Saturday, June 15

আচিকানা, জ্বীনের কাহিনী

মাহমুদ সীমান্ত, অতিথি লেখক
জাফরিন আন্টিকে জ্বীনে ধরেছে শুনে শরীর শিরশির করে উঠলো। যা ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা গ্রামদেশের বাড়ি! সারাক্ষণ আমার মন ভয়ে তটস্থ থাকে। কলেজ থেকে ফিরেই দেখি জাফরিন আন্টির ঘরে লোকজন ভর্তি। সবাই কৌতূহলী হয়ে ভিড় করেছে। জ্বীনে-ভূতে ধরা আমাদের এই গ্রাম-মফস্বলে বিশেষ কোন ঘটনা নয়। বিষ্ময় এটাই, জাফরিন আন্টির কৃশকায় ছিপছিপে শরীরে এবার জ্বীন বেঁধে বসে আছে দুবাই ফেরত আকিদুল ভাইয়া।  আকিদুল ভাইয়া কী দুবাই গিয়ে জ্বীনে-ভূতে ধরা শিখেছে নাকি! কৌতূহলী হয়ে আমিও দেখতে শুরু করেছি ঘটনাটা। হাতের সর্ব কনিষ্ঠ আঙুলে সুতার সাতপ্যাঁচে জ্বীনটাকে কেবল বেঁধেছে আকিদুল ভাইয়া। আমি দেখছি, জ্বীনেধরা জাফরিন আন্টি সত্যি সত্যি এবার আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন আবোল তাবোল বলতে শুরু করেছে। সত্যি ভেবে, শরীরের শিরশির ভাব কমছেই না।

-ছেড়ে দে, ছেড়ে দে রোগীটার কষ্ট হচ্ছে। জাফরিন আন্টির ভিতরে থাকা জ্বীনকে উদ্দেশ্য করে বলছে আকিদুল ভাইয়া।
জ্বীন হয়ে এবার জাফরিন আন্টি বলে...
-ছাড়বো না, ছাড়ার জন্য তো আমি তাকে ধরিনি।
-ছেড়ে দে বলছি। তোর কী নাম? কোথায় থাকিস?
-ছাড়বো না। আমার নাম তিলাম সামারা ভিড়া, সবাই ডাকে আচিকানা।
বাড়ির পেছনে তেমাথায় শ্যাওড়া গাছটা দেখিয়ে জাফরিন আন্টি বলে আমি ওখানেই থাকি।
কদম আলী দাদুর কবরপাড়ের ওই শ্যাওড়া গাছে ভূতের কথা আমরা আগেই শুনেছি। দিনে, দুপুর বেলায়ও সহজে কেউ ওইপথে যায় না ভূতের আছরের ভয়ে। আকিদুল ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করে...
-তোর আসল ঠিকানা কোথায়?
-ঋষিপাড়ায়। মাদার গাছে। আমরা ওখানেই থাকি। কিছুদিন যাবৎ ভোগ নাই তাই মাসদুয়েক হলো এখানেই আছি।
এইকথা বলে জাফরিন আন্টি চুপ করে থাকে।
আকিদুল ভাইয়া আবার প্রশ্ন করলেও কোন উত্তর দেয় না। সেও কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে আমাদের সাথে শেয়ার করে বলে। আচিকানার ভোগের কথা না বললে তো মনে হয় সহজে ছাড়বে না।
সবাই বললো, জিজ্ঞেস করে দেখ্ আকিদুল সে কী চায়?
আকিদুল ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করে বল কী পেলে তুই রোগীকে ছেড়ে দিবি?
-তোকে চাই। বলে জাফরিন আন্টি মিটিমিটি হাসে কিন্তু আমরা কেউ বিশ্বাস করতে পারি না সে হাসছে। আকিদুল ভাইয়া এবার ক্ষেপে গেল...
-তোর কিন্তু সর্বনাশ করে ফেলবো আচিকানা। ভালো করে বল তুই কী চাস্? রোগীটার কষ্ট হচ্ছে, তার কিছু হলে তোর কিন্তু গোষ্ঠিসুদ্ধ বারোটা বাজিয়ে দেব।
-একজোড়া গরু।
-হ্যাঁ, একজোড়া গরু! দিতে পারবে না। অন্যকিছু বল।
-মানবো না। গরুই দিতে হবে।
-দিতে পারবে না। তুই অন্যকিছু বল। নইলে কিন্তু সলতা পুড়ে তোর নাকে ঢুকিয়ে দেব। রাগ করে বলে আকিদুল ভাইয়া। কিন্তু জাফরিন আন্টি কিছুই বলে না। আনমনে থাকে। বিড়বিড় করে। আবার হঠাৎ করে বলে...
-ঠিকাছে। একটা পাঠা আর একটা ছাগী পেলে ছেড়ে দেব।
আকিদুল ভাইয়া একটু একটু ক্ষেপতে থাকে।
-কিছুই নাই। দিতে পারবে না। তুই এমনিই ছেড়ে দে, রোগীটার কষ্ট হচ্ছে। ছেড়ে দিয়ে আমাদের গ্রাম থেকে চলে যাবি।
-যাবো না। ভোগ না পেলে কিছুতেই যাবো না। ভোগ ছাড়া ফিরে গেলে আমার সাথীরা আমাকে মেরে ফেলবে। আচিকানা বলতে থাকে কিন্তু জাফরিন আন্টির চোখ লাল হয়ে যেন আগুন ঝরে উত্তাপসহ।

