Tuesday, July 16

নার্সারির আয় দিয়ে স্বাবলম্বী হতদরিদ্র রেবার মুখে দুঃখ জয়ের হাসি

আমতলী (বরগুনা) থেকে: হতদরিদ্র বিধবা রেবা (৪৫) হাজারো দুখের সিড়ি বেয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় নার্সারী করে তার চারা বিক্রি করে সে এখন স্বাবলম্বী।  গত ২ জুলাই সরেজমিনে গেলে তার দুখ জয়ের কথা বর্ণনা করেন এভাবে। বরগুনা সদর উপজেলার পূর্বগুদিঘাটা গ্রামের হতদরিদ্র মৃত.নওয়াব আলীর মেয়ে রেবা। একই উপজেলার যুগিরতবক গ্রামের সহায়সম্বলহীন খেজমত আলীর সঙ্গে ১৩/১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। বিয়ের তিন বছরের মাথায় আবু কালাম নামে একটি সন্তান কোলে আসে তার। টেনেটুনে চলছিল তিন জনের সংসার। দেড় বছর পর এক দিনের ডায়রিয়ায়ই অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় দিনমজুর স্বামী খেজমত আলী। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দু’চোখে হতাশার অন্ধকার দেখে রেবা। নিরাশা যেন গিলে খেতে চায় কিশোরী মাতা রেবাকে। একদিকে পেটে রাক্ষসী ক্ষুধার বিষ মাখা দাঁতের মরণ কামড়। অপর দিকে পেটের শাল শীর্ণকায় সন্তানের শুকনো মুখ। দিশেহারা হয়ে পরে সে। কোথায় যাবে। কার ছায়ায় নেবে ঠাঁই। নিরুপায় রেবা। 
স্বামীর শোক বুকে চেপে প্যারালাইসে আক্রান্ত হতদরিদ্র পিতা নওয়াব আলী খার ঘরে মাথাগোজার ঠাঁই খুঁজে নিতে বাধ্য হয়। ঢেঁকিতে পরের বাড়ির ধানভানা, থালাবাসন মাজা, যাতায় ডালভাঙ্গা, শিলনোড়ায় হলুদ-মরিচ পেষাসহ হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে দিনান্তে যা পায় সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে মুখে তুলে দেয় সারা দিন না খেয়ে থাকা শয্যাশায়ী পিতার মুখে। পুত্রের মুখে দুধের বোটা গুঁজে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়। আধোঘুমে মনে পড়ে বড় গিন্নির খিউর খিস্তি। তবুও ঘুমায় সে। পাখ-পাখালির ডাকে ভোর হয়। টের পায়না রেবা। অসুস্থ পিতার অস্পষ্ট ডাকে ঘুম ভাঙ্গে তার। ধরফরিয়ে তেলচিটচিটে বিছানা ছাড়ে সে। পাছে কাজে যেতে দেরি হয়। আবার শুরু হয় পরের বাড়ির হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। এটাই ছিল রেবার রোজনামচা। কয়েক বছর পরে অসুস্থ পিতাও চোখ বোজেন। ছোট ভাই আদম খা বোনকে একখন্ড বাড়ির জমি দেয়। ঘর তুলে সেখানেই ছেলে আবু কালামকে নিয়ে থাকে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ায় ছেলেকে। এরপর দিনমজুরী করে পরের বাড়িতে। এক সময় ছেলে বড় হয়। বিয়ে দিয়ে ঘরে বৌও আনে। একটি সন্তান হওয়ার পর লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয় আবু কালাম। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় শয্যাশায়ী হয়ে পরে সে। ছেলের বউ জাকিয়া (২২) একমাত্র শিশুপুত্র মারুফ (৭) ও স্বামীকে ফেলে বাবার বাড়ি চলে গিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে সংসারী হয়। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে রেবার মাথায়। নিত্যসঙ্গী অভাব আর শোকে দুঃখে জর্জরিত রাবেয়াকে দেখে বোঝা যাবে না তার বয়স ৪৫ বছর।  