Monday, June 24

মন্টুদার পত্রিকার দোকান

প্রবীর বিকাশ সরকার
কুমিল্লা: কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়স্থ পত্রিকা বিক্রির দোকান ‘ও.কে.স্পোর্টস’ এর সাইনবোর্ডটির কথা অনেকেরই জানা নেই বলেই ধারণা করি। কারণ ঝুলিয়ে রাখা অসংখ্য বহুরঙা এবং বিচিত্র পত্রিকা ও সাময়িকীর ভিড়ে নামটির দিকে সহজে নজর পড়ে না। এবং এই দোকানের মালিক মন্টুবাবুর নামও ক’জন জানেন তাও গবেষণার বিষয়। তবে আমাদের মধ্যে যারা ৭০ দশকের কবি, লেখক ও সাংবাদিক তাদের কাছে মন্টুদা একটি প্রিয় নাম, তিনি আমাদের যেমন গুরুজন তেমনি প্রিয় মানুষ। অবশ্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও প্রিয়জন তিনি। মন্টুদার আসল নাম ইন্দ্রজিৎ দাস।

জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থিত এই দোকানটি তিনি চালু করেছিলেন ১৯৬৫ সালে সংঘটিত পাক-ভারত যুদ্ধের পরে। তখন দোকানটি বর্তমান অবস্থানের উল্টো দিকে রাস্তার অপর দিকে জাফর খান স্টোর্স এবং বেঙ্গল স্টোর্স এর মাঝখানে ছিল। বেঙ্গল স্টোর্স কুমিল্লার সবচে বড় কাপড়ের দোকান ছিল। এখন যেটা বহুতলবিশিষ্ট খন্দকার মার্কেট। অবশ্য এই মার্কেটের ভেতরে মন্টুদার প্রাক্তন দোকানটি কাপড়ের দোকান হিসেবে রূপান্তর ঘটেছে। আর এই পাড়ে নতুন করে চালু করেছেন পত্রিকা বিক্রির দোকানটি। সর্বদা হাসিখুশি মন্টুদার বয়স এখন ৬৫ ছাড়িয়েছে কিন্তু এখনো যথেষ্ট শক্ত সমর্থ বলে আমাদের ভালো লাগে।

এক জীবনে মন্টুদা বহু মানুষকে দেখেছেন। এই শহরের এবং বাইরেরও। বহু খ্যাত-অখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষকের হাতে তিনি পত্রিকা ও ম্যাগাজিন তুলে দিয়েছেন। সাধারণ পাঠক তো আছেনই। সুতরাং মন্টুদার নাম জানা না থাকলেও তার মুখটি চেনেন না এমন কেউ নেই এই শহরে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে যারা নিয়মিত পত্রিকা পড়েন। অনেকেই চলে গেছেন ইহধাম ত্যাগ করে তাঁদের কথাও তিনি স্মরণ করেন সশ্রদ্ধচিত্তে।

আমার সঙ্গে মন্টুদার পরিচয় সেই ১৯৭৬ সালে যখন ছড়া লেখা শুরু করেছি, ঢাকার পত্রিকাগুলোতে লিখছি, লেখা প্রকাশিত পত্রিকাগুলো সংগ্রহ করেছি অধিকাংশ তাঁর দোকান থেকেই। যেসব দৈনিক কিনতাম সেগুলো ছিল: দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, মিল্লাত, দেশ, বাংলারবাণী, দেশবাংলা, রূপালী প্রভৃতি। আর সাপ্তাহিক ছিল: নয়াযুগ, বিচিত্রা, মুক্তিবাণী, ইত্তেহাদ, হককথা, স্বদেশ প্রভৃতি। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘কিশোরবাংলা’র জন্য আগাম বলে রাখতাম, তিনি তুলে রাখতেন। কলকাতার পুজো সংখ্যা, ঢাকার ঈদ সংখ্যাগুলোর জন্য আগাম টাকা দিয়ে রাখতাম তিনি তুলে রাখতে ভুলতেন না। একসময় মুড়ি মুড়কির মতো এইসব বিশেষ সংখ্যাগুলো বিক্রি হতো। আর কিনতেন মহিলারাই বেশি। এখন তো মন্টুদার সঙ্গে মোবাইল টু মোবাইল যোগাযোগ। অনুরোধ করলেই তুলে রাখেন।

