Wednesday, July 10

খালেদার গুডবুকে ১ ডজন নেতা

ঢাকা : শীর্ষ থেকে তৃণমূল। ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দারুণভাবে উজ্জীবিত বিএনপি। সরকারি দলের বিপুল প্রচারণা, হুমকি ধমকি, অব্যাহতভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন, প্রশাসনিক হয়রানি, অপপ্রচার ও নিজেদের অন্তর্কোন্দলকে উড়িয়ে দিয়ে দলটি ঘরে তুলেছে বিপুল বিজয়। নির্বাচনে জিতেছেন ৫ প্রার্থী। কিন্তু তাদের বিজয় নিশ্চিত করতে কোন্দলকে ঐক্যে পরিণত, দলীয় সিদ্ধান্তে ত্যাগ স্বীকার ও সরকারি কৌশল ব্যর্থ করে দেয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুডবুকে স্থান করে নিয়েছেন এক ডজন নেতা। দলের সকল পর্যায়ে প্রশংসিত এই নেতারা হলেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার (অব.) আসম হান্নান শাহ, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, শমসের মবিন চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান মিনু, সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবর রহমান সরোয়ার, ফজলুল হক মিলন, টঙ্গীর সাবেক এমপি হাসান উদ্দিন সরকার, সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক শামসুজ্জামান জামান, খুলনা সদর আসনের এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, খুলনা জেলা বিএনপির সম্পাদক শফিকুল আলম মনা ও রাজশাহী মহানগর বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন। এদের মধ্যে কয়েকজন ভবিষ্যতে মন্ত্রী, সাংগঠনিক পদ ও জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পাচ্ছেন এ আলোচনা এখন দলের সর্বত্র। বিএনপি নেতারা জানান, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া তখন সিঙ্গাপুরে। এদিকে গাজীপুর জেলা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ অংশটি প্রার্থী হিসেবে পক্ষ নেন হাসানউদ্দিন সরকারের। ইতিমধ্যে খালেদা জিয়ার নির্দেশে সেখানে ৪টি গোপন জরিপ চালায় কেন্দ্রীয় বিএনপি। জরিপে প্রার্থী হিসেবে প্রথম পছন্দে উঠে আসেন প্রফেসর এমএ মান্নান। এমন প্রেক্ষিতে জেলা নেতাদের মতামতের চেয়ে ভোটারদের মতামতকেই বেশি গুরুত্ব দেন খালেদা জিয়া। তিনি হান্নান শাহকে প্রফেসর মান্নানের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দেন। হাসানউদ্দিন সরকারকে ডেকে বলেন, মান্নানের পক্ষে কাজ করুন- আপনার জন্য পুরস্কার অপেক্ষা করছে। তখনও জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন ছিলেন মান্নানের বিপক্ষে। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে মিলনকে ডেকে খালেদা জিয়া পরিষ্কার জানিয়ে দেন, যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না। পদ-পদবি ও আগামীতে নমিনেশন কোনটিই থাকবে না। শেষে সক্রিয় হন মিলন। তবে খালেদার অঙ্গীকারে হাসান উদ্দিন সরকার নির্বাচনের মাঠে ছিলেন অক্লান্ত। তার প্রচেষ্টার কারণেই এরশাদের সমর্থন নাটকের পরও মান্নানের পাশে ছিল জেলা জাতীয় পার্টি। ওদিকে রাজশাহীতে আগেই অনুজ সহকর্মীকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু। ওয়ান ইলেভেনের সময় অনুষ্ঠিত বিগত নির্বাচনে মিনুর অনুপস্থিতি নিজের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছিলেন বুলবুল। মিনুর সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছে বিএনপিতে। শেষে প্রার্থিতার দৌড়ে ছিল শফিকুল ইসলাম মনা। তিনিও খালেদা জিয়ার নির্দেশে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনেছেন। বরিশালে আগেই জায়গা ছেড়ে দেন সাবেক মেয়র ও বরিশাল বিএনপির সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা মজিবর রহমান সরোয়ার। অন্যদিকে দলীয় নির্দেশে পারস্পরিক ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্তে সরে দাঁড়ান এবাদুল হক চাঁন। বিনিময়ে আহসান হাবিব কামালের বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির পদ ছেড়ে দেন চাঁনকে। কিন্তু বরিশাল বিএনপির কোন্দলপ্রবণ নেতাদের সমন্বয় ও নির্বাচনী ফলাফল রক্ষায় নানা কৌশল ও নির্দেশনা দিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছেন কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহী সিটি নির্বাচনে যখন বিএনপি একক প্রার্থী চূড়ান্ত করে তখনও সিলেট ছিল বিভক্ত। নানা কারণে আরিফুল হক চৌধুরীকে মেনে নিচ্ছিল না নেতাকর্মীদের বড় অংশটিই। জামানের পক্ষে পরিষ্কার অবস্থান নিয়েছিলেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর পরিবার। কিন্তু জোটের প্রধান শরিক জামায়াত ইসলামের সমর্থন ছিল আরিফের পক্ষে। তারা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, আরিফকে সমর্থন না দিলে তারা জেলা আমীর এহসান মাহবুব জুবায়েরকে প্রার্থী করবেন। এমন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার নির্দেশে সরে দাঁড়ান জামান। অন্যদিকে প্রথম থেকেই আরিফের পক্ষে মাঠ গুছিয়েছেন  ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। খুলনায় দায়িত্ব পেয়েছিলেন দক্ষিণাঞ্চল বিএনপির কাণ্ডারি তরিকুল ইসলাম। কিন্তু সদর আসনের এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জুর আন্তরিক সমর্থনই ছিল সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। খালেদা জিয়ার নির্দেশে তরিকুল ও মঞ্জু জুটির কার্যকর নির্বাচনী কৌশল ও জনপ্রিয়তায় বিজয় আসে মনিরুজ্জামান মনি’র।  