Wednesday, July 24

সবুজ শ্যামলিমায় আচ্ছন্ন কিশোরগঞ্জ

লিয়াকত হোসেন খোকন
ঢাকা: কিশোরগঞ্জকে বলা হয় ভাটির দেশ। হাওর-বিল রয়েছে এই জেলায়। সর্বত্র যেন সবুজ শ্যামলিমায় আচ্ছন্ন। এখানে পাকুদিয়া, হোসেনদী ও এগারসিন্ধুতে রয়েছে ঐতিহাসিক স্থাপত্যকীর্তি যা দেখে মুগ্ধই হতে হয়। বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর বসতবাটি ছিল এই কিশোরগঞ্জের পতোয়াই গ্রামে। মন ভুলিয়ে দেবে চন্দ্রাবতীর মঠ। প্রামাণিক ভবন, জঙ্গলবাড়ি, হাগলা মসজিদ, শোলাকিয়া ঈদগাহ, শহিদী মসজিদ, হাওর-বিল-ঝিল এসব কতইনা—এসব ভেবে ভেবে আবার চললাম কিশোরগঞ্জের দিকে। এবার আমার ভ্রমণসঙ্গী হলো সিলেটের ভাদেশ্বরের সাকিব চৌধুরী। বনানী ফ্লাইওভারের পশ্চিম পাশে গিয়ে সরাসরি কিশোরগঞ্জের বিআরটিসির বাস না পেয়ে ভৈরবগামী বিআরটিসির বাসে উঠলাম। ভাড়া নেয়া হলো জনপ্রতি দেড়শ’ টাকা করে। দুপুর ১টায় গিয়ে পৌঁছলাম ভৈরবে। এখান থেকে সিএনজি রিজার্ভ করে চললাম কিশোরগঞ্জের দিকে। দূরত্ব ৫০ কিলোমিটারের মতো। 
কিশোরগঞ্জের গাইটালে এসে পৌঁছলাম বিকাল সাড়ে তিনটায়। এখানে গিয়ে উঠলাম পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের গেস্ট হাউসে। এই প্রতিষ্ঠানের উপ-পরিচালক আজিজুর রহমান বললেন, ভাটির দেশে এসেছেন, বড্ড ভালো লাগবে। এই জেলার ইটনা, মিঠামইন, নিকলি, অষ্টগ্রামে গেলে দেখতে পাবেন হাওর আর হাওর। প্রতি বছর নিকলিতে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। কত না রকমের মাছ আছে, খেতে খেতে বলবেন এ যে মাছের দেশ। এগারোসিন্ধুর দুর্গ, সাদ মসজিদ, কুতুবশাই মসজিদ, বাদশাহী মসজিদ, দিল্লির আখড়া, গুড়ট মসজিদ, গোপীনাথ জিওর মন্দির এই জেলার ঐতিহ্য। ‘রাতাবোয়া’ নামের চাল মেলে এখানে, সুগন্ধি এই চালের ভাত খেয়েও বেশ তৃপ্তি পাবেন। 
রাত কাটালাম পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের গেস্ট হাউসে। পরদিন রিকশা ভাড়া করে সাকিব চৌধুরী আর আমি চললাম শহর দেখতে। প্রথমে এলাম গুরুদয়াল কলেজের কাছে। এর পাশ থেকে বয়ে গেছে নরসুন্দা নদী, এখন আর একে নদী বলা যায় না। দেখলাম, নদীর এ-তীর ও-তীর কারা যেন দখল করে বাড়িঘর তুলেছে। যে যেখানে খুশি বাড়িঘর তুলে কিশোরগঞ্জের সৌন্দর্যকে এভাবে যেন ম্লান করে দিয়েছে। কচুরিপানায় ছেয়ে রয়েছে মৃতপ্রায় নরসুন্দা নদী। এর তীরে এসে দাঁড়ালাম আমরা। এবার সাকিব চৌধুরী গান ধরল—‘আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি/ তুমি এ ঘাটে লাগায়া নাও/ লিগুম কথা কইয়া যাও শুনি...’। গানটা শেষ হতেই জিজ্ঞাসা, কোথায় নাও দেখলে যে এক্ষণে এ গান ধরলে? ও একটু হেসে—মুড এলো, তাই গাইলাম। 
এবার সাকিব চৌধুরী বলতে শুরু করল : ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব তীরে সমৃদ্ধ জনপদ এই কিশোরগঞ্জ। এখানের প্রামাণিক পরিবারের প্রয়াত কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের ষষ্ঠ ছেলে নন্দ কিশোরের ‘কিশোর’ ও তারই প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় হাট বা গঞ্জের ‘গঞ্জ’ যোগ হয়ে কিশোরগঞ্জ নামকরণ হয়েছে। জানেন, এই জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে পুরনো ব্রহ্মপুত্রের মেঘনা, ধলেশ্বরী, কালনী, ধনু, নরসুন্দা, মগরা আর বাউলাই নদী। 
গুরুদয়াল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। শৈশবে কতই না নাম শুনেছিলাম এই কলেজের। ওখানেই দেখা হয়ে গেল এক বৈষ্ণবীর সঙ্গে। তার কণ্ঠে ছিল ‘আমার গলার হার খুলে নে ওগো ললিতে/ আমার হার পরে আর কি ফল হবে সখি/ প্রাণবন্ধু নাই ব্রজেতে...।’
গানটা শুনে যে মুগ্ধ হতেই হলো। বৈষ্ণবকে ‘নমস্কার’ জানাতে যে বাধ্যই হলাম। পাগলা মসজিদ দেখার পর চললাম হজরত নগরের দেওয়ান বাড়ি দেখতে। মনে হলো অতীতের সেই ঐতিহ্য ম্লান হতে চলেছে বুঝি আজ। সবই যেন পুরনো পুরনো হয়ে গেছে।
