মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন : ঢাকায় নেমেই শুনি বঙ্গবন্ধু আজই ফিরছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে, তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে। সারা দেশের মানুষ এ প্রহরটির অপেক্ষায় ছিল। আমাদের মানুষের কাছে এতোদিন স্বাধীনতা যেন অপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধু ফিরলেই সেটা পূর্ণতা পাবে। সবার চোখে মুখে তখন আনন্দ উল্লাস। কখন ফিরবেন বঙ্গবন্ধু, এ অপেক্ষায় নগরবাসী, দেশবাসী প্রহর গুনছে। সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমান বন্দর থেকে ৩২নং ধানমন্ডির অভিমুখে সড়কের দুই পাশে সারি সারি মানুষ দাঁড়িয়ে, এক পলক তাঁকে দেখার জন্য। আবার অনেকে জড়ো হয়েছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, ঘোষণা রয়েছে বঙ্গবন্ধু সেখানে সমবেতদের উদ্দেশে ভাষণ দিবেন। আমি ঠিক করলাম, আমি প্রথমে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফিরব। কিছুটা পথ রিক্শায় ও অনেকটা পথ হেঁটে হলে পৌঁছলাম। দেখি হলে ভারতীয় সেনাদলের একটি ইউনিট অনেকগুলো কক্ষে অস্থায়ী আস্তানা করেছে। সৌভাগ্যক্রমে দেখলাম আমার ৩৫২নং কক্ষটি কেউ দখল করেনি তবে দরজাটি হাট করে খোলা। আমি আমার কক্ষে প্রায় ১০ মাস পর ঢুকলাম এবং হাত ব্যাগটি রেখে একটা দড়ি দিয়ে দরজার কড়া বেধে সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম রেসকোর্সের উদ্দেশে। রেসকোর্সে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান তেজগাঁওতে অবতরণের পর তিনি তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদসহ অন্যান্য নেতা নেতৃবৃন্দদের নিয়ে রেসকোর্সে তাঁর নিজের মানুষের কাছে এলেন। এ এক অভূতপূর্ব আবেগময় মহামিলনের দৃশ্য। বঙ্গবন্ধু যেমন আবেগ ধরে রাখতে পারছিলেন না তেমনি অজস্র জনতার চোখও অশ্র“সিক্ত হয়ে উঠছিল। ৭ই মার্চ ’৭১-এর পর আবার আমি ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ ইতিহাসের সাক্ষী হলাম।
সন্ধে বেলা ফিরে এলাম আবার হলে। কক্ষে বিছানাপত্র কিছু নেই। ঐ সন্ধ্যেতেই দেখা হলো আমার এক সহপাঠীর সঙ্গে। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। সেও আজই ঢাকায় ফিরেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা। ফেনীর যুদ্ধে সে বীর বিক্রমে লড়াই করেছে। এখন আবার ফিরেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা দুজন ঐ রাত্রে একত্রে থাকলাম। তার কক্ষে তারই বিছানায়। দুই তিন দিনের ভিতর ভারতীয় সেনা ইউনিট হল ছেড়ে চলে গেল। কিছু দিনের মধ্যেই হল আবার তার চির পরিচিত রূপে ফিরে আসতে লাগল। এই অবরুদ্ধ নয় মাসে যারা হলে রয়ে গিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ করেছে, লক্ষ্য করলাম আমাদেরকে দেখে তাদের ভিতর হীনমন্যতা কাজ করছে। অনেকের চোখে মুখে আতঙ্কের ছায়া। বিশেষ করে ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করে ফিরেছি, আমাদের প্রায় সবার মধ্যেই অনেক পরিবর্তন এসেছে লক্ষ্য করলাম। চুল বড়ো, অনেকের দাঁড়ি। রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণ প্রায় সবার। প্রায় সবাই সিগারেট ধরেছে এবং কথাবার্তায় আগের চেয়ে অনেক সপ্রতিভ। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি তারা আমাদেরকে একটা আলাদা সমীহের ভাব দেখাতো। আমাদের যে কোনও প্রয়োজনে তারা কাজে লাগতে পারলে ধন্য মনে করত নিজেদেরকে।
লক্ষ্য করলাম এদের মধ্যেও দুটি ভাগ রয়েছে। একদল যাদের কোনও উপায়ন্তর ছিল না অথবা সবকিছু ছেড়ে দিয়ে যোগদানের সাহস পায়নি কিন্তু মনে প্রাণে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ছিল। আর অন্য দল যারা এর বিরোধী মূলত ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত আমরা একদিন সভা করলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যরা যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতা করেছে, পাক বাহিনীকে সহায়তা করেছে বা শিখণ্ডি সরকারের কাজে সহায়তা করেছে তাদেরকে হলে থাকতে দেয়া হবে না। আমাদের পরবর্তী সভায় এ ধরনের ১৪ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলো। অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ এসেছে হলের সাধারণ ছাত্রদের ও হলের কর্মচারীদের কাছ থেকে। আমরা ঐ ১৪ জনকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হল ছাড়ার নোটিশ দিলাম। হল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানার পর তারা আমাদের সাথে কথা বললেন এ বিষয়ে আইনানুগ অন্য কোনও ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। আমরা বললাম, আইন তার নিজস্ব পথে চলবে, কিন্তু আমরা মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের সাথে, আলবদরের সাথেÑ যারা আমাদের শিক্ষকদের হত্যা করেছে, যারা আমাদের অনেক বন্ধুকে পাক বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিয়েছে, এক সঙ্গে থাকতে পারব না।
প্রাণ রসায়নে আমার ব্যাচেরও একজন ছিল ঐ ১৪ জনের মধ্যে। ওদেরকে যেদিন আলটিমেটাম দেয়া হলো, সেদিনই গভীর রাতে আমার ঐ সহপাঠী খুবই সন্তর্পণে আমার কক্ষে ঢুকল, আলতো করে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে আমার দুটি পা ধরে তাকে বাঁচানোর জন্য কাকুতি মিনতি করতে লাগল। মুক্তিযুদ্ধের এই নয় মাসে রাজাকার, আলবদরদের যে অত্যাচার, হিংস্রতা আমি দেখেছি, তাতে তার এই ক্ষমাভিক্ষার আবেদন আমার মনে একটুও চিড় ধরাতে পারল না। আমি তাকে স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিলাম, এ ক্ষেত্রে ক্ষমার বা অনুকম্পার কোনও সুযোগ নেই। ঐদিন ভোরেই সূর্য উঠার পূর্বে সে হল ছাড়ল। তার সঙ্গে প্রায় ৩০ বছর পরে একবার দেখা হয়েছিল, সে আরেক কাহিনী।
সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকা। ক্রমে অফিস আদালত উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। সরকারের কাছে নেই অর্থ, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে ভঙ্গুর। রাত হলেই অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যায়। হঠাৎ করে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়ে নাগরিক জীবনে একটি অস্বস্থিকর অবস্থা। আমেরিকা, চীন ও আরব রাষ্ট্রসমূহ তখনো স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সকল দেশের কাছে সহমর্মিতার হাত বাড়ানোর অনুরোধ জানালেন। অনেক দেশ সাহায্যের হাত বাড়াল। তার মধ্যে ভারত ও রাশিয়া এগিয়ে এলো আন্তরিকভাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকার তাদের সাহায্য কাজে লাগালেন। ততোদিনে রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটে গেছে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে পার্লামেন্টারী ধরনের সরকার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী (প্রবাসী সরকারের) তাজউদ্দিন আহমেদ অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম বাজেট ঘোষণা করলেন। মনে পড়ে ঐ বাজেটে কিভাবে দেশকে ক্রমে আত্মনির্ভরশীল করে তোলা যাবে তার একটা দিকনির্দেশনা ছিল। বঙ্গবন্ধু এ সময় বিভিন্ন জনসভায় জনগণকে দেশগঠনে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানালেন। ঐ সময় তিনি বলতেন ‘আগামী ৩ বছর আমি কিছু দিতে পারব না। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে, কষ্ট করতে হবে। আমরা সবাই মিলে দেশটাকে গড়ে তুলতে পারলে পরবর্তী প্রজন্ম এর সুফল পাবে।’