মনে হবে অনেক বেশী। এখন আর তেমন খাটতে পারে না। আবার অথৈ সাগরে ভাসতে থাকে সে। চেয়ে চিন্তে, গতর খেটে ছেলের চিকিৎসা করে আর চোখের জল ফেলে। বরগুনার স্থানীয় এনজিও জাগোনারীর রি-কল প্রকল্প গত ২০১১ সালের ২৭ নভেম্বর রাবেয়াকে সদস্য করে নেয়। নার্সারীর উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে ২০১২ সালের ২১ এপ্রিল ৯০০০/- (নয় হাজার) টাকার সার, বীজ, কিটনাশক, টালিসহ নার্সারীর প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হয় তাকে। কোন নগদ টাকাই দেয়া হয়নি তাকে। বাড়ির আঙিনায় সাত হাজার টালিতে রেন্ট্রি, মেহগিনি ও চাম্বলের চারা রোপন করে নার্সারি শুরু করেন রেবা। কাজে সহায়তা করে অসুস্থ ছেলে আবু কালাম। নার্সারি শুরুর ৫ মাস পর গত ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমবারে ৭৫ টি চারা ১ হাজার পাঁচশ টাকা বিক্রি করে রেবা। নগদ টাকা হাতে পেয়ে উৎসাহ বেরে যায় তার। নতুন উদ্যমে নার্সারির যতেœ আত্মনিয়োগ করেন তিনি। এবছর ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নার্সারী থেকে তার আয় হয় ৩২ হাজার ৩৭৫ টাকা। ইতোমধ্যে ৫ হাজার টায়  ১০ শতাংশের একখন্ড জমি পাঁচ বছরের জন্য বন্ধক রেখেছেন তিনি। সেখানে তিনি রেন্ট্রি ও মেহগিনির চারা করেছেন। এ চারাগুলো বড় হয়েছে। এ চারা বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা আয় হবে বলে জানান রেবা। এ ৫০ হাজার টাকা বাদেও তার হাতে নগদ ১২ হাজার টাকা আছে। রেবার মুখে এখন দুঃখ জয়ের হাসি। প্রত্যয়ের সুরে রেবা বলেন, এহন দুহেরে আর ডরাই না। কাজ করলে খাইয়া পইরা বাঁচন যায়। রেবার জানায় , তার একখানা রিকসা ভ্যান হলে চারা বাজারজাত করতে সুবিধা হয়। পরিবহন খরচও বাঁচে। আবু কালাম এখন সুস্থ। সে ভ্যানগাড়ি চালিয়ে আয়ও করতে পারত। রেবা আরও জানায়, তার কোন এনজিওর কিস্তি নাই। তিনি নার্সাারীর আয় দিয়ে চাষাবাদের জন্য একখন্ড নিজস্ব জমি, ভাল করে একটি টিনের ঘর তোলা এবং নাতি মারুফকে পড়াশুনা করিয়ে মানুষের মত মানুষ করতে চায়। রেবার সাফল্য দেখে কুদ্দুস, কবীরসহ এলাকার অনেকেই নার্সারী করতে উদ্যোগী হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থা অক্সফাম’র আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত জাগোনারীর রি-কল প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী  রামপ্রসাদ জানান, বরগুনা সদর উপজেলার গৌরীচন্না ও ফুলঝুড়ি ইউনিয়নের নয়শ’ হতদরিদ্র পরিবার এবং বেতাগী উপজেলার সড়িষামুড়ি, কাজিরাবাদ ও মোকামিয়া ইউনিয়নের এক হাজার একশ’ হতদরিদ্র পরিবারকে জীবনযাত্রারমান উন্নয়ন এবং স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে নার্সারি, হাঁস-মুরগী পালন এবং রিকসা ভ্যান দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, উপকারভোগীদের হাতে কোন নগদ অর্থ দেয়া হয়না। প্রশিক্ষণের পর উপকরণ দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। -ডিনিউজ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়