Tuesday, July 9

ঈদের পর কাউন্সিল: বিএনপির মহাসচিব পদ ঘিরে ‘দুই’ ধারা

ঢাকা : স্থগিত হয়ে যাওয়া কাউন্সিল করার তোরজোর শুরু হয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিতে। ইতোমধ্যে কাউন্সিল প্রস্তুতির উপ-কমিটিগুলোকে সক্রিয় করা হয়েছে। ঈদুল ফিতরের পরপরই এই কাউন্সিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কাউন্সিলে গণতান্ত্রিক রীতি মেনে ভোটের মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব ঠিক করা হয়। আর এই নেতৃত্ব নিয়ে বিএনপিতে দুটি ধারার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে মহাসচিব পদ নিয়ে এই ধারার সৃষ্টি হয়েছে। সরাসরি জ্যেষ্ঠ নেতারা এ নিয়ে মুখ না খুললেও দুটি বলয়ের কথা তারা স্বীকার করেছেন।

জরুরি জমানা শেষে ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে। আর ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর সর্বশেষ বিএনপি তাদের কাউন্সিল করে। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) অনুযায়ী ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বিএনপির কাউন্সিল করার কথা ছিল।

তবে এক আবেদনে নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে কাউন্সিলের জন্য চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। এরপর ১৯ মার্চ কাউন্সিলের দিনক্ষণ ঠিক করেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তা স্থগিত করে বিএনপি।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে দল সুসংহত করতে কাউন্সিল করা হবে। তাছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) অনুসারেও এটির বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

তারা বলেন, ঈদুল ফিতর শেষেই যাতে কাউন্সিল করা যায়, সেভাবেই দলে প্রস্তুতি চলছে। আশা করছি, এবার সঠিক সময়েই কাউন্সিল করা সম্ভব হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের পর স্বল্পপরিসরে কাউন্সিল করার চিন্তা-ভাবনা করছে বিএনপির হাই-কমান্ড। সেটি আগের মতো জাঁকজমকপূর্ণ না হয়ে অনেকটা বর্ধিত সভার মতো হবে। তবে কাউন্সিলরদের গোপন ভোটেই নেতৃত্ব ঠিক করে শুধুমাত্র ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হবে।

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ে সারা দেশের তৃণমূল নেতৃত্বে চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বিএনপি এখন ঐক্যবদ্ধ। সুতরাং ঘটা করে কাউন্সিল করতে গিয়ে নতুন করে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব তৈরির কোনো মানে নেই।

এছাড়া শেষ সময়ে সরকারও বিরোধী দলের প্রতি আরো হার্ড-লাইনে থাকবে। নেতৃত্ব নিয়ে যাতে সরকারের বাড়তি নজরে পড়তে না হয়, সেজন্যই এই স্বল্পপরিসরের কাউন্সিল করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।

গত ৫ মে মতিঝিল শাপলা অভিযানে হেফাজত হটানোর পর সরকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরপর বিএনপি অনেকটাই দৃশ্যের আঁড়ালে চলে যায়। এখন পরপর ৫টি সিটিতে বিশাল বিজয়ের পর তারা আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করছে। আর এ নিয়ে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও নির্দেশনা দিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে তিনি আন্দোলন এবং নির্বাচন- দুই পথে এগোনোর নির্দেশনা দিয়েছেন।

কাউন্সিল ঘিরে খালেদা জিয়া খুব সাবধানে পা বাড়াচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তিনি চাচ্ছেন না দলে গ্রুপিং তৈরি হোক। বরং আরো কত দক্ষভাবে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করা যায় সেদিকেই তিনি এগোচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘আগামী রমজান মাসকে আমরা সাংগঠনিক মাস হিসেবে ঘোষণা করেছি। এই সময়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ যেসব সমস্যা রয়েছে তা নিরসন করা হবে। কারণ এখন থেকেই জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থী ঠিক করতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধ্যকতা থাকায় ঈদুল ফিতরের পর নামকাওয়াস্তে দলীয় কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’

এছাড়া রমজানের মধ্যে যুবদল, কৃষক দল, মৎসজীবী দল ও মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন করা হতে পারে বলেও জানান স্থায়ী কমিটির এই নেতা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঈদুল ফিতর পরবর্তী দু-এক সপ্তাহের মধ্যে স্বল্পপরিসরে বিএনপির কাউন্সিল করা হবে। এতে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাই-কমান্ড। তবে দলের আরেকটি শক্তিশালী পক্ষ এতে আপত্তি জানিয়েছে। তারা এই পদে মির্জা ফখরুলের বিকল্প চান। চেয়ারপারসনের খুবই ঘনিষ্ঠ হওয়ায় খালেদা জিয়া তাকে মির্জা ফখরুলের বিষয়ে ইতিবাচক চিন্তা করার পরামর্শ দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে মেনে নিতে তিনি এক প্রকার নির্দেশও দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

চেয়ারপারসনের নির্দেশ বিষয়ে তারেক রহমানের ঘনিষ্টজন বলে পরিচিত ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা বলেন, ‘তারেক রহমান মহাসচিব পদে বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ কাউকে চাইছেন। এক্ষেত্রে তার প্রথম পছন্দ স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য তরিকুল ইসলাম।’