যৌবনের উন্মেষলগ্নে কলকাতার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে প্রণয়বন্ধনে আবদ্ধ হই প্রথম তাঁর দোকান থেকে কিনে। কলকাতার তুখোড় চিন্তাশীল সাহিত্য কাগজ ‘জিজ্ঞাসা’, মননশীল সাহিত্য কাগজ ‘চতুরঙ্গ’, ‘শিলাদিত্য’, ‘অনুষ্টুপ’ প্রভৃতি ছাড়াও সাপ্তাহিক জনপ্রিয় সংবাদ সাময়িকী ‘প্রতিক্ষণ’ কম কিনিনি! এগুলোর জন্য মুখিয়ে থাকতাম। না পেলে মন ভীষণ খারাপ হয়ে যেতো। ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের কাগজ ‘ভারতবিচিত্রা’ও এখান থেকে সংগ্রহ করেছি। শিশু সাময়িকী ‘আনন্দমেলা, ‘সন্দেশ’ ‘ধ্রুবতারা’ এক সময় মন্টুদা সংগ্রহ করে আনতেন। তাও কিনেছি। মনে পড়ে এক সময় সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’, ‘পূর্বাণী’ ও ‘সিনেমা’ পত্রিকা নিয়মিত কিনেছি তাঁর দোকান থেকে। রাহুল দত্ত, ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতি সে ছিল অসম্ভব সিনেমা পাগল। সিনেপত্রিকাগুলো মাঝেমাঝে তাকে দেখাতাম। চোখ বড় বড় করে সে পড়ত। রক্তে তার যে বইছে মামা ঋত্বিক ঘটকের রক্ত চলচ্চিত্র তো তাকে পাগল করবেই। রাহুল যদি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী না হতো তাহলে আজকে সে বড় চলচ্চিত্রকার হতোই।

স্মরণ হচ্ছে মন্টুদার দোকান থেকে কিনেছি বহু লিটল ম্যাগাজিন। যে-ই লিটল ম্যাগাজিন বের করুক না কেন মন্টুদার দোকান ছাড়া উপায় নেই। মন্টুদা যতœসহকারে সেটা ঝুলিয়ে রাখতেন। নতুন, পুরাতন কাস্টমার এলে বলতেন, এটা নেন ভালো কাগজ। এভাবে পিআর এর মাধ্যমে মন্টুদা লিটল ম্যাগ আন্দোলনকে এখনো পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছেন। মনে পড়ছে লুকিয়ে লুকিয়ে রাতের বেলা কিনেছি ‘নরনারী’, ‘কামনা’, ‘ললনা’, ‘চিকিৎসা’ প্রভৃতি যৌন পত্রিকাও। হাতে নিয়েই মুড়ে ফেলতাম। তিনি মুচকি হাসতেন। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে, মন্টুদার চোখের সামনে আমরা লক লক করে বেড়ে উঠেছি লজ্জামেশানো বয়স নিয়ে কিন্তু টের পাইনি।

এখন কত বিচিত্র পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। ছোট্ট দোকানটিতে জায়গা দেয়া যাচ্ছে না এত বিস্তর কাগজ প্রতিদিনই আসছে। শিক্ষিতের হার যেমন বাড়ছে তেমনি পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। ডিজিটাল যুগেও প্রিন্টিং এখনো জনপ্রিয়। এক কুমিল্লা শহর থেকেই এখন ট্যাবলয়েড সাইজের ১০-১২টির বেশি রঙিন দৈনিক ও সাপ্তাহিক খবরের কাগজ প্রকাশিত হচ্ছে। সেগুলো টানানো আছে মন্টুদার দোকানে। আমার সম্পাদিত ‘কিশোরচিত্র’ পত্রিকাটিও তিনি স্থান করে দিয়েছেন তাঁর দোকানে। এক সময় আমার ‘মানচিত্র’ কাগজটিও মন্টুদার দোকানে ঝোলানো থাকতো।

মন্টুদার পত্রিকার দোকান এই কুমিল্লা শহরের অন্যতম একটি মুখ, পরিচিতি ও ঐতিহ্য। কুমিল্লার মুদ্রণ সংস্কৃতির প্রদর্শনকেন্দ্র কিংবা বলা যায় সংবাদপত্রের এক চলমান জাদুঘর।

মন্টুদার দীর্ঘায়ু জীবন কামনা করি। তিনি আগামী আরও বহুদিন আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকুন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

প্রবীর বিকাশ সরকার : সম্পাদক, কিশোরচিত্র।(ডিনিউজ)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়