ঢাকা: নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। খোদ নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে শুরু করে আমজনতা পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। সবার মুখে একই প্রশ্ন, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, নির্বাচন কি হবে?
চায়ের টেবিল আর চলতি পথে অনেককেই বলতে শোনা যাচ্ছে, এ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের কয়েক মাস অর্থাৎ রমজানের পরে বাকি কয়েক মাস দুই দলের অনমনীয় অবস্থানের কারণে একটা ভজঘট পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ফাঁকতালে অন্য কেউ অবৈধভাবে ক্ষমতায় বসবে। আর না হলে অরাজক পরিস্থিতির কারণে নির্বাচন ঝুলে যাবে। নির্দিষ্ট সময়ে কিছুতেই নির্বাচন হওয়ার কোনো আলামত নেই।
এর পেছনে তাদের যুক্তি, ক্ষমতাসীন দল কিছুতেই ক্ষমতা ছাড়তে চাইবে না। কারণ, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে মানুষ এবার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। আর ক্ষমতা ছেড়ে ভোট দেয়া মানে আওয়ামী লীগের পরাজয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ এটা করবে না। অন্যদিকে বিএনপি তা মানবে না। মাঝখানে তাদের স্বার্থসংঘাতের বলি হবে সাধারণ মানুষ।
একই বিষয় নিয়ে দেশের সচেতন মহলও চিন্তিত। কারণ, এই সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, না কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা ভিন্ন কোনো পদ্ধতির অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এই অনিশ্চয়তা এখনো ঘোঁচেনি, সহজে ঘুঁচবে বলেও মনে হচ্ছে না।
গত শনিবার আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। একই সাথে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হবে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে। আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ক্ষমতার পরিবর্তন হবে।’
অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এর পরপরই গত সোমবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে এক ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়ে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঈদের পর রাজপথে নামতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না।’
বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দলের প্রধানের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্য মানুষের মনে নির্বাচন নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সংশয় তৈরি করছে বলেও মনে করেন অনেকেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনিশ্চয়তার কারণে চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে বাস-ট্রেন সবখানে একই আলোচনা- আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে কি হবে না?
এদিকে ইসি সূত্রে জানা যায়, বিধান অনুসারে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের শেষ সময়। সে অনুযায়ী চলতি বছরের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করতে হবে।
দেশের বড় দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থান আর সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি না থাকার কারণে নির্বাচনের সময় যত কাছে আসছে ততই জনমনে সংশয় তৈরি হচ্ছে।
আগামী নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আনোয়ার রাজু বাংলামেইলকে বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন গণতান্ত্রিক পন্থায়ই সম্পন্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনে অংশ নেবে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রত্যাশিত একটি রাজনৈতিক দলকে সরকার গঠনের জন্য রায় দেবে জনগণ। কিন্তু বিগত দিনে আমাদের দেশে যখনই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, নির্বাচনের সময় সৃষ্টি হয়েছে নানা জটিলতা। বিরোধীদলগুলো মেনে নিতে পারেনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই নানা অভিযোগ নিয়ে পরিচালিত হয় সরকার। এভাবেই কেটে যাচ্ছে এক একটি নির্বাচিত সরকারের মেয়াদকাল। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা সংশয়।’
রাজুর মতোই সংশয় প্রকাশ করে খুলনা বিএল কলেজের শিক্ষার্থী ফাতেমা ইয়াসমিন বাংলামেইলকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিপরীতমুখী অবস্থান দেখে দেশের মানুষ শঙ্কায় আছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে কি না।’
তিনি বলেন, ‘আজ দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের কাছে দেশের মানুষ পদদলিত হচ্ছে। দু’দলকে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন যেন না থাকে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সার্বিক উন্নয়নের কথা নতুন করে ভাবতে হবে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল উভয়কেই। না হলে নির্বাচন নিয়ে জনগণের শঙ্কা কাটবে না।’
দেশের স্বার্থে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসা উচিৎ বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা। তাদের দাবি, দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে একে অন্যের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি করছে। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থার যদি সুযোগ তৈরি না হয়, তাহলে আবারও ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
তারা বলছেন, নির্বাচনের সময় যতই কাছে চলে আসছে ততই সংশয় তৈরি হচ্ছে। কোন স্বার্থে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথাকে বাদ দিয়েছে? ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে জাতীয় স্বার্থকে অবশ্যই উভয় নেত্রীর প্রাধান্য দিতে হবে।
বর্তমানে সরকার যদি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয় তবে গণন্ত্রত ব্যাহত হবে, সংঘাতের সৃষ্টি হবে। তাই কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আশ্রয় না নিয়ে যদি উভয় দল দেশের স্বার্থে সংলাপে বসে, তাহলে অবশ্যই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমরা ক্ষমতাসীন দলের কাছে এমন কিছু আশা করবো না, যার কারণে বিরোধী দল বারবার আন্দোলনের নামে হরতাল, ভাঙচুর করার সুযোগ পায়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী, বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ক্ষমতাসীন দল বলছে, উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাতিল হয়ে গেছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা। আগামী নির্বাচনে তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বিরোধী দল বলছে, কোনও অবস্থাতেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না তারা। যে কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
এ সঙ্কটের প্রশ্নে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সিএম শফি সামি বাংলামেইলকে বলেন, ‘গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতায় আসা দরকার। দেশ ও জনগণের কল্যাণের কথা মনে রাখতে হবে।’
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিরাজমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে জনগণ উদ্বিগ্ন। এছাড়া সঠিক সময়ে নির্বাচন হবে কি না এটা নিয়েও একটা সংশয় কাজ করছে।’
নির্বাচন নিয়ে জনমনে সংশয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘বিএনপি সব সময় নির্বাচনমুখী দল। আমরা চাই নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী দলই ক্ষমতায় বসবে। আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আগামী নির্বাচন নিয়ে সঙ্কট তৈরি করেছে।’
আওয়ামী লীগ বলছে ‘গণতান্ত্রিক ধারায় আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে’ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ দেশের জনগণ এটা কখনো হতে দেবে না। যে কোনো মূল্যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রতিহত করা হবে।’
প্রধান দুই দলের পরস্পর বিরোধী অবস্থানে আগামী জাতীয় নির্বাচন সঠিক সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহম্মদ নাসিম বাংলামেইলকে বলেন, ‘নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে এবং আগামী জানুয়ারির মধ্যেই হবে। সংবিধানের ধারা অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
তত্ত্বাবধায়কের দাবি আদায়ে ঈদের পর রাজপথে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এসব হুমকি দিয়ে লাভ হবে না। আমরাতো পাঁচ বছর ধরে দেখে আসছি। এসব হুমকি-ধামকিতে কোনো কাজ হবে না।’
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি বিশ্লেষক ড. মিজানুর রহমান শেলী বাংলামেইলকে বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। যে কারণে ঘনীভূত হচ্ছে রাজনৈতিক সঙ্কট। যে কারণে আগামী নির্বাচন নিয়ে মানুষ সংশয় প্রকাশ করছে।’
প্রধান দুটি দলের মধ্যে সমঝোতা না হলে দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘দেশে কোনো ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হলে জনগণই তো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাতীয় জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসবে।’
উল্লেখ্য, সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে। নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। সে অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
বাংলামেইল২৪ডটকম
খবর বিভাগঃ
বিশেষ খবর
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়