Sunday, July 14

হারিয়ে যাচ্ছে আমতলী সহ-দক্ষিনাঞ্চল থেকে রাখাইন সম্প্রদায়

আমতলী(বরগুনা): সময়ের পরিবর্তন, বাঙ্গালী কর্তৃক জমি দখল, আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকা, ধর্মীয় ও নিজস্ব সংস্কৃতিক কাজে বাধাগ্রস্থ হওয়ার কারনে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে বরগুনা-পটূয়াখালীর আদীবাসী রাখাইন সম্প্রদায়। তবে এখনও যারা আছেন, তারা চেষ্টা করছেন বাঙ্গালীদের সাথে সমন্বয় করে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমুন্নত রেখে বসবাস করতে। বরগুনার তালতলী থানার রাখাইন নেতা মংতাহান বলেন, ১৯৬০, ৬৫ ও ৭০ এর বন্যায় অনেক পাড়া ধ্বংশ হয়ে যাওয়ায় এ এলাকার রাখাইন সম্প্রদায় অনেকটা বিলুপ্তি হয়ে গেছে। তাছাড়া বাঙ্গালীদের সাথে জমি-জমার বিরোধ, মামলার দীর্ঘ্যসূত্রিয়তা, আইন থাকলেও আইনের কার্যকরিতা না থাকা, নিজস্ব সংস্কৃতিতে কাজ করতে না পারায় আস্তে আস্তে রাখাইন সম্প্রদায় এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্তি হচ্ছে। বর্তমানে এ অঞ্চলের রাখাইনদের প্রধান দাবী হচ্ছে আদীবাসী হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষনা পাওয়া। 
তবে তালতলীর প্রবীণ ও সমাজসেবক মোঃ ফজলুল হক জমাদ্দার এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, এ অঞ্চলের রাখাইনরা এক সময় অনেক জমির মালিক ছিল। কিন্তু তারা কর্মক্ষেত্রে ছিল অলস। যার কারনে লেখা-পড়াও করত না এবং কোন কাজ না করে জমি বিক্রি করে সংসার চালাতো। অনেকে ৩০-৪০ বছর আগে জমি বিক্রি করে গেছে। এখন আবার এখানে ফিরে এসে বিক্রিত জমি দাবী করায় বাঙ্গালীদের সাথে মামলা-হামলাসহ বিভিন্ন ঝামেলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রাখাইন ও বাঙ্গালী উভয়েই দায়ী। তবে রাখাইন সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যেও বিরোধ রয়েছে বলে তিনি দাবী করেন। বর্তমানে রাখাইনরা আগের চেয়ে কর্মঠো এবং লেখা-পড়ায় মনযোগী হয়েছে বলেও তিনি জানান।১৭৮৪ইং থেকে ১৯০০ইং পর্যন্ত বৃটিশ শাসনামলে বরগুনা সদর থানা, আমতলী এবং পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানা ও গলাচিপা থানায় ২শ’ ৩৭টি পাড়ায় ৫০ হাজারের উর্ধ্বে রাখাইন সম্প্রদায় ছিল। ১৯০০ থেকে ১৯৪৮ ইং সাল পর্যন্ত বৃটিশ শাসন ও পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব মুহুর্তকাল ১শ’ ৬৮টি পাড়ায় ৫ হাজার ১৯০টি বাড়ীতে ৩৫ হাজার (আনুমানিক) রাখাইন সম্প্রদায় বসবাস করছিল। এরপর ১৯৪৮-১৯৯১ পাকিস্তান শাসনামল ও বাংলাদেশ স্বাধীনতা উত্তরকাল ৪৭টি পাড়ায় ৫শ’ ১৫টি বাড়ীতে ৩ হাজার ৫০০ লোক ছিল। ১৯৯১-২০১১ পর্যন্ত ৪৭টি পাড়ায় ৬শ’ ১৭টি বাড়ীতে ৪ হাজার ৫০০ রাখাইন সম্প্রদায় (আনুমানিক) বসবাস করছে। 
দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা সমুদ্রøাত বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলাদ্বয়ের রাখাইন জনপদ গড়ে উঠে আকর্ষণীয় ধর্মীয় সামাজিক এক ভিন্নধারা সংস্কৃতির জীবন্তরূপ। ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখার জন্য তারা কালজয়ী বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ মূর্তিসহ স্থাপন করে রেখে গেছেন। এ সকল মন্দির ও বৌদ্ধ মূর্তির সম্মুখে বর্তমান প্রজন্মের রাখাইন বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রতিদিন পূজার অর্ঘ্য দান পূর্বক ‘‘ সবে সত্তা সুখীতা হোন্ত’’ এই শ্লোকটি উচ্চারণ করে জগৎময় সুখ-শান্তির প্রার্থনা করে থাকে। 
শত বছরের পুরাতন এ সকল বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ মূর্তিসমূহ বর্তমানে পুরাকীর্তির নিদর্শন হিসেবে অত্যন্ত মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ যা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অমূল্য রতœ বটে। শত বছর পূর্বে বার্মার রাজধানী মান্দালে হতে ৭৫মন ওজনের শ্বেত পাথরের বৌদ্ধ মূর্তি বরগুনার তালতলী থানার অংকুজানপাড়ায় প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে । বাংলাদেশে এত বড় শ্বেত পাথরের বৌদ্ধ মূর্তি আর কোথাও নাই বলে এ এলাকার রাখাইন সম্প্রদায় দাবী করেন।