এ সময় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর সরকারের ওপর প্রবল চাপ। চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও আমেরিকা বাংলাদেশকে তখনো মেনে নিতে পারছে না। বঙ্গবন্ধু যদিও বলছেন, আমার পররাষ্ট্রনীতি হবে স্বাধীন, সবার সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব থাকবে। তাতেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না। আরব রাষ্ট্রসমূহ চাপ দিতে থাকল পাকিস্তানকে স্বীকৃতি প্রদানের। চীনও তাতে ইন্ধন জোগাল। দেশের ভিতরে যারা তখনো স্বাধীন বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি সে ধরণের কতিপয় উগ্রপন্থী চীনের অনুসারী সমাজতন্ত্রী গ্র“প, গোপনে লিফলেট বিলির মাধ্যমে প্রচার করতে লাগল, এ সরকার ভারত ও রাশিয়ার তাবেদার রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে, আরেকটি বিপ্লবের মাধ্যমে এই তাবেদারির হাত থেকে আমাদের জনগণকে রক্ষা করতে হবে। এরা তখনো খুবই ক্ষুদ্র শক্তি, কিন্তু প্রায়শই ঐ ধরনের প্রচার পুস্তিকা, লিফলেট চোখে পড়ত।
এমনিতরো রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু দু’টি খুবই দূরদর্শী ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন। এক মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ এবং দুই, ভারতীয় বাহিনীকে সসম্মানে ফেরত পাঠান। এ দুটো কাজ সম্পন্ন করা, আমি এখন মনে করি, বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়দিন বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল। ঐ সময় মুজিববাহিনীর জন্যও একটি দিন নির্ধারিত ছিল। পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সে অনুষ্ঠান। আমি আমার সুনামগঞ্জের ইউনিটসহ সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলাম। আমরা তো আগেই অস্ত্র জমা দিয়ে দিয়েছি। তাই ঐ দিন জমা দেয়ার রশিদ আবার হস্তান্তর অনুষ্ঠানে অর্পণ করলাম। যে সব ইউনিট আগে জমা দেয় নাই তারা ঐ দিন তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজির ছিল মাঠে। মনে পড়ে এ ধরনের অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানের সব শেষেরটি হয়েছিল কাদেরিয়া বাহিনীর, যার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।
আন্তর্জাতিক চাপে ও কুচক্রীমহলের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর সরকারে পরিবর্তন এলো ’৭৩-এর দিকে। প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া তাজউদ্দিন আহমদকে কোণঠাসা করা হলো। আমরা লক্ষ্য করলাম, সরকারে ডানপন্থীদের প্রভাব ক্রমে বাড়ছে। খন্দকার মোশতাকের প্রভাব বাড়ছে। বিষয়টি আমাদের কাছে ভালো ঠেকতো না। মুক্তিযুদ্ধ করে আসা ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যেও বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে গেল। এক দল চায় বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডা আঁকড়ে থাকবেন, আরেক দল দক্ষিণপন্থা, তাদের বক্তব্য বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সমাজতন্ত্রী নয় উদার নীতির গণতন্ত্র হতে পারে নতুন এই সরকারের চালিকা শক্তি। ’৭৩-এর ছাত্রলীগ সম্মেলনে ছাত্রলীগের বিভক্তি হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু উদারনৈতিক গণতন্দ্রের পক্ষের অংশের সম্মেলনে যোগ দিলেন। অন্য গ্র“পটি আ.স.ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে আলাদা সংগঠনে রূপান্তরিত হলো। সিরাজুল আলম খান ছিলেন এই গ্র“পের নেপথ্যে রাজনৈতিক গুরু। তারা দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন, এই ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করলেন।
তারাই পরবর্তীকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল ঐ সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। এই সংগঠনটি জন্মের শুরুতেই অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা পেতে লাগল। তাদের জনসমাবেশে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। আমি তখনো হলে থাকি। প্রচ্ছন্নভাবে নতুন দলটির বক্তব্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ছি। লক্ষ্য করছি, দেশে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের নির্বিচার পীড়ন ও লুন্ঠণ তার অন্যতম কারণ। ফলে আইন শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের যে আকাক্সক্ষা ছিল তার সঙ্গে এখন হিসাব মিলছে না। মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধু আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ‘রক্ষী বাহিনী’ নামে একটি প্যারা-মিলিটারি বাহিনী গঠন করলেন। তাতে তিনি নিয়োগ দিলেন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের যুব ক্যাডারদের। হিতে বিপরীত হলো এতে। সারা দেশ এই রক্ষী বাহিনীর অত্যাচারে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাতে কর্ণপাত করলেন না।
রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ দুটি ঘটনা ঘটল এসময়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ পরাজিত হলো। অন্যদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ ভাবে জয়ী হলেও অনেক আসনে কারচুপি করে তাদের নেতৃবৃন্দকে বিজয়ী করা হয়েছে বলে পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক সমালোচনা হলো। বিশেষ করে দাউদকান্দির আসন থেকে খন্দকার মোশতাক পরাজিত হয়েছিল বলে জনমনে ধারণা। নির্বাচন পরবর্তী আওয়ামী লীগ ও সরকার স্বৈরতন্ত্রী হয়ে উঠল এবং এই ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্য একটি নতুন ধরনের সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আওয়ামী লীগের চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে গেল।
