Sunday, June 16

কুষ্টিয়ায় নানা সংকটে আ.লীগ!

কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়ার চারটি আসনের মধ্যে চারটিতেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে নয়, নিজ দলের নেতারা পরষ্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগে। দীর্ঘ নয় বছর ধরে সম্মেলনই করতে পারেনি কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগ। ফলে এখানকার আসনগুলোতে এমপি এবং স্থানীয় নেতা-কর্মীতে চতুর্মুখি সংকট চলছে। পাশাপাশি ওই নির্বাচিত এমপিদের অনেকেই এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সারা দেশের ন্যায় কুষ্টিয়ায় পরিচালিত এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এ খবর বেরিয়ে এসেছে। 
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বহুমুখী সংকট-সংঘাত সাংগঠনিকভাবে কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগকে দুর্বল করছে। নেতায়-নেতায় দ্বন্দ এখনই বন্ধ না হলে আসছে স্থানীয় এবং জাতীয় নির্বাচনে জয়ের মুখ না দেখতেও পারে দলটি। এ বিষয়ে স্থানীয় নেতারা তো বটেই ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতারাও বিব্রতবোধ করছেন। কারণ, কুষ্টিয়ায় নেতায়-নেতায় দ্বন্দ এবং বহুমুখী সংকট-সংঘাত’র পেছনে ক্ষমতাসীন দলটির এক কেন্দ্রীয় নেতার ”অযাচিত হস্তক্ষেপের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজ প্রায় এক বছর আগে শুরু হলেও আজও দলই গোছাতে পারেনি কুষ্টিয়া জেলা ও ৬টি উপজেলা আওয়ামীলীগ। বিভিন্ন ইস্যুতে শহরে শোডাউন ও কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ত্রিমুখী জেলা কমিটির কার্যক্রম। গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের দিন অসম্পূর্ণ জেলা কমিটিগুলোর কাউন্সিল ফেব্র“য়ারি মাসের মধ্যে শেষ করার দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশিত সময়ের তিন মাস পার হলেও কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগ মেয়াদোত্তীর্ণ অনেক ইউনিয়ন এমনকি ৬টি উপজেলায় কাউন্সিল করতে পারেনি। ফলে আগোছালো ও সমন্বয়হীনতার মধ্যেই চলছে সরকারি দলটির কার্যক্রম। ফলে এক সময় কুষ্টিয়ার রাজপথ কাঁপানো আওয়ামী লীগও ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের রাজপথে দেখা মেলাভার। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ১৫ এপ্রিল সর্বশেষ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। বিগত সংসদ নির্বাচনের পর থেকে জেলা কমিটির সভাপতি ও সদর আসনের সাংসদ খন্দকার রশীদুজ্জামান দুদু মস্তিস্ক জনিত গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে ঢাকায় থাকায় গত দীর্ঘ প্রায় চার বছর ধরে জেলার মানুষ তাঁর মুখ আর দেখতে পায়নি। সহ-সভাপতির দীর্ঘ তালিকার সাত জনের মধ্যে খন্দকার জুলফিকার আলী আরজুকে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালনের বদলে চালিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য দলের ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের। 
এবিষয়ে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেছেন, সভানেত্রী শেখ হাসিনা মাঠ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। যে সব সংকট রয়েছে তা অচিরেই দূর হয়ে যাবে। একটা বড় দলে এ ধরণের সংকট থাকতেই পারে। তবে আগামী নির্বাচনে যাতে এর প্রভাব না পড়ে সেজন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। অনুসন্ধান প্রতিবেদন এবং স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক এ্যাডঃ বায়েজিদ আককাস, দৌলতপুর উপজেলা কমিটির আহবায়ক এ্যাডঃ সরোয়ার জাহান বাদশা এবং উপজেলা কমিটির সাবেক সাধারন সম্পাদক এ্যাডঃ শরীফ উদ্দিন রিমনের সঙ্গে কুষ্টিয়া-১ আসনের এমপি আফাজ উদ্দিন আহমেদেও বিরোধ দীর্ঘদিন যাবত চলছে। এদের মধ্যে, একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমূর্ল কমিটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক এ্যাডঃ বায়েজিদ আককাস চলেন ভিন্ন ধারায়। এই আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী এ্যাডঃ বায়েজিদ আককাস বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এ দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দলের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীর ঐক্য এখন জরুরী। কিন্ত গোটা দৌলতপুর উপজেলায়ই দলের তৃর্ণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সাংসদ আফাজ উদ্দিন আহমেদের গত সোয়া চার বছরের যোগাযোগহীনতা আওয়ামী লীগকে চরম দূর্বল করেছে বলেও মন্তব্য করেন এ্যাডঃ বায়েজিদ আককাস। সাংসদ আফাজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের বহুমুখী সংকট-সংঘাত, তাঁর বৈঠকখানায় বোমা হামলা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ এখন তুঙ্গে। এই আসনে এমপি স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না এবং তাঁর পুত্র আরিফের অনৈতিক কর্মকান্ডের ফলে গত চার বছরে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা একাধিবার বিক্ষোভ করেছেন। আর সে সব বিক্ষোভ দমাতে এমপি পুত্র আরিফ বাহিনী রীতিমতো নিজে দলীয় নেতা-কর্মীদেরও ছাড় দেয়নি বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে এলাকায়। কুষ্টিয়া-১ আসনের এমপি আফাজ উদ্দিন আহমেদ এবং তাঁর পুত্র আরিফ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গত চার বছরে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছেন উপজেলা কমিটির আহবায়ক এ্যাড. সরোয়ার জাহান বাদশা ও দলটির সাবেক সাধারন সম্পাদক এ্যাড. শরীফ উদ্দিন রিমন। 
কুষ্টিয়া-২ আসনের এমপি জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক ওই আসনে বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত এমপি প্রার্থী মাহবুব-উল-আলম হানিফের দ্বন্দ এক সময় প্রকাশ্য থাকলেও এখন তা অন্তমুখী। দলের দুঃসময়ে ওই আসনে আওয়ামী লীগের কান্ডারী মাহবুব-উল-আলম হানিফ এখন জাতীয় নেতা। ফলে একই নির্বাচনী এলাকায় মহাজোটের দুজন জাতীয় নেতার বাড়ি হওয়ায় প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের পর এ দ্বন্দ মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে, গত প্রায় বছর দুয়েক হলো মাহবুব-উল-