Friday, July 19

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ১ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ এর ১ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ১৯ জুলাই ২০১৩ শুক্রবার । একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার এবং গীতিকার হিসাবে খ্যাত এই নন্দিত লেখক বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় লেখক হিসেবে পরিচিত। তাকে বলা হয়- বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের পথিকৃৎ। গত বছরের এই দিনে তিনি দূরারোগ্য ক্যান্সারের চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের শেখবাড়ি হিসাবে পরিচিত তার মামারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে। তাঁর পিতা ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। ফয়জুর রহমান আহমদ একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ এ পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন।

বাবার চাকুরি সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে লেখাপড়া করেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বিজ্ঞান শাখায় এইচএসসি পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি(সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন তিনি। পরে ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় একসময় অধ্যাপনা ছেড়ে দেন৷ শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাসের নাম নন্দিত নরকে। ১৯৭২-এ খান ব্রাদার্স থেকে সেটি প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষাশাস্ত্রের প্রখ্যাত পণ্ডিত আহমদ শরীফ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যামোদী মহলে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার। পরবর্তী জীবনে বিরামহীন লিখে গেছেন তিনি। তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্যে হচ্ছে- তিনি অনায়াসে ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে অতিবাস্তব ঘটনাবলীর অবতারণা করতেন যাকে একরূপ যাদু বাস্তবতা হিসেবে গণ্য করা যায়। তাঁর গল্প ও উপন্যাস সংলাপপ্রধান। তাঁর বর্ণনা পরিমিত এবং সামান্য পরিসরে কয়েকটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে চরিত্র চিত্রণের অদৃষ্টপূর্ব প্রতিভা ছিল তাঁর। অনেক রচনার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির ছাপ লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস মধ্যাহ্ন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত। এছাড়া জোছনা ও জননীর গল্প আরেকটি বড় মাপের রচনা যা ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধকে অবলম্বন করে রচিত।

এছাড়া তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে: দেয়াল, এইসব দিনরাত্রি, সংসপ্তক, দূরে কোথাও, সৌরভ, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরীপুর জাংশান, নৃপতি(নাটক), বহুব্রীহি, আশাবরি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, নিশীথিনী, আমার আছে জল, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, আকাশ ভরা মেঘ, মহাপুরুষ, শূন্য, ওমেগা পয়েন্ট, ইমা, আমি এবং আমরা, কে কথা কয়, অমানুষ (অনুবাদ), অপেক্ষা, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, পেন্সিলে আঁকা পরী, অয়োময়, কুটু মিয়া, দ্বিতীয় মানব, ইস্টিশন, মধ্যাহ্ন, মাতাল হাওয়া, শুভ্র গেছে বনে, ম্যজিক মুনসি', আমরা কেউ বাসায় নেই, মেঘের ওপর বাড়ি, এপিটাফ। হিমু সংক্রান্ত তার উপন্যাসগুলো বাংলা সাহিত্যের পাঠক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে তরুণরা লুফে নিয়েছে তার হিমু সিরিজের প্রতিটি উপন্যাস। এর মধ্যে রয়েছে: ময়ুরাক্ষী, দরজার ওপাশে, হিমু, হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম, এবং হিমু, পারাপার, হিমুর রুপালী রাত্রি, একজন হিমু কয়েকটি ঝিঝি পোকা, হিমুর দ্বিতীয় প্রহর, তোমাদের এই নগরে, সে আসে ধীরে, আঙ্গুল কাটা জগলু, হিমু মামা, হিমুর বাবার কথামালা, হিমুর নীল জোছনা, হিমুর আছে জল, হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী, হলুদ হিমু কালো র‌্যাব, আজ হিমুর বিয়ে, হিমু রিমান্ডে, হিমুর মধ্যদুপুর, চলে যায় বসন্তের দিন, হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য, হিমু এবং হার্ভার্ড Ph.D.বল্টুভাই। হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি জনপ্রিয় সিরিজের নাম মিসির আলি। তার মিসির আলী সংক্রান্ত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে: দেবী, নিশিথিনী, নিষাদ, অন্যভুবন, বৃহন্নলা, ভয়, বিপদ, অনীশ, মিসির আলির অমিমাংসিত রহস্য, আমি এবং আমরা, তন্দ্রাবিলাস, আমিই মিসির আলি, বাঘবন্দী মিসির আলি, কহেন কবি কালিদাস, হরতন ইশকাপন, মিসির আলির চশমা, মিসির আলি!আপনি কোথায়?, মিসির আলি আনসলভ, যখন নামিবে আঁধার। হুমায়ূন আহমেদের আত্মজৈবনিক রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে: বলপয়েন্ট, কাঠপেন্সিল, ফাউন্টেইন পেন, রংপেনসিল, নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ, হোটেল গ্রেভার ইন, আমার ছেলেবেলা, হিজিবিজি।

১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য নাটক রচনা শুরু করেন তিনি। এটি তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। তার অন্যতম ধারাবাহিক নাটক -এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবার, তারা তিনজন, আমরা তিনজন, মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছার স্বাগতম। পরবর্তীতে তিনি বহু প্যাকেজ নাটক নির্মাণ করেছেন।

টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শক-নন্দিত নাটক রচনার পর হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। ২০০০ সালে শ্রাবণ মেঘের দিন ও ২০০১ সালেদুই দুয়ারী চলচ্চিত্র দুটি প্রথম শ্রেনীর দর্শকদের কাছে দারুন গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৩-এ নির্মান করেন চন্দ্রকথা নামে একটি চলচ্চিত্র। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মান করেন শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রটি। ২০০৮-এ পরিচালনা করেন আমার আছে জল নামে একটি চলচ্চিত্র। ২০১২ সালে তার পরিচালনার সর্বশেষ ছবি।

সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও পদক। এর মধ্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, শিশু একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসুদন পদক, বাচশাস পুরস্কার, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার অন্যতম।

হুমায়ূন আহমেদের অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং দেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী ও কথাসাহিত্যিক এবং কনিষ্ঠ ভাই আহসান হাবীব একজন রম্য সাহিত্যিক ও কার্টুনিস্ট।

১৯৭৩ সালে গুলতেকিন আহমেদকে বিয়ে করেন হুমায়ূন আহমেদ। এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। তিন মেয়ের নাম বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। ২০০৫ সালে গুলতেকিন আহমেদের সংগে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তার দুই ছেলের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।

ঢাকা শহরের ধানমন্ডীর ৩/এ রোডে নির্মিত দখিন হাওয়া নামে একটি বাড়িতে বসবাস করতেন হুমায়ূন আহমেদ। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে ৯০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছিলেন স্বপ্নের বাগান বাড়ী 'নুহাশ পল্লী। মৃত্যুরে পর নূহাশ পল্লীতেই শেষ শায়িত হন তিনি।

 বাংলা সাহিত্যে, নাটকে, চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদ চির স্মরণীয় এবং বরণীয় হয়ে থাকবেন।

(সহায়ক সূত্র : উইকিপিডিয়া)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়