আকিদুল ভাইয়া বুঝে ফেলেছে এই জ্বীন সহজে ছাড়বে না। দুয়েকবার রোগীর নাকে সলতা ঢুকিয়ে ছেকা দিয়ে আচিকানাকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে ভয়েও কোন কাজ হচ্ছে না। এরকম জ্বীনের ঘটনায় আকিদুল ভাইয়া আরও বারতিনেক মুখোমুখি হয়েছে। জ্বীনের মাধ্যমে আনা পরিস্তানের জিলাপি, সন্দেশ, পান খাইয়ে লোকজনের মন পেয়েছে। এবারও সে ছাড়বার পাত্র নয় কিন্তু কাজ হচ্ছে না। জাফরিন আন্টির এরকম কাহিলদশা দেখে তার বিশেষ ভালোও লাগেনি বোধ হয়। কিছুক্ষণ দম নিয়ে সে চিন্তা করলো। আসনের মোম, আগরবাতি জ্বালিয়ে মন্ত্র পড়ে সে সিদ্ধান্ত নিলো এবার আচিকানাকে ফাইনালি ধরবে সে। আমাকে তার কাছে ডেকে নিয়ে বললো...
-সিমন, ঘটিটায় একটু পেসাব করে ভরে নিয়ে আয়। এরপর কয়েকজন মিলে আন্টিকে ধরতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্বীন ছেড়ে দেবে।
আমি অনুমানে ব্যপারটা ঠিক ধরে ঘরের কোণে রাখা ঘটিটায় প্রশ্রাব করতে শরু করলে জাফরিন আন্টি কিছু একটা টের পেয়ে যায়। আচিকানা এবার ক্রমধীরে উত্তেজিত হতে হতে আকিদুল ভাইয়াকে বলতে থাকে।
-সাবধান আকিদুল, আমাকে অপবিত্র করবি না। তোর কিন্তু বিপরীত হবে বললাম। তোকে খেয়ে ফেলবো আকিদুল। তোকে আমি ছাড়বো না।
মা-ও সেখানে উপস্থিত, দেখছেন ঘটনাটা। মায়ের দিকেও তাকিয়ে বলতে শুররু করেছে...
-সিমনকে ফিরা বলতেছি, ওকে এইসব বন্ধ করতে বল। নইলে কিন্তু ওকেও খেয়ে ফেলবো। ছাড়বো না আমি কাউকে ছাড়বো না।
প্রশ্রাবভর্তি ঘটিটা আকিদুল ভাইয়ার হাতে দিয়ে শক্ত করে আমিও ধরলাম জাফরিন আন্টিকে। রোগা, পাতলা হালকা গড়ন আন্টির, তিনি শক্তি খাটাচ্ছেন। বাবলু, হোসাইনি, চন্দনা, সোহাগ, জহিরুল ধরে প্রায় ধস্তাধস্তি শুরু করেছে কিন্তু পারছে কিনা সন্দেহ হচ্ছে। আমি ভাবছি জাফরিন আন্টির শরীরে এটা কিসের শক্তি যে চার/পাঁচজনে মিলে ধরেও কুলাতে পারছি না। আকিদুল ভাইয়া ঘটির প্রশ্রাব হরহর করে মুখের মধ্যে ঢেলে দিলে আর রক্ষা নেই। বিশাল এক দৈত্যের শক্তিতে আন্টি সমস্ত শরীর প্লাস্টিকের মতো বাঁকিয়ে মোচড় দিতে শুরু করলে আসন উল্টে পড়ে গিয়ে সারা ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। আচিকানাকে ধরে থাকা আমরা এদিক ওদিক ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছিলাম। হাতে আমি এমনভাবে চাপ দিয়ে ধরেছি যে হাড় প্রায় ভেঙে যায় যায়। এমন সময় বিকট এক শব্দে ঘরের দরজায় আচিকানার লাত্থিতে অবাক নিথর হয়ে দেখছি জাফরিন আন্টি হাতটা ভেঙে নিস্তেজ হয়ে গেলেন। কেউ কোন কথা বলছে না, আলোও জ্বালাচ্ছে না। অচেনা এই এক্সিডেন্টের ভয়ে আমিও নিস্তেজ হয়ে গেছি।