এছাড়া পটুয়াখালী জেলার সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার সন্নিকটে মিশ্রি পাড়ায় ইটপাথরের গড়া মূর্তি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ মূর্তি। কুয়াকাটায় অষ্ট ধাতুর সংমিশ্রিত ব্রোঞ্জ বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। খাপড়াভাঙ্গায় দু’শত বছর পূর্বে ম্রাচা চৌধুরীর স্থাপিত খাপড়া বৌদ্ধ মন্দির এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় অন্যান্য স্থাপত্য দেশি বিদেশিদের নিকট দর্শনীয় বস্তু হিসেবে খ্যাত। তাছাড়াও বরগুনার তালতলীতে ছোট-বড় ১৪টি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে।এক সময়ে রাখাইন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ বরগুনার তালতলী থানার বড়বগী ইউনিয়নের একাধিক বার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। যাদের মধ্যে রয়েছে- অংথুন তালুকদার (১৯৬১-৬৬), অংকুজান মাষ্টার (১৯৬৬-১৯৭২), অংথুন তালুকদার (১৯৭২-৭৩)।
রাখাইন সম্প্রদায়ের মাতৃভাষায় অস্তিত্বহুমকির মুখে:
রাখাইন সম্প্রদায়ের মাতৃভাষায় অস্তিত্ব আজ হুমকির মূখে । এ প্রজন্মের আদিবাসী রাখাইন শিশুরা মায়ের মুখ ও তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে শুধু মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও লিখতে ও পড়তে পাড়ছে না । পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও আর্থিক দৈন্যতার কারনে তাদের মাতৃভাষায় লেখা ও পড়া শেখানোর বিদ্যালয়গুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে । স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৭৮৪ সালে রাখাইনদের মাতৃভূমি বার্মার মিয়ানমার আরাকান রাজ্যে সৃষ্টি হলে সেখান থেকে ১৫০টি পরিবার নৌকাযোগে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দেয়। ওই সময় তারা সমুদ্র উপকূলবর্তী কলাপাড়া ,রাঙ্গাবালি,গলাচিপা,ও বরগুনা জেলার তালতলী থানাকে বসবাসের স্থান হিসাবে বেছে নেয় ।ওই রাখাইন পরিবাগুলোতে জন্ম নেয়া শিশুরা মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে মাতৃভাষায় কথা বলতে শেখে । এ জন্য প্রায় প্রতিটি পাড়ায় একটি করে রাখাইন ভাষায় পরিচালিত বিদ্যালয় গড়ে ওঠে । ওই সময় পটুয়খালী ও বরগুনা জেলায় প্রায় ৫০টি বিদ্যালয় পরিচালিত হতো তাদের নিজস্ব অর্থায়নে ।রাখাইন শিশুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যায়ের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে মাতৃভাষা শিখতে রাখাইন বিদ্যালয়ে যেত। বিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হতো রাখাইন ভাষার বর্ণমালা ,রাখাইন ,সংখ্যা সাতবার ও বারো মাসের নামসহ রাখাইন ভাষার বিভিন্ন ধরনের ছড়া আর কবিতা । এ ব্যাপারে আদিবাসী রাখাইন নেতা উসুয়ে হাওলাদার জানান ,রাখাইন ভাষায় শিক্ষা দানের শিক্ষকের অভাব দেশে পাঠ্য পুস্তক ছাপা না হওয়ায় বই সংকট ছাড়াও বই প্রকাশ ,সরকারের সহযোগিতার  অভাবে পিছিয়ে পড়ছে রাখাইন শিক্ষা বিদ্যালয়গুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যায় । ফলে রাখাইন পরিবারগুলো  তাদের শিশুদের মাতৃভাষায় লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । কলাপাড়ার পক্ষিয়পাড়ার রাখাইন নেতা চিং থাউয়ের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জানান , সরকারি বেসরকারি অর্থ সহায়তা ও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে রাখাইন মাতৃ শিক্ষা কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এ করনে নতুন প্রজন্মের রাখাইন শিশুরা মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও লিখতে ও পড়তে পারছে না । বিগত সরকার রাখাইনদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য কুয়াকাটায় রাখাইন কালচারাল একাডেমীর জন্য একটি দ্বিতল ভবন নির্মান করে স্থানীয় রাখাইন আবাসিক হোটেল হিসাবে কুয়াকাটায় আগত দর্শনার্থীদের ভাড়া দেয়া হয়। এদিকে স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা কুয়াকাটা ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (কেডিএন)  নিজস্ব অর্থায়নে ওই এলাকায় রাখাইন পাড়ায় তিনটি বিদ্যালয় পরিচালনা করছে বলে সংস্থার কর্মকর্তারা দাবি করেন।-ডিনিউজ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়