রাজনৈতিক দল হিসেবে তখন ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি থাকলেও মূল বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখা যেত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)কে। ’৭৪-এর দিকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো খারাপ হতে শুরু করল। দেশে তখন প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্তা বিরাজ করছে। আমাদের হলের উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে আমরা বুভুক্ষুদের কাড়াকাড়ি দেখেছি। অসংখ্য কঙ্কালসার মানুষের দেহ পথে পথে পড়ে থাকতে দেখেছি ঐ সময়, যারা খাবারের অভাবে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। পুরো ’৭৪ই মানুষের খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে গেছে। রাজনৈতিকভাবেও যেন জনজীবন অবরুদ্ধ। এমনি অবস্থায় সর্বত্রই একটা চাপা উত্তেজনা। ‘রক্ষীবাহিনী’র এই দমন পীড়ন আর তারা সইতে পারছে না। তারা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে কিছু মানুষ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে, আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। এই ক্রম অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে উগ্র বামপন্থী ও উগ্র ডানপন্থীরা ক্রমে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত তখন। সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি থানা লুটের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহের অভিযানে নেমে পড়ল এবং তাদের থানা লুটের ঘটনা ক্রমে বেড়েই চলল। অন্যদিকে ডানপন্থী উগ্রবাদী (যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যাদের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ) ধর্ম গেল বলে চিৎকার শুরু করে দিল। এদের কাজকর্ম চলল মূলত গোপন লিফলেটের মাধ্যমে। অবশ্য প্রধান বিরোধীতাকারী দল তখনো একমাত্র জাসদ। তাদের জনসমর্থনও তখন ব্যাপক। ঐ সংগঠনটি তখন বিশ্বাস করত বিপ্লব করে ক্ষমতা দখল ছাড়া এই স্বৈরতন্ত্রী সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না।
তারা ঐ সময় হঠাৎ করেই কর্মসূচি নিল সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাড়ি ঘেরাওয়ের (পরবর্তীকালে তা হঠকারি বলে প্রমাণিত হয়েছে)। হাজার হাজার উৎসাহী সমর্থক জনতা নিয়ে ঘেরাও কর্মসূচি শুরু হলো। চারিদিক থেকে সমর্থক জনতা মন্ত্রীপাড়ার দিকে ছুটছে। আমি ও আমার আরো বন্ধুদের সাথে রেসকোর্সের ভিতর দিয়ে ঘেরাও অভিযানে ছুটে চলেছি। হঠাৎ করেই দেখি, চারিদিক থেকে জনতার ছোটাছুটি। ধর-পাকড় চলছে নির্বিচারে এবং সরকারের বাহিনী ফাঁকা গুলি ছুড়ছে। লক্ষ্য করছি, প্রমত্ত জনতা এ সব উপেক্ষা করেও এগিয়ে চলেছে। তারপর শুনছি চিৎকার, গুলির শব্দ, আহাজারি। আমি তখন থেমে গেলাম, আর এগুলাম না। প্রায় ১ ঘণ্টা পর হলে ফিরলাম। রাতে খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমার দুজন বন্ধু পাকড়াওয়ের মধ্যে পড়েছে। তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। রাতের মধ্যে খবর পেলাম, ভয়েস অব আমেরিকাতেও শুনলামÑ এই অসফল অভিযানে পুলিশের গুলিতে ৪ জনের মৃত্যু, অসংখ্য আহত এবং সব বড় নেতৃবৃন্দসহ অসংখ্য কর্মী গ্রেফতার হয়েছে। সেদিন রাতেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই হঠকারি রাজনীতির সঙ্গে আজকে থেকেই আমার সংশ্রব শেষ।
রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তখন বলদর্পী সরকার ও তার পেটোয়া বাহিনীসমূহের যথেচ্ছাচার। সর্বত্রই অসন্তোষ বিরাজ করছে যেন একটা বিস্ফোরণোম্মুখ পরিবেশ। এই প্রেক্ষাপটে লোকমুখে শুনেছি ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির পরামর্শে বঙ্গবন্ধু সব দল মিলে একটি একক পার্টি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তখনকার অবস্থা এমন ছিল যে, লোকজন একটি পরিবর্তন চাইছিলÑ তবে তা একক পার্টি গঠনের মাধ্যমে নয়। বঙ্গবন্ধু সম্ভবত এই প্রথম মানুষের চাওয়া পাওয়া ঠিকমতো বুঝতে পারলেন না। তিনি একক পার্টি ‘বাকশাল’ গঠন করলেন এবং জেলায় জেলায় তার পছন্দের ব্যক্তিদের গভর্ণর নিয়োগ করলেন। সর্বদলীয় গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হয়ে গেল।
এ সময় মাঝে মাঝেই সেনাবাহিনীতে অসন্তোষের খবর পাওয়া যেত। তার কারণ ছিল মূলত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা কর্মকর্তাদের সাথে পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা সেনা কর্মকর্তাদের সিনিয়ারিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব। শুনতাম, মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ সরকারের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছে। এ সবই ছিল উড়ো খবর। আমরা এসব খরবকে খুব একটা পাত্তা দিতাম না। আমার বন্ধু আনোয়ার এসব খবর আমাদের শোনাত। তার ভাই কর্ণেল তাহের তখন সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে অন্যত্র কাজ করছেন। আনোয়ারের মুখ থেকে আরো শুনেছিলাম ঐ সব অসন্তুষ্ট মাঝারি পর্যায়ের অফিসারের একটি দল বঙ্গবন্ধুর কাছে তাদের একটি পরিবারের এক সদস্যের বিরুদ্ধে অন্যায় অত্যাচারের অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সে বিষয়টিকে কোনও গুরুত্ব দেননি।
অন্যদিকে জাসদ রাজনৈতিকভাবে চরম মার খেয়ে প্রকাশ্যে তাদের তৎপরতা কমিয়ে দিয়েছে। তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে ‘গণবাহিনী’ গঠন করে তাদের বিপ্লবের স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। আনোয়ার ঐ সংগঠনের একজন সক্রিয় নেতা হিসাবে কাজ করছিল তখন। তার কাছে থেকে আমি তাদের সংগঠনের খবরাখবর পেতাম। সে আমাকেও তাদের সংগঠনের একজন মনে করত। যদিও আমি তখন প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একদিন সে আমাকে বলল, ‘গণবাহিনী’ সেনাবাহিনীর মধ্যে কাজ করছে। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে তারা এই বক্তব্য পৌঁছাতে চেষ্টা করছে যে, বৃটিশ কলোনিয়েল সিস্টেমে স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনী চলতে পারে না। এ বাহিনী হবে চীনের সামরিক বাহিনীর মতো একটি গণবাহিনী। এখানে অফিসার ও সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক থাকবে না। সাধারণ সৈনিক অফিসারদের বুট পরিষ্কার করবে না। তারা শান্তির সময় উৎপাদনশীল কাজ করবে। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে। সে একদিন এ ধরনের বক্তব্য সম্পর্কিত একটি লিফলেট আমাকে দেখাল, যা সব ক্যান্টনমেন্টে বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টেই এ নিয়ে তখন উত্তেজনা বিরাজ করছিল- যদিও এ ধরনের খবরাখবর বাইরে খুব একটা আসত না।
