রাচীন বিলুপ্ত প্রায় সামগ্রী সংগ্রহের কাজ। সংগৃহীত সামগ্রীর সমন্বয়ে তিনি গড়ে তোলেন মণিপুরী ঐতিহ্যের জাদুঘর। তনু বাবু তার বাবা চাউবাসিংহের স্মৃতি রক্ষায় এর নামকরণ করেছেন ‘চাউবা মেমোরিয়াল মণিপুরী ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রপার্টি মিউজিয়াম’। পর্যটন নগরী শ্রীমঙ্গল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জাদুঘর।
শুরুতেই জেনেছি শ্রীমঙ্গল বা মৌলভীবাজার থেকে প্রথমে যেতে হবে কমলগঞ্জের উপজেলা চৌমুহনী ময়না চত্বরে। সেখান থেকে আদমপুর বাজার হয়ে নিভৃতপল্লী ছনগাও গ্রামে তনু বাবুর বাড়ি। হামোম তনুবাবু নিজের ছায়া ঘেরা বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেছেন এই জাদুঘর। ২০০৭ সালের ১২মে মণিপুরী বিভিন্ন ঐতিহ্য ও নিদর্শন দিয়ে সাজানো এই জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট কবি ও গবেষক নুরুল হুদা। সেদিন আগত অতিথিরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলেন ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক এই পরিবেশনা দেখে। এর আগে ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর এ জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন গণমানুষের কবি দিলওয়ার। এরপর থেকে সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় তনু বাবু ধীরে ধীরে চালিয়ে যাচ্ছেন তার সংগ্রহ ও তা জাদুঘরে সংরক্ষণের কাজ। তনু বাবুর আর্থিক অসচ্ছলতা রয়েছে। এগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন বিশাল অর্থ ও সময়। নিজের সংসার পরিচালনার পর অতিরিক্ত বোঝা টানা তার পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য। তবুও তার অদম্য সাহস ও মনোবল নিয়ে নিজের সংসার পরিচালনার ফাঁকে ফাঁকে চালিয়ে যাচ্ছেন এ কাজ। এই জাদুঘর পরিদর্শনকালে দেখা যায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও জাদুঘরের জন্য কোনো ঘর তৈরি করতে পারেননি তনু বাবু। নিজের থাকার ঘরের একপাশ ছেড়ে দিয়েছেন জাদুঘরের জন্য। প্রায় ২৮০ স্কয়ার ফুটের একটি কক্ষে গাদাগাদি করে রাখা মণিপুরীদের প্রাচীন সামগ্রী।
এ সময় তনুবাবু জানান, তার জাদুঘরে ১১৬ প্রকারের দু’শতাধিক সামগ্রী আছে। জায়গার অভাবে এভাবেই রাখা। এ জাদুঘরে সংরক্ষিত বিভিন্ন প্রাচীন ঐতিহ্য ও নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন যুগে মণিপুরীদের নিত্য ব্যবহার্য কাঁসা-পিতলের কলস, জগ গ্লাস, মগ, থালাসহ বিভিন্ন খাবারপাত্র, সোনা, রূপা ও বিভিন্ন প্রকার ধাতব পদার্থের তৈরি মণিপুরী মেয়েদের ব্যবহার্য বিভিন্ন ধরনের গহনা ও সাজসজ্জার উপকরণ, বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ঝুড়ি, চালুন, ডালা, খলই, ছাতা, হাত পাখা, টুপি, মাছ ধরার দুওড়, পলো, শুকনো খাবার রাখার পাত্র, কাঠের তৈরি চিরুনি, তাঁতে কাপড় বুননের সরঞ্জাম, তাঁতে বোনা বিভিন্ন রং ও নকশার শাড়ি, গামছা, শালসহ বিভিন্ন উৎসবে ব্যবহার্য বিভিন্ন ধরনের পোশাক, বসার টুল, কৃষিকাজে ব্যবহৃত উপকরণ, ঢোল, তবলাসহ গান গাওয়ার বিভিন্ন প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রসহ মণিপুরী সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বস্তু। যার অনেক কিছুই এখন বিলুপ্ত প্রায়। সংগ্রহশালায় মণিপুরী পোশাকগুলো খুব আর্কষণীয়। ইচ্ছে করলে দর্শক তনু বাবুর অনুমতি নিয়ে সে পোশাক গায়ে জড়িয়ে ছবিও তুলতে পারেন। তনু বাবুর এ জাদুঘর পরিদর্শনে কোনো ফি দিতে হয় না। সবার জন্য উন্মুক্ত। আর সপ্তাহের ৭ দিনই সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
তনু বাবু জানান, তার এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হওয়ার পেছনে মূলত যে কাজটি করেছে তা হচ্ছে ২০০৬ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের সেমিনার কক্ষে লোক বাংলা গবেষক দলের আয়োজনে ‘বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতি শনাক্তকরণ ও মূল্যমান নির্ধারণ এবং মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ’ শীর্ষক একটি জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারে মণিপুরী লোক সংস্কৃতির ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপনের আমন্ত্রণ পেয়ে তনুবাবু বিভিন্ন মণিপুরী অধ্যুষিত এলাকা ঘুরে নানা তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া মণিপুরী লোক সংস্কৃতির অনেক ঐতিহ্য ও নিদর্শন এবং বিলীন হওয়ার পথে নিদর্শন তাকে অনুপ্রাণিত করে এবং তিনি এসব মূল্যবান অতীত ঐতিহ্য সংরক্ষণে উদোগী হন। নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় গড়ে তুলেন এই সংগ্রহশালা। ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক নিভৃত পল্লীতে মণিপুরী জাদুঘরটি পরিদর্শনে এসেছেন। হামোম তনু বাবুর প্রতিষ্ঠিত মণিপুরী জাদুঘরে স্থান পাওয়া ১১৬ প্রকারের প্রায় দুশতাধিক দ্রব্য দেখে জাদুঘর পরিদর্শনে আগতরা মুগ্ধ হয়ে ওঠেন।--ডিনিউজ
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়