এছাড়াও ৫ সিটি নির্বাচনে  ভূমিকা রেখে প্রশংসিত হচ্ছেন-বিএনপির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন, সিলেট জেলা বিএনপি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খন্দকার আবদুল মালিকের ছেলে খন্দকার আবদুল মোক্তাদির, বরিশাল দক্ষিণ জেলা আহ্বায়ক এবাদুল হক চান, সাধারণ সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরীন, বরিশাল উত্তর জেলা সাধারণ সম্পাদক আকন আবদুল কুদ্দুস, মহানগর সাধারণ সম্পাদক কামরুল আহসান শাহীন, রাজশাহী জেলা বিএনপির সভাপতি নাদিম মোস্তফা, খুলনা জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক মাজেদুল ইসলাম, গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ছায়েদুল আলম বাবুলসহ কয়েকজন। বিএনপি নেতারা জানান, সিটি নির্বাচনে প্রার্থীর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জাতীয় ইস্যু। কারণ ৫ সিটির মধ্যে একমাত্র গাজীপুরের প্রার্থী প্রফেসর এমএ মান্নানই ছিলেন হেভিওয়েট। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। বাকিদের মধ্যে একজন পৌর মেয়র ও তিনজন সিটি করপোরেশনের কমিশনার ছিলেন। রাজনৈতিক পরিচিতির দিক দিয়ে তারা ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চেয়ে পিছিয়ে। কিন্তু প্রতিটি সিটিতেই ভোটের ব্যবধান হয়েছে বিশাল সংখ্যার। আর এ ইস্যুগুলোকে ফলপ্রসূ করেছে বিএনপি নেতাদের ত্যাগ স্বীকার ও ইস্পাত কঠিন ঐক্য। দলের স্বার্থেই ৫ সিটি করপোরেশনের একাধিক নেতা সরে গেছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে। প্রচারণার মাঠে খেটেছেন প্রার্থীর সমান আন্তরিকতায়। দূরদর্শিতার সঙ্গে স্থানীয় ইস্যুকে কাজে লাগানো ও কৌশল-পাল্টা কৌশল প্রণয়ন করেছেন কেউ কেউ। এ ত্যাগ ও ঐক্যের কারণে এসেছে বিজয়। এ ঐক্যের নেপথ্য কারিগর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রার্থী বাছাই, দলীয় নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করা ও সার্বিক বিষয়ে তিনিই ছিলেন কাণ্ডারির ভূমিকায়। পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটি মনিটরিং করেছেন খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ কারণে স্থানীয় নেতারা ছিলেন সর্বোচ্চ আন্তরিক ও সতর্ক। এদিকে সিটি নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পরও আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে না বিরোধী দল বিএনপি। অবশ্য ৫ সিটি নির্বাচনের বিজয়ে আত্মবিশ্বাসের চূড়ায় অবস্থান করছে দলটি। চাঙ্গা হয়েছে দমন-নিপীড়ন ও বঞ্চনায় কোণঠাসা তৃণমূল নেতাকর্মীরাও। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনের সাফল্যে লক্ষ্যচ্যুত হতে চান না তারা। সরকারের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিতে চায় বিরোধী দলও। জনরায়কে সম্মান জানিয়ে বুঝে শুনেই পা ফেলতে চায় আন্দোলনের পথে। যে কোন মূল্যে ধরে রাখতে চায় দলীয় ঐক্য ও জনমত। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পর বিএনপি নেতারা এ মনোভাবের কথা জানিয়েছেন। নেতারা জানান, রাজপথের নৈরাজ্যের চেয়ে জনমত জোরালো করার মাধ্যমেই তারা আদায় করতে চান নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। তাই আগামী রমজান মাসে রাজনৈতিক ও কূটনীতিকদের সমর্থন জোরালো করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে বিরোধী দল। ইফতার পার্টিসহ একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে সে প্রচেষ্টা চালাবেন তারা। বিএনপি নেতারা প্রত্যাশা করেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল নিশ্চয় সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করবে। জনমত বিবেচনায় নিয়ে পুর্নবহাল করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। যদি সে উদ্যোগ না নেয় তবে রমজানের পর চূড়ান্ত আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। নেতারা বলেন, বিএনপির আন্দোলন যে সঠিক পথেই আছে তা প্রমাণ হয়েছে সিটি নির্বাচনের ফলাফলে। তাই মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনায় রেখেই পরবর্তী আন্দোলন কৌশল প্রণয়ন করা হবে। মানুষের মুখে মুখে মুখরিত সরকারের সমালোচনাকে কাজে লাগিয়ে জোর দেয়া হবে জনমত গঠনে। সরকার ইতিবাচক সাড়া দিলে আন্দোলনের পাশাপাশি জোর প্রস্তুতি চলবে নির্বাচনের। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের বিজয়ের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতে তরিকুল ইসলামসহ স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যও ভবিষ্যৎ পথচলায় এমন মতামত দিয়েছেন।-মানবজমিন

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়