তারও কিছু দিন পর আনোয়ার জানাল, বিপ্লবের পাথে তারা অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গিয়েছে। জাসদের গণবাহিনী এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টেই 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ একই সঙ্গে বিদ্রোহ ঘটিয়ে ক্যান্টনমেন্টসমূহের কমান্ড তাদের অনুকূলে নেবে এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কমান্ডের রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকবে ‘জাসদ’। এ সব শুনে আমি শিহরিত হয়ে উঠতাম, রোমাঞ্চও লাগাত। চে গুয়েভরা, ফিদেল ক্যাস্ট্রোদের বিপ্লবের কথা কল্পনায় ভাসত।
দেশের রাজনৈতিক মঞ্চ তখন নিরুত্তাপ। মাঝে মাঝে মাওলানা ভাসানী হুঙ্কার দেন এবং তা ঐ পর্যন্তই। আওয়ামী লীগের দৌরাত্ব্য তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। কারো টু শব্দটি করার সাহস নেই, এমনি দমবন্ধ অবস্থা। এমনি অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের তারিখ ঘোষিত হলো ’৭৫-এর ১৬ই আগস্ট। আমি তখনো হলে থাকছি বন্ধু জুলফিকারের রুমে ডাবলিং করে। কেননা আমি তখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নই। ’৭৪-এর শেষ দিকেই ছাত্রত্ব শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চাকরি করছি। জুলফিকার আমারই ব্যাচমেট। একবার ড্রপ করার কারণে সে তখনো ছাত্র। বেতনের পয়সা বাঁচানোর জন্য অন্যত্র না থেকে তার রুমেই ডাবলিং করে থাকি। সমাবর্তনের তারিখ ঘোষণা ও এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আসবেন এ কারণে সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সাজ সাজ রব। হলে হলেও এর তোড়জোড়। সমাবর্তন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হলো। এই নিরাপত্তার আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হলসমূহ থেকে অছাত্রদের বের করে দেওয়া হলো। বাধ্য হয়ে ১৪ই আগস্ট হল ছেড়ে তোপখানায় আমার এক বন্ধুর মেসে উঠলাম।
১৫ই আগস্ট ভোরের দিকে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন বেতারে শুনি মেজর ডালিমের কণ্ঠ। উদ্ধত কণ্ঠে সে বলছে, ‘স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে উৎখাত করা হয়েছে। দেশ এখন ভারতীয় আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত। এখন দেশ সত্যিকারের স্বাধীন হয়েছে।’ আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আমার বন্ধুটি তখন ঘুম থেকে মাত্র জেগে উঠেছে। সেও তা শুনে হতবাক। গত রাতে কিভাবে কী ঘটেছে তার কোনও কিছুই মাথায় আসছে না। হঠাৎ করে মাথায় এলো তবে কি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এ কাণ্ড ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে? আমি চিৎকার করে উঠলাম এবং এখন কী হবে সেই ভাবনায় আরো অস্থির হয়ে গেলাম। বন্ধুটির মেস থেক বের হয়ে দেখি সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছে। কোথাও কোনও প্রতিরোধ বা মিছিল কিছুই নেই। ভাবলাম, প্রেসক্লাবের দিকে যাই। আমার এক বন্ধু শামসুদ্দিন তখন গণকণ্ঠ পত্রিকায় কাজ করে। প্রেসক্লাবে গিয়ে তাকে পেয়ে যাই। সে জানাল, সেনাবাহিনীর কিছু সংখ্যক মাঝারি অফিসার গত রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাদের অধীনস্থদের নিয়ে প্যারেডের নামে বের হয়ে একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, শেখ মণি ও সেরনিয়াবতের বাড়ি আক্রমণ করে এবং এসব বাড়ির সবাইকে র্নিবিচারে হত্যা করে। তারা রেডিও স্টেশন ও বঙ্গবভনও দখল করে। সংখ্যায় তারা খুব একটা বেশি নয়, তবে সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের তারা জিম্মি করে রেখেছে। সে আমাকে আরও বলল, অবস্থা এখনো থমথমে। কখন কী হয় বলা যায় না। সে আমাকে আবার মেসের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাবার পরার্মশ দিল।
ফেরার পথে বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনের সামনে মাত্র তখন এসেছি, দেখি বিরাট একটি শেভ্রলেট গাড়ি পতাকা শোভিত হয়ে বঙ্গভবনের দিকে যাচ্ছে। খন্দকার মোশতাককে তার বিখ্যাত টুপি ও আচকান পরিহিত অবস্থায় দেখলাম ঐ গাড়িতে। সঙ্গে আরো একজন সম্ভবত মাহবুবুল আলম চাষী। বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার হলো। এসব মাঝারি অফিসাররা তাহলে মোশতাকের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। আবারো প্রশ্ন জাগলো মনে, মোশতাক কি এতোটা নির্মম হবে যে তার ক্ষমতা আরোহণের জন্য বঙ্গবন্ধুর গোটা পরিবারকে সে নির্বংশ করতে বলবে। তাহলে কিভাবে এবং কারা তা সংঘটিত করল। তবে এ বিষয় আর কোনও সন্দেহ থাকল না যে গোটা পরিকল্পনায় মোশতাক ও তার কিছু বিশ্বস্থ অনুচর জড়িত ছিল। বিশ্বাসঘাতক মোশতাক বঙ্গবন্ধুকেসহ পরিবারে হত্যাকারী বিদ্রোহীদের ‘সূর্য সন্তান’ হিসেবে আখ্যা দিল।
সন্ধ্যায় টেলিভিশনে দেখছি সেনানায়ক জেনারেল শফিউল্লাহ ও অন্যান্যরা মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসাবে অভিন্দন জানাচ্ছেন এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের নিয়ে মোশতাক তার মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। তারা শপথ নিচ্ছেন। তখনও বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সব সদস্যের লাশ সৎকারের অপেক্ষায়।
দেশের মানুষ যেন অধিক শোকে কাতর হয়ে পড়েছে। স্তব্ধ হয়ে গেছে। সবাই যন্ত্র হয়ে গেছে, যেন কারো কোন অনুভূতি নেই। লক্ষ্য করলাম, বিশ্বাসঘাতক কুখ্যাত মোশতাকের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান নেই। আরও নেই তখনকার জনপ্রিয় যুবনেতা আবদুর রাজ্জাক বা তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ। সম্ভবত মোশতাক তাদের রাজি করাতে পারেন নাই অথবা মোশতাকের অধীনে সরকারে যোগ দিতে তাদের সম্ভ্রমে বেধেছে। তবে মোশতাক তাদেরকে শান্তিতে থাকতে দেয় নাই। গ্রেফতার করে সবাইকে জেলে পাঠিয়েছে।
মোশতাকের সরকারকে সঙ্গীন উচিয়ে পাহারা দিচ্ছে বিদ্রোহীরা যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবং নতুন সরকার বানিয়েছে। এরা থাকছে বঙ্গভবনে। সেনাবাহিনীর কোনও কমান্ড তারা মানছে না। মোশতাক সরকার যেন তাদের হাতের পুতুল। এমনি অবস্থায় অবাক বিস্ময়ের মতো লক্ষ্য করলাম চীন ও সৌদি আরব যারা এতোদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নাই তারা স্বীকৃতি দিয়ে বসেছে। হায় রে রাজনীতি! মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী যারা এতোদিন গর্তে ছিল তারা বেরিয়ে এলো রাজপথে। হঠাৎ করে রাস্তায় দাঁড়ি, টুপি পরিহিত মানুষের সংখ্যা রেড়ে গেল। সবই যেন অদ্ভুতুড়ে। এই পরিবর্তনে ও নতুন সরকার গঠনে তাদের উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো। তারা যেন মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পেরেছে।