তোর্সা, অহর্নিশ জাফরিন আন্টির খুব মিষ্টি, ফুটফুটে একটি মেয়ে এবং ছেলে। তোর্সার বয়স ৭ আর অহর্নিশের ৪। আন্টিকে জ্বীনে ধরার পর সন্ধ্যারাতে ওরা কান্নাকাটি শুরু করলে ওদেরকে দাদীমার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিলো। এবার হৈ চৈ হট্টগোলে ওদের ঘুম ভেঙে গেলে অহর্নিশ আবার কাঁদতে শুরু করে। ভয়ে কাঁপছে তোর্সা। জিজ্ঞেস করলাম...
-কি রে তোর্সা ভয় পেয়েছিস? আন্টির কিচ্ছু হবে না। একটু পরেই জ্বীন ছেড়ে দেবে।
তোর্সা বলছে...
-সিমন ভাইয়া, একটু আগেই বাহির্ঠানের আমাদের রসুই গাছের বড় ডালটায় বিরাট একটা কালো দৈত্য বসেছিলো। হঠাৎ ডালটা ভেঙে পড়ে গেল, দৈত্যটা আর নেই।
-কি বলছিস? সবাই বললো চল তো দেখি কোথায় ছিলো দৈত্যটা। আমরা দেউড়ি পার হয়ে বাহির্ঠানে যেতেই দেখি পুকুরের কোনায় দাদীমার প্রিয় আমগাছ রসুইয়ের বড় ডালটি ভেঙে মাটিতে পড়ে আছে।
আন্টির ঘরের দরজার সাথে থাকা কবুতরের খোপঘরে তিজোড়া ডিমপাড়া কবুতর ছিলো। খোপের দরজা খোলা, এলোমেলো পাখালি আর ডিমসহ কবুতরগুলিও নেই।
অবশ শরীরে ঘরের ভিতর ঘুমাচ্ছে জাফরিন আন্টি।
সবাই বলছে, আচিকানা চলে গেছে।(ডিনিউজ)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়