সাকিব চৌধুরী বলল, চলুন পাতোয়াইর গ্রামে গিয়ে চন্দ্রাবতীর মঠ দেখি। ওখানে গিয়ে দেখলাম, মঠের দেয়ালে অসংখ্য পোড়া মাটির অলঙ্করণ রয়েছে। যা কিনা মঠটিকে সুশোভিত করে তুলেছে। জানলাম, মধ্য যুগের প্রখ্যাত কবি দ্বিজ বংশী দাসের মেয়ে তথা বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী এই মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই গ্রামেই চন্দ্রাবতীর জন্ম। চন্দ্রাবতীর নামে একটি স্কুল দেখলাম। সেখানে গিয়ে একজন বৃদ্ধের মুখে শুনলাম, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মিত এখানে শিব মন্দিরে বসে কবি চন্দ্রাবতী পূজা-অর্চনা করতেন আর রামায়ণ লিখতেন। চন্দ্রাবতী ছিলেন চিরকুমারী। ছোটবেলার খেলার সঙ্গী জয়দেবের সঙ্গে তার গভীর প্রেম ছিল। তার সঙ্গে বিয়ে না হওয়ার কারণেই চন্দ্রাবতী আর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি। কথাগুলো শুনে এসে দাঁড়ালাম ফুলেশ্বরী নদী তীরে। তখন দু’নয়ন সমুখ পানে তাকিয়ে থাকা, বাহ কতই ভালো লাগছে। ভাবলাম, কতই না সুন্দর কিশোরগঞ্জ। হঠাত্ কানে ভেসে এলো ‘সাঁঝের বেলা জলের ঘাটেরে/ পায়ের নূপুর খইসা যায় হে নাগর। ছেড়ে দে কলসী আমার যায় বেলা...।’ যিনি এ গানটি গাইলেন তিনি আমাদের দেখামাত্রই দ্রুত পায়ে হেঁটে বনপথের মাঝ থেকে দূরে চলে গেলেন। সেই রূপসীর হাতে দেখেছিলাম, বকুল ফুলের মালা। তখনি মনে পড়ল ‘নিভিয়া ছিল মনের আগুন/জ্বালাইয়া গেলে প্রাণ কোকিলারে... আমায় এত রাতে কেন ডাক দিলি প্রাণ কোকিলারে...’ গানের কথাগুলো। 
পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের গেস্ট রুমে ফিরে এলাম। আজিজ সাহেব বললেন, চলুন ভাটির দেশ দেখতে। ৪০ মিনিট পর এলাম তাড়াইলে। যেদিকে চোখ যায় দেখি নদী-হাওর-বিল। ছোট ছোট লঞ্চ, নৌকা চলছে দূর অজানার দেশে। ওখানে গিয়ে জানলাম, ছোট ছোট লঞ্চ, ইঞ্জিনচালিত নৌকা যায় দূরে বহু দূরে সুনামগঞ্জের দিকে। শুধু তাই নয়—অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ইটনার দিকেও চলাচল করে কত না নৌকা আর ছোট ছোট লঞ্চ। আমরা নৌকায় গিয়ে বসলাম। বিশাল বিশাল নৌকা, এর মধ্যে ঘুমানোরও ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। সাকিক চৌধুরী বলল, কয়েক ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে নৌকাতে ঘুরে বেড়াব। চলুন হাওর এলাকা ঘুরে দেখি। নৌকা চলছে হাওরের নৌপথ ধরে। নৌকায় বসে দেখছি দু’কূলের দৃশ্য। যেদিকে চোখ যায়, দেখি সবুজ শ্যামলিমা রূপ। সে রূপে যে মুগ্ধই হতে হলো। মাঝি গান ধরল—‘নদীর কূল নাই কিনারা নাইরে/আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাব কাহারে শুধাইরে... ওপারে মেঘের ঘটা ...।’
দু’নয়ন ভরে হাওর দেখার পর এলাম একটি খামারে। সেখানে তুষ পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হয়। খামারের মালিক জানালেন, হাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে তিনি বছরে ৫ লাখ টাকা লাভ করে থাকেন।
বিকাল ৪টার দিকে কিশোরগঞ্জ ত্যাগ করে চললাম ময়মনসিংহের দিকে। বাস চলছে, পেছনে ফেলে এলাম কিশোরগঞ্জ জেলা। সাকিব চৌধুরী বলল, ভ্রমণটা বেশ ভালোই হলো। মাছ আর মাছ খেয়ে মনটা যে তৃপ্তিতে ভরে থাকল। 
যারা কিশোরগঞ্জ যাবেন : ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ যাওয়ার জন্য আন্তঃনগর ট্রেন এগারোসিন্ধুর রয়েছে। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকাল সাড়ে ৭টায় ছেড়ে এটি বেলা সাড়ে ১২টায় কিশোরগঞ্জে গিয়ে পৌঁছে। মহাখালী থেকে ছাড়ে অনন্যা, ঈশাখাঁ পরিবহন। 
কিশোরগঞ্জে রাত যাপন করার জন্য রয়েছে ড্রিম হোটেল, গোলডেন ড্রিম, গাংচিল হোটেল, হোটেল তানিম, মোবারক হোটেল। 
২ থেকে ৩ দিন সময় হাতে নিয়ে কিশোরগঞ্জে বেড়াতে গেলে বেশ ভালোই লাগবে। এ ভ্রমণে জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা নিয়ে গেলেই চলবে।-ডিনিউজ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়