বিদ্রোহী সেনাদের দাপটে সেনাবাহিনীর শীর্ষেও পরিবর্তন হলো। জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হলো। তিনি শীর্ষে আসীন হয়ে সেনাবাহিনীতে আইন আর কমান্ড প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন। বিদ্রোহীদের সঙ্গে একটি আপোষ রফার ব্যবস্থা করলেন। আপোষ রফার অংশ হিসাবে তাদেরকে সরকারের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হবে। তারা আপাতত দেশের বাইরে চলে যাবে। দেশে স্থিতি অবস্থা ফিরে আসার পর তাদেরকে আবার দেশে ফিরিয়ে এনে সম্মানের সঙ্গে পুনর্বাসিত করা হবে।
ঘন ঘন বৈঠকের মাধ্যমে যখন আপোষ রফা চুড়ান্ত, তখন সেনাবাহিনীর কেন্দ্রে ৩রা নভেম্বর ঘটল আরেকটি অভ্যুত্থান। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য দেশবাসীর কাছে পরিচিত জেনারেল খালেদ মোশাররফ যিনি সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন তখন, তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দি করলেন। খালেদ সেনাবাহিনী প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নিলেন। চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার অংশ হিসাবে বিদ্রোহীদের সারেন্ডার করার নির্দেশ দিলেন। ঢাকা শহরে ও সারা দেশে তখন থমথমে অবস্থা। লক্ষ্য করলাম, জেনারেল খালেদের ক্ষমতা গ্রহণকে সমর্থন জানিয়ে একটি বিরাট মিছিল সংঘঠিত হলো তার পরদিন। মিছিলটি বেশ বড়ো ছিল।
এই ৩রা নভেম্বরেই ঘটল ইতিহাসের অন্যতম হৃদয় বিদারক ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী বিদ্রোহীরা জেনারেল মোশাররফের কর্তৃত্ব না মেনে জেলের ভিতর ঢুকে বন্দি অবস্থায় হেফাজতে থাকা বঙ্গবন্ধুর অনুগত সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে আরেকটি কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি করল।
এর মাত্র ৩ দিন পরই ঘটল ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থান। জাসদের গণবাহিনী যারা সৈনিকদের মধ্যে সব ক্যান্টনমেন্টে কাজ করছিল, তারা ছিল ঐ অভ্যূত্থানের নায়ক। গণবাহিনী ঐ মুহূর্তটিকে তাদের অভ্যুত্থানের জন্য উপযুক্ত ক্ষণ হিসেবে এজন্য বেছে নিয়েছিল যে তারা ভেবেছিল খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে আবার আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় ফিরে আসবে এবং ভারতীয় ছত্রছায়ায় দেশ চলবে। সব ক্যান্টনমেন্ট থেকে সিপাহীরা এই বিদ্রোহে শামিল হলো। সাধারণ সিপাহী যারা সেনানায়কদের নির্দেশের আজ্ঞাবাহী, তারা সেদিন নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রতিরোধের। কারণ তাদেরকে বোঝানো হয়েছিল ক্ষমতার হাত বদলের পালা তাদের রক্তের ওপর দিয়ে হলেও তারা চিরকালই বঞ্চিত থেকে যায়। তাদেরকে সবাই ব্যবহার করে এবং কাজ শেষ হলে ছুড়ে ফেলে দেয়। তাদের উপলব্ধিতে এসব বিষয় ধরা পড়লেও তারা নিজেদের ভেতর ঐক্য ও প্রগতিশীল সংগঠনের অভাবে তারা এতোকাল কোনও কিছু করতে পারেনি। গণবাহিনীর ‘সৈনিক সংস্থা’ এই কাজটি করতে সক্ষম হয়েছে। এখন থেকে এই সেনাবাহিনী আর কলোনিয়েল সেনাবাহিনী থাকবে না। এর নেতৃত্বে ছিলেন কর্ণেল তাহের। এই অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফসহ তার অনুসারীরা নিহত হলেন। কর্ণেল তাহের সাধারণ সিপাহীদের সহায়তায় ৭ই নভেম্বর জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করলেন।
জেনারেল জিয়া মুক্ত হয়ে জাসদ নেতৃত্ব ও কর্ণেল তাহেরের কাছে তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তিনি তাদের সমর্থনও কামনা করলেন। তিনি বললেন যে, বিপ্লবী ধাঁচের একটি ছোট সরকার গঠন করবেন তাতে জাসদ ও গণবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তিনি আরো বললেন, তাঁর এই পরিকল্পনায় ব্যাপক জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশে একটি জনসভায় নতুন সরকারের রূপরেখা তুলে ধরবেন। তাঁর এই আশ্বাসে জাসদের ধারণা হলো তারা জিয়াকে দিয়ে তাদের বিপ্লবের দ্বিতীয় ধাপের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন। এ সময় কিছু দিনের জন্য হলেও তারা কিছুটা আত্মপ্রসাদে ভুগতে লাগলেন। জেনারেল জিয়ার সাথে শলা-পরামর্শ করে জাসদ অল্প কয়দিন পরই বায়তুল মোকাররমে একটি সভা আহ্বান করল। প্রচার করা হলো ঐ সভায় জেনারেল জিয়া ভাষণ দিবেন এবং তাঁর বিপ্লবী সরকারের রূপরেখা তুলে ধরবেন।
আমি যদিও তখন জাসদের রাজনীতিতে আর উৎসাহী নই তবুও বিরাট ঔৎসুক্য নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের বেশ আগেই ঐদিন সভাস্থলে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি তখনও নেতৃবৃন্দ আসেননি। একটু পরেই দেখলাম সভাস্থলের চারিপাশে পুলিশ গোয়েন্দাদের ভিড় বাড়ছে। তার অল্পক্ষণের মধ্যেই দেখি জাসদ নেতৃবৃন্দ আ.স.ম রব, শাহজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনু, আ.ফ.ম মাহবুবুল হক প্রমুখ এলেন। তবে লক্ষ্য করলাম, সবার চোখেমুখেই একটা উৎকণ্ঠার ছাপ। মাইকে তখনও ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, একটু পরই জেনারেল জিয়া সভাস্থলে আসবেন। সভার কাজ ততোক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। মাঝারি পর্যায়ের নেতারা তখন বক্তৃতা দিচ্ছেন। তারা উপস্থিত সমাবেশকে এই সফল বিপ্লবে জাসদের ভূমিকার কথা শোনাচ্ছেন। একই সঙ্গে বিপ্লব পরবর্তী এই সরকারে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের হাতে থাকবে বলে ঘোষণা দিচ্ছেন।
ঠিক এ রকম অবস্থায় সভাস্থলে হুড়মুড় করে সাধারণ পোশাক পরা গোয়েন্দারা ঢুকে পড়ল। তাদের সঙ্গে থাকল পুলিশ। চারিদিকে লাঠিপেটা শুরু করল এবং একটিা পর্যায়ে মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নিল। জাসদের বড় নেতারা বক্তৃতা দেওয়ার আগেই সভা পণ্ড হয়ে গেল। পুলিশের লাঠিপেটায় তখন সবাই তাদের নিজ নিজ প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। আমিও দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পালালাম। জাসদ নেতৃত্ব ও গণবাহিনী এই পরিস্থিতির জন্য সম্ভবত প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ করে নির্বিচারে ধরপাকড় শুরু হয়ে গেল। গণবাহিনীর নেতা কর্ণেল তাহের ও জাসদ নেতৃত্বের প্রায় সবাইকে তার অল্পদিনের মধ্যেই বন্দি করা হলো। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা করা হলো।
এরপর মোশতাক অবশ্য বেশিদিন আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। কিছুদিনের মধ্যে জেনারেল জিয়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করে একদিন মোশতাককে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করলেন। মোশতাকের জায়গায় জিয়ার তখন একজন রাষ্ট্রপতি পদধারী ব্যক্তি দরকার। প্রধান বিচারপতি সায়েমকে এ পদে বসান হলো। দেশ চলে জিয়ার কথায়। তিনি প্রথমে উপ-প্রধান সামরিক প্রশাসক হলেন, তারপর নিজে নিজেই হলেন প্রধান সামরিক প্রশাসক। একদিন মনে করলেন, অযথা রাষ্ট্রপতি পদে আরেকজনকে বসিয়ে রাখার কোনও মানে হয় না। তিনি তখন রাষ্ট্রপতি পদও গ্রহণ করলেন। একাধারে তিনি তখন রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক প্রশাসক ও সেনাবাহিনী প্রধান। এ ধরনের জগাখিচুরি রাষ্ট্র পরিচালনা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেছে কিনা সন্দেহ আছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে তাই ঘটল।
এ সময় আনোয়ার একদিন আমাকে আভাস দিল দেশের রাজনীতিতে খুব বড়ো ধরনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে শিগগির। তার সপ্তাহখানেক পর একদিন সে আমাকে বলল আগামীকাল অর্থাৎ পরের দিন বেতারে একটি ঘোষণা আসবে। আমি যেন এই ঘোষণাকে সমর্থন করে কার্জন হলে জাসদ-ছাত্রলীগের ছেলেদের নিয়ে একটি মিছিল করি। ঐ রাত্রে আমি আকাশ পাতাল চিন্তা করতে লাগলাম। মাথায় কিছুই আসছে না। সারা শরীরে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরদিন আমি জাসদ-ছাত্রলীগের কিছু ছেলেদের বলে রাখলাম, দুপুরের দিকে একটি মিছিল বের করার প্রয়োজন হতে পারে, তারা যেন তৈরি থাকে।
সকাল ১০টার দিকে আমি কার্জন হলে চলে আসি এবং অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি। বেলা ক্রমে দুপুর গড়িয়ে যায়। বেতারে কোনও ঘোষণা না আসায় ও সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে দেখে আমি ৩টার দিকে কার্জন হল ত্যাগ করে কমলাপুরে আমার মেসের উদ্দেশে রওনা দিই। (আমি তখন কমলাপুরে একটা মেসে থাকি। একই মেসে আমার সঙ্গে আমার বন্ধু নূরুল আবসার ও আনোয়ারও থাকে)। আমি মেসে পৌঁছে খাওয়া-দাওয়ার পর নূরুল আবসারকে সঙ্গে নিয়ে মেস সংলগ্ন একটি রেস্তোরাঁয় চা-পানের জন্য বসি। ঐ রেস্তোরাঁয় প্রায়শই আমরা তখন আড্ডা দিই। হঠাৎ দেখি, আনোয়ার এসে ঢুকছে। সে তখন রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় ফেরারী আসামী। ছদ্মবেশ নিয়ে থাকে। আমাদের টেবিলে এসে সে সন্তপর্ণে বলল, আমার ছোট দুই ভাইসহ মোট ৪ জন বিপ্লবী আজকে এক অপারেশনে শহীদ হয়েছে। তার এই ছোট দুইভাইকে আমি চিনতাম। আমি আঁতকে উঠলাম।
কিন্তু আনোয়ারের মধ্যে কোনও ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম না। বিপ্লবের জন্য কাউকে কাউকে শহীদ হতে হবে- এ যেন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তবে তার মধ্যে আমি চোয়ালবদ্ধ প্রত্যয় লক্ষ্য করলাম। আমার অবস্থা একটু স্বাভাবিক হলে সে আমাকে বলল, রিয়াজ তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমাকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, আজ দুপুরে ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে তার বাসা থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে হাইজাক করে জিম্মি করার একটি অপারেশন ছিল। সে জন্য আগে থেকে কয়েকবার ‘রেকি’ও করা হয়েছিল। কিন্তু আজ অপারেশনের মুহূর্তে পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় পরিকল্পনামাফিক অপারেশন পরিচালনা করা যায়নি। ফলে হাইকমিশনের নিরাপত্তা কর্মীদের গুলিতে আমাদের সদস্যরা মারা পড়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, অভিযান সফল হলে আমরা হাইকমিশনারকে জিম্মি হিসাবে সুন্দরবনে নিয়ে যাব। সে অনুযায়ী আমাদের প্রস্তুতিও ছিল। সুন্দরবনে নেয়ার পর তাকে জিম্মি রেখে আমরা আমাদের বন্দি নেতৃবৃন্দের নিঃশর্ত মুক্তির জন্য দর কষাকষি করতাম। আমি বললাম, তো আমাকে এখন কী করতে হবে? সে বলল, আমার ভাইদেরসহ সব শহীদের লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি তাদেরকে ঐ মর্গে বিপ্লবী অভিবাদন জানাতে চাই এবং এ কাজে তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন। আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, আমি কিভাবে তার সাহায্যে আসতে পারি? সে বলল, যে কোনও উপায়ে ঐ মর্গে গিয়ে লাশগুলো কোথায় কী অবস্থায় রেখেছে, সে তথ্য তাকে জানাতে হবে এবং তার জন্য একটা অ্যাপ্রন যোগাড় করে দিতে হবে। সে আরও বলল, সন্ধ্যার দিকে সে মেডিকেলের পাশে একটি দোকানে আমার অপেক্ষায় থাকবে।
আমার মানসিক অবস্থা তখন ত্রিশঙ্কু। একদিকে বন্ধুত্বের দাবি। অন্যদিকে সন্ত্রাসী হিসাবে ধরা পড়ার ভয়। আমি কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে থাকলাম। তারপর বললাম, দেখি কতদূর কী করতে পারি? তখনই মনে পড়ল, ঢাকা মেডিকেলের আমার বন্ধু কবিরের কথা। সে তখন ইন্টার্নী করছে। আমি দ্রুত তার হোস্টেলে গিয়ে তাকে পেয়ে গেলাম এবং তাকে আমার উদ্দেশ্য খুলে বললাম। সে বলল, আজ রাতে তার মর্গেই ডিউটি পড়েছে। একটু পরেই সে যাবে। আমি যদি ইচ্ছা করি তার সঙ্গে একটি অ্যাপ্রন পরে যেতে পারি। তবে একটা কথা সে আমাকে স্পষ্ট করে বলল, যদি আমি ধরা পড়ি, তাকে যেন কোনোভাবেই না জড়াই। আমি বললাম, ঠিক আছে। তারই একটা অ্যাপ্রন পরে আমি তার সঙ্গে রওনা দিলাম। ঐখানে পৌঁছে দেখি পুলিশ ও গোয়েন্দারা চারিদিকে গিজ গিজ করছে। একটু ভয় পেয়ে গেলাম এবং চিন্তা করে নিলাম এই রিস্ক নেওয়া ঠিক হচ্ছে কিনা। তারপরও বন্ধুত্বের দাবিই জয়ী হলো। আমি কবিরের সঙ্গে দ্রুত প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভিড় ঠেলে আমরা ঢুকে গেলাম মর্গে। আমি কবিরের পিছু পিছু হাঁটছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আনোয়ারের এক ভাইয়ের লাশ চিনতে পারলাম। দেখলাম এ কক্ষটিতে আরো ৩টি লাশ পাশাপাশি রাখা হয়েছে। কবির মর্গের এক কর্মচারীকে কী যেন একটি নির্দেশ দিয়ে দ্রুত বের হয়ে এলো। আমিও তার সঙ্গে বেরিয়ে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিছুক্ষণ দম নিয়ে তারপর গেলাম ঐ দোকানে যেখানে আনোয়ার অপেক্ষায় আছে। তাকে সব তথ্য দিলাম এবং আমার পরিহিত অ্যাপ্রনটিও তাকে দিলাম।
এরপর আমি দ্রুত ফিরে এলাম আমার মেসে। রাত্র ১১টার দিকে দেখি আনোয়ার ফিরে এসেছে। সে বলল ঐ অ্যাপ্রন পরে সব গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে সেও প্রবেশ করে সব বিপ্লবী শহীদকে সম্মান জানাতে পেরেছে। এ কাজটি করতে পেরেছে বলে এই তীব্র শোকের মধ্যেও সে একটি স্বস্থি পাচ্ছে বলে আমাকে জানাল। আমার প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করল। সে আরো বলল, তার দুই ভাই এই অপারেশনে শহীদ হয়েছে বলে প্রথমে ধারণা হয়েছিল কিন্তু মর্গে গিয়ে দেখেছে এক ভাই শহীদ হয়েছে।
এই ঘটনা পত্র-পত্রিকায় কিছুদিন বেশ আলোড়ন তুলল। জাসদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন আরো বেড়ে গেল। জাসদ তৎপরবর্তীকালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে তাদের অবস্থান হারিয়ে ফেলল।
’৭৬-এ দেশ হারাল বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক প্রাণপুরুষ মাওলানা ভাসানীকে। এই ‘৭৬য়েই জেনারেল জিয়া সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটানোর অভিযোগে কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝোলালেন। ক্ষমতার মসনদে পালাবদল ঘটল পুরোপুরি। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির প্রতিভূরা স্থান পেলেন জিয়ার মন্ত্রিসভায়। ডান ও বামপন্থী যারা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেয়নি তাদের সমর্থন পেলেন তিনি। সমর্থন পেলেন পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগ, জামায়াত ইসলামী ও এধরনের ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকদের। তাঁর সমর্থন আরো জুটল ঐ সব ব্যক্তিবর্গ থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন যারা ছিলেন উপেক্ষিত অথবা আওয়ামী লীগের বিরোধীতাই যাদের রাজনীতির প্রধান উপাদান। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের একাংশের সমর্থনও তাঁর জুটলো।
এরকম জগাখিচুড়ি সমর্থনের ওপর ভর করে তিনি তাঁর ক্ষমতার ভিত্তিকে আরো মজবুত করার লক্ষ্যে এদের সবাইকে নিয়ে গঠন করলেন ‘জাগদল’ নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম এবং একই সাথে রাজনীতিকে তিনি অবমুক্ত করলেন। তবে শর্ত দিলেন দলসমূহকে তাঁর সরকার থেকে যথাযথভাবে আবেদন করে সংশ্লিষ্ট দলিলাদি দাখিল করে অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হবে। এর ফলে রাজনীতি অবমুক্ত হলো বটে, তবে ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর জন্য তা হলো অপমানের। অপমান এ কারণে যে সামরিক সরকারের অনুমতি নিয়ে (অন্য অর্থে দাসখত দিয়ে) তাদেরকে রাজনীতি করতে হবে। অন্যদিকে এই ফ্লাডগেট দিয়ে মুসলীম লীগ, জামায়াত ইসলামীসহ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী নিষিদ্ধ দলসমূহ রাজনীতির মাঠে পুনরায় বীরদর্পে হাজির হলো। জিয়াউর রহমান ঘৃণিত রাজাকার শিরোমণিদের তাঁর মন্ত্রিসভায় স্থান দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ৪/৫ বছরের সময়সীমায় এরকমটা ঘটতে পারে, যা কল্পনারও অতীত ছিল। কিন্তু তাই ঘটল লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা লাল সবুজ পতাকার এই স্বাধীন বাংলাদেশে।
জিয়া তাঁর ক্ষমতার ভিতকে একটা গ্রহণযোগ্য ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যে প্রথমে রাষ্ট্রপতি পদে একটি হ্যাঁ/না নির্বাচন করলেন। রাজকোষের অর্থব্যয়ে এই নির্বাচনে বলাবাহুল্য তিনি ৯৮% ভোট পেলেন। এর পরই তিনি মনোযোগ দিলেন তাঁর রাজনৈতিক সংগঠন ‘জাগদল’কে আরো ব্যাপক ভিত্তি দেয়ার ক্ষেত্রে। বিভিন্ন সংগঠন থেকে দলছুটদের সংগ্রহ, ছাত্র সংগঠনে ভাঙ্গন ধরিয়ে তাঁর সমর্থনে ছাত্র সংগঠন গঠন, শ্রমিক সংগঠনসমূহে তাঁর সমর্থন বাড়ান এবং যারা আওয়ামী রাজনীতির প্রবল বিদ্বেষী তাদের নিয়ে তিনি আরো বৃহত্তর রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠন করলেন। নাম দিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এই পুরো সময়টাতে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা নির্বাসিত। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ঘৃণিত। দেশে এরকম একটি পরিবেশ। সরকারি প্রচারযন্ত্রে ‘বঙ্গবন্ধু’র নাম উচ্চারিত হয় না। স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর বা আওয়ামী লীগের কোনও অবদানের স্বীকৃতি নেই। নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে একটি ভিন্ন রকম রাজনৈতিক আবহে। যেখানে বাঙালি জাতির গর্বের মুক্তিযুদ্ধ নেই, নেই মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের ন্যূনতম স্বীকৃতি।
এই পর্যায়ে যখন জিয়ার ক্ষমতার বলয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই, রাজনীতিতেও নেই প্রবল প্রতিপক্ষ, তিনি এবার রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন ঘোষণা করলেন। আওয়ামী লীগের প্রধান নেতারা কেউ জীবিত নেই। যারা তখন শীর্ষ নেতৃত্বে, তারাও দ্বিধাবিভক্ত। তবু তারা নিজেদেরকে সংগঠিত করার সুযোগ হিসেবে এই নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি ওসমানীকে তাদের প্রার্থী করলেন। নির্বাচনে জয়ী হলেন জিয়া প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে। বিরোধীরা পেলো ৪০ শতাংশ ভোট। আওয়ামী লীগে তখন দুটি ভাগ, একভাগে ‘বাকশাল’ নাম দিয়ে বামঘেঁষা রাজনীতিকেরা, অন্যভাগে মধ্যপন্থীরা। তবে মধ্যপন্থীরাই আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করলেন আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে, তবে দলের নেতৃত্বে তখনো টানপোড়েন চলছে।
’৭৫-এর যে রাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন, সেই বিভীষিকা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁর দুই কন্যা ঐ সময়ে বিদেশে অবস্থানের কারণে। দীর্ঘ ৬ বছর বিদেশে কাটিয়ে তাঁর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন ১৬ই মে ’৮১ তে। বিভাজিত আওয়ামী নেতৃত্ব তাঁকে বিদেশ থেকে নিয়ে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরার জন্য পরামর্শ দিলে তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর থেকে আওয়ামী লীগ পুনরায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগঠিত হতে শুরু করল।
এরমাত্র ১৫ দিনের মধ্যে ঘটে গেল আরেকটি বিষাদময় ঘটনা। জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে ৩০শে মে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হলেন। এর জন্য দেশ ও জাতি তখন প্রস্তুত ছিল না। প্রস্তুত ছিল না বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তার জিয়ার মৃত্যুর পর দল ও সরকারের হাল ধরলেন। আর অন্যদিকে সামরিক বাহিনীতে প্রভাব বিস্তার করতে লাগলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এক সময় তিনি জোর করে ক্ষমতা দখল করে ফেললেন বৈধ সরকারকে উৎখাত করে। জিয়ার শাসনের শেষের দিকে গণতন্ত্রের একটু সুবাতাস বইতে শুরু করলেও তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করলেন এরশাদ।
তার স্বৈরাচারী শাসন রাজনীতিকে আরো কলুষিত করে তুলল। এরশাদও কেনাবেচার রাজনীতি শুরু করলেন। রাজনীতিতে স্থায়ী ভিত্তি গঠনের লক্ষ্যে নতুন দল গঠন করলেন 'জাতীয় পার্টি' নাম দিয়ে। নতুন বোতলে পুরনো মদ। সেই চেনা রাজনীতিকেরাÑ যাদেরকে তিনি কিনতে পারলেন মূলত বিএনপির কিছু দলছুট এবং অন্যান্য দলের উচ্ছিষ্টরা। এরশাদ আবার মৌলবাদীদের সমর্থন আদায়ের জন্য নতুন ভেক ধরলেন। ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হিসাবে ইসলামকে সংবিধানে যুক্ত করলেন। অবশ্য এ ধরনের কাজ জিয়া শুরু করেছিলেন প্রথমে। তিনি সংবিধান সংশোধন করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ পরিহার করে, ‘বিসমিল্লাহ’ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এরশাদের কাজ তারই ধারাবাহিকতা। সবই ভেক ও খোলস। মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতায় টিকে থাকা। রাজনীতির মঞ্চে নতুন খেলা শুরু হলো। সরকারের বিরুদ্ধে দুটি প্রবল বিরোধী পক্ষ। এক পক্ষে বিএনপি ও অপর পক্ষ আওয়ামী লীগ। অবশ্য বামরাও তখন সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু তাদের শক্তি সামর্থ্য সীমিত। সুচতুর এরশাদ ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসি নিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রায় ৯ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকলেন। অবশ্য এক সময় সব কিছুরই শেষ হয়। এরশাদও তার ‘শেষ’ দেখলেন ’৯০-এর প্রবল ছাত্র জনতার আন্দোলনে। ক্ষমতা ছাড়তে তাকে বাধ্য করা হলো।