এ নিয়ে তারেক রহমান তরিকুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে কথাও বলেছেন। তবে অসুস্থতাজনিত কারণে তরিকুল ইসলাম তার প্রস্তাবে রাজি হননি। সূত্রের দাবি তরিকুল ইসলাম তারেক রহমানকে বলেছেন, ‘এখন যে দায়িত্বে আছেন, তাই তিনি বেশ উপভোগ করছেন। তাছাড়া মির্জা ফখরুল দলকে সুসংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন। সুতরাং তার বিকল্প না ভাবাই যুক্তিযুক্ত হবে।’

জানা গেছে, মহাসচিব পদে ব্যক্তিগতভাবে খালেদা জিয়ার পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি ইতোমধ্যে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। এছাড়া রাজনৈতিক মহলে মির্জা ফখরুলের একটি ইতিবাচক ইমেজ রয়েছে বলে মনে করেন খালেদা জিয়া।

আসন্ন কাউন্সিলে মহাসচিব পদ ছাড়াও সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে রদবদলের আভাস পাওয়া গেছে। জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির প্রবীন সদস্য এম. শামসুল ইসলাম অসুস্থ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মানবতাবিরোধী অপরাধে জেলে থাকায় তাদের স্থানে ভাইস-চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা ও আবদুল্লাহ-আল নোমান কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

এর বাইরে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্যকে ভাইস-চেয়ারম্যান করা হবে। পরিবর্তন আসতে পারে দলের যুগ্ম মহাসচিব পদেও। বর্তমান যুগ্ম মহাসচিব ও দপ্তর সম্পাদক রহুল কবির রিজভীকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা হতে পারে। আরেক যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহানকে কেন্দ্রীয় কমিটির আরো উপরের দিকে নিয়ে আসার চিন্তা করছে হাই-কমান্ড।

নতুন করে যুগ্ম মহাসচিব পদে আসতে পারে বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবুর রহমান সারোয়ার ও যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।

এছাড়া কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন নিস্ক্রিয় সদস্যদের সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। এই তালিকায় বর্তমান কমিটি অন্তত শতাধিক সদস্য রয়েছেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাজপথে সক্রিয় থাকা আন্দোলন-সংগ্রামীদের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন খালেদা জিয়া।

বরিশালের মেয়র আহসান হাবিব কামাল গুলশান অফিসে শুভেচ্ছা জানাতে এলে  সম্প্রতি বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ‘আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া এবং অংশ নেওয়া নেতাকর্মীদের শিগগিরই দলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসানো হবে।’

কাউন্সিল নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আন্দোলনের কৌশল হিসেবে বিএনপি সিটি করপোরেশনগুলোতে অংশ নিয়েছে। আন্দোলনের কৌশল বাস্তবায়নেই ঈদের পর দলের কাউন্সিল করা হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বে পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। প্রবীনরা সরে যাবেন নতুনদের জন্য। এবারের কাউন্সিলেও তার ব্যতিক্রম হবে না।’

তবে মোশাররফ বলেন, ‘সবকিছুই নির্ভর করছে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। আগামী নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে এবং দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এমন সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই আমরা নিব না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘কাউন্সিল যেকোনো সময়ই হতে পারে, সে ধরনের প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। তবে এখনই সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ বলা সম্ভব নয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্যকতা থাকায় মূলত কাউন্সিল করতে হচ্ছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কী আর পরিবর্তন আসবে? মির্জা ফখরুল সাহেবকে যিনি ওই পদে বসিয়েছেন, তিনিই সিদ্ধান্ত নিবেন মহাসচিব পদে উনি এখন থাকবেন কি, থাকবেন না। উনি ছাড়া তো আর কোনো প্রার্থীও দেখছি না।’

এর আগে কাউন্সিল সফলভাবে করতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নয়টি উপ-কমিটি করেন। তিনি নিজে কমিটিগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন। আর শীর্ষনেতাদের আহ্বায়ক করেন।

অভ্যর্থনা বিভাগ উপ-কমিটির আহ্বায়ক করা হয়, দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। আর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ পান নিরাপত্তা ও সেবা উপ-কমিটির দায়িত্ব। এছাড়া মির্জা আব্বাস ব্যবস্থাপনা উপ-কমিটি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রচার, আবদুল আওয়াল মিন্টু অর্থ, আবদুল্লাহ-আল নোমান প্রকাশনা, সাদেক হোসেন খোকা আপ্যায়ন ও আবাসন এবং সাংস্কৃতিক উপ-কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, ‘নানান মানুষ নানান মত, দেশ বাঁচাতে ঐক্যমত’ স্লোগানে বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিলে বেগম খালেদা জিয়াকে চেয়ারপারসন এবং খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিব নির্বাচিত হন। এরপর খোন্দকার দেলোয়ারের মৃত্যুর পর থেকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে আছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর প্রথম কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় কাউন্সিল হয় ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আর এর আট বছর পর ১৯৮৯ সালের ৮ ও ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় দলটির তৃতীয় কাউন্সিল। ১৯৯৩ সালের ১-৩ সেপ্টেম্বর বিএনপি তাদের চতুর্থ ও শেষ কাউন্সিল হয়। এরপর ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর হয় পঞ্চম কাউন্সিল।সূত্র: আরটিএন

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়