গাজীপুর: কবর জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, কোরআন খানিসহ নানা অনুষ্ঠান ও সর্বস্তরের মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় পালিত হলো প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটি উপলক্ষে নুহাশ পল্লীতে দোয়া ও ইফতারের আয়োজন করেন মরহুমের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।
শুক্রবার সকাল থেকেই ভক্তরা দলে দলে আসতে থাকেন স্যারের প্রিয় ঠিকানা নুহাশপল্লীতে। অনেকে আসেন হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে। হিমু বেশে কবর জিয়ারত করেন। অন্তর থেকে জানান ফুলেল শুদ্ধা। শ্রদ্ধা জানান বরেণ্য লেখক, প্রকাশক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ।
তবে শ্রদ্ধা ও মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করতে হুমায়ূনের প্রথম স্ত্রীর তিন সন্তান, তার মা আয়েশা ফয়েজ ও দুই ভাইবোনদের কাউকে দেখা যায়নি।
সকাল সাড়ে ১১টায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন হুমামূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। তার সাথে দুই শিশুপুত্র নিষাদ ও নিনিদসহ নুহাশপল্লীর কর্মচারি ও স্টাফরা। শাওন কবরের পাশে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। ফাতেহা পাঠের পর মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত করেন।
কবর জিয়ারত শেষে শাওন বলেন, হুমায়ূন আহমেদ সব সময় আনন্দের অনুষ্ঠান করতে পছন্দ করতেন। দু:খের কোনো অনুষ্ঠান করতেন না। এজন্য তার মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনো অনুষ্ঠান থাকছে না। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতে তার বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে অনাড়ম্বর মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করতেন। তিনি জন্মদিনের আয়োজনকে পছন্দ করতেন। উনি যেটা পছন্দ করতেন সেভাবেই নুহাশপল্লীতে ৪/৫শ’ এতিমের সঙ্গে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। একটি বছর শুধুমাত্র হিসেব করার দিনমাত্র।
আবেগঘন কণ্ঠে এসময় শাওন বলেন, ২০১২ সালের ১৯ জুলাইয়ের পর প্রতিটি মুহূর্ত একই রকম খারাপ। আজকের দিনটা আলাদা কোনো দিন না। আমার ছেলে যখন আমাকে প্রশ্ন করে বাবা কী এতগুলো ফুল নিতে আসবে, তখন আমার কোনো জবাব থাকেনা। তাই হুমায়ূনশূন্য প্রতিটা রাত প্রতিটি মুহূর্তের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা।
হুমায়ূন আহমেদের মা ও স্বজনরা অনুষ্ঠানে নেই কেনো এমন প্রশ্নের জবাবে শাওন বলেন, তাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছিল।
নুহাশপল্লীর ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বুলবুল জানান, হুমায়ূন আহমেদের কবর ঘিরে একটি কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে। এতে মূল কবর মার্বেল পাথর দিয়ে পাকা করার কাজ শেষ হয়েছে, যাতে ১৬ ফুট লম্বা ও ১২ ফুট প্রশস্ত সাদা মার্বেল পাথর বসানো হয়েছে। স্বামীর কবর জিয়ারত ও বাঁধাইয়ের কাজ তদারকির জন্য বুধবার মধ্যরাতেই নিষাদ ও নিনিতকে সাথে নিয়ে নুহাশ পল্লীতে এসে অবস্থান করেন শাওন।
সাইফুল ইসলাম জানান, কবরের চারপাশে চত্বর তৈরি করে কবর স্থান জেয়ারতের জন্য আলাদা দুটি প্রবেশ পথ রাখা হয়েছে। যারা শুধু কবর জেয়ারতের জন্য নুহাশপল্লীতে আসবেন তারা মূলগেইটের পশ্চিম পাশ দিয়ে কবর স্থানে যেতে পারবেন। আর নুহাশপল্লী পুরোটা দেখতে চাইলে দর্শনার্থীদের একটি নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে।
শ্রদ্ধা জানাতে আসেন হুমায়ূনের পারিবারিক বন্ধু ও প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। এসময় তার সাথে লেখক শাকুর মজিদ, অনন্যা প্রকাশনী, কাকলী, সময়, মাওলা ব্রাদার্স, প্রতীক, অবসর, বাংলা প্রকাশ, অন্বেশাসহ ১৫টি প্রকাশনীর লেখক ও প্রকাশকরা উপস্থিত ছিলেন। তারা হুমায়ূনের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার পর মোনাজাতে অংশ নেন।
মোনাজাত শেষে মাজহারুল ইসলাম বলেন, সৃজনশীল মানুষের মৃত্যু নেই। তারা তাদের কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকেন। হুমায়ূন আহমেদও তার সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
দুপুরের পর ফের মা শাওন ও অন্যান্য অতিথিদের সাথে কবর জেয়ারত করতে আসে শিশুপুত্র নিষাদ ও নিনাদ। নিষাদ কবরের কাছে বসে গভীর মমতায় কবরের ওপর হাত বুলাতে থাকে। এসময় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরে কচি দু’টো হাত তুলে প্রার্থনা করে নিষাদ।
নিষাদ জানায়, সে তার বাবাকে নিয়ে ছবি এঁকেছে এবং চিঠি লিখেছে। চিঠিতে কি লিখেছ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নিষাদ বলে ‘আই লাভ ইউ বাবা’।
শাওনের বাবা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরতে শাওন নাটক পরিচালনার পাশাপাশি আর্কিটেকচারের কাজও করছে। তিন বন্ধুর সঙ্গে গুলশানে ডটস লিমিটেড নামে একটি ফার্মও খুলেছে ৮-৯ মাস আগে। বইয়ের রয়্যালিটি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাঙালি একটি মেয়ের স্বামী মারা গেলে কেউ সহজভাবে নেয় না। তাকে বহু বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়। লেখকের একেক বই একেক জনের নামে স্বত্ত্ব দেয়া আছে। রয়্যালিটি পেতে তাই উভয়পক্ষকে একটি সমঝোতায় বসতে হবে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৬৪ বছর বয়সে গত বছর ১৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলা সাহিত্যের অসম্ভব জনপ্রিয় এ লেখক। ২৪ জুলাই তাকে গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে দাফন করা হয়।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় হুমায়ূন আহমেদ জম্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক হুমায়ূন সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলেন। ২০১১ সালে তার অন্ত্রে ক্যান্সার ধরা পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকবার অস্ত্রোপচার করার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়।
বাংলামেইল২৪ডটকম/
খবর বিভাগঃ
বিশেষ খবর
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়