সত্যিকার অর্থে ’৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর ’৯০ সন থেকে দেশে পুনরায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রতিবারই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটেছে। ঘুষ, দুর্নীতি, সুশাসনের অভাবÑ এসব সীমাবদ্ধতার পরও দেশ গত ২০ বছর গড়ে ৫% এর ওপর প্রবৃদ্ধি আর্জন করেছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতিতে একটা নতুন উপাদানও যোগ করেছে। তাহলো নির্বাচন তত্ত্বাবধানের জন্য একটি ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। এরশাদ পতনের আন্দোলনে সম্মিলিত বিরোধীরা ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে এরশাদকে বাধ্য করেছিল।
এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জয়ী হলো। সাধারণভাবে জনমনে ধারণা ছিল যে আওয়ামী লীগ জয়ী হবে। গৃহিণী থেকে খালেদা জিয়া তখন পুরোপুরি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি বিএনপির ঝানু নেতাদেরকে নিয়ে শক্তভাবে সরকারের হাল ধরলেন। ক্ষমতায় এসে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের সাথে তিনি ভালো সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করলেন। বিএনপির ভারত বিরোধিতা রাজনীতির কারণে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানপোড়েন আরো বাড়ল। তবে চীনের সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলো। রাষ্ট্র ক্ষমতায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের প্রভাব বাড়তে লাগল কিছুদিনের মধ্যেই। তারেক রহমানের ওপর ভর করে একদল তরুণ লুটেরা তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রায় সব ব্যবসা বাণিজ্যের নিয়ন্তা। ফলে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ দ্রুত শীর্ষে উঠে এলো। খালেদা জিয়ার প্রথম ৫ বছরের শাসন তাই দুর্নীতির কারণে যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে। ঐ সরকারের ৫ বছর মেয়াদের পর একই রকমভাবে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। এই সরকারের আমলে অন্যান্যের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের সঙ্গে সরকারের ‘শান্তিচুক্তি’ হয় যার ফলে প্রায় ২০ বছরের ওহংঁৎমবহপু বন্ধ হয়। যা ঐ সরকারের একটি অন্যতম সাফল্য হিসেবে এখনো বিবেচনা করা হয়। তবে দুর্নীতির সঙ্গে তাদেরও সখ্যতা বহাল থাকে। পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। এই সম্পর্কের সুবাতাসে দুই দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। অর্থনীতিতে গতি আসে।
এরপরে আবারো ক্ষমতায় পালাবদল হয় ২০০১-এর নির্বাচনে। বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসে। এবার সরকারে এসে বিএনপি এমন লুটপাট ও কুশাসন প্রতিষ্ঠা করে যে সব মহলই তাতে অসহায় হয়ে পড়ে। বিএনপি মেয়াদ শেষের দিকে তাদের মনমতো নির্বাচন কমিশন গঠন করতে চাইলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সারা দেশে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে উঠে। তারপরও বিএনপি তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে দেশে তীব্র অরাজকতা, জ্বালাও, পোড়াও শুরু হয়ে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে এবং পরোক্ষভাবে ক্ষমতা দখল করে। তারা পিছনে থেকে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের চেষ্টা করে। ঐ সরকার প্রথম দিকে জনগণেরও বিপুল সমর্থন লাভ করে। যদিও ঐ সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল স্বল্পতম সময়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। কিন্তু তারা তখন দীর্ঘদিন ক্ষমতার থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল এবং নির্বিচারে রাজনীতিক, ব্যবসায়ীদের বিনাবিচারে আটক করতে শুরু করল। তখন আর জনগণের সমর্থন থাকল না তাদের প্রতি। তারা এ সময় বিনা বিচারে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকেও বন্দি করল। অনেক জল ঘোলা করে ২ বছরের মাথায় নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো ঐ সরকার।
নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলো ২০০৯ সালে। কিন্তু যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। প্রথম দিকে এই সরকার অনেক স্বপ্ন দেখাল দেশের মানুষকে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন। সুশাসনের স্বপ্ন আরো কতো কী? কিন্তু যতো দিন যাচ্ছে তাদের পুরনো চেহারা আবার বেরিয়ে আসছে। তাদের সাফল্যের খাতায় অবশ্য যোগ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার। শিক্ষা, কৃষি খাতেও সাফল্য এসেছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্যক্রম শুরু হলেও কতটুকু কী হবে তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেফতার করে জেল হাজতে ঢুকিয়েছে, বিচার প্রক্রিয়া চলছে, এটুকুই সান্ত্বনা।
দেশের রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হচ্ছে। কেননা মানুষ সরকারের বক্তব্য ও কাজের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এসবের সুযোগ নিয়ে খালেদা জিয়া আবার মাঠ গরম করছেন। তিনি তাঁর সঙ্গী করেছেন ধিকৃত জামায়াতে ইসলামী ও আলবদর রাজাকারদের। মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তি চেয়েছেন তিনি। অন্যদিকে ক্ষমতার মসনদে থেকে শেখ হাসিনা এরশাদকে সঙ্গী বানিয়েছেন। সম্ভবত তার কাছ থেকে কূট কৌশলও শিখছেন, কিভাবে জনসমর্থন ব্যতিরেকে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়। দেশের আপামর জনসাধারণের সামনে আবারো অশনি সংকেত।
একদিকে এই আশাভঙ্গের বেদনা, অন্যদিকে এতকিছুর পরও যখন দেখি এই দেশটির অদম্য সাধারণ মানুষ দেশটাকে অর্থনৈতিকভাবে একটু একটু করে এগিয়ে নিচ্ছে, তখন আশা করতে ইচ্ছা করেÑ এরাই হয়তো একদিন দেশটাতে সুশাসনও ফিরিয়ে আনবে।---ডিনিউজ
খবর বিভাগঃ
মুক্তিযুদ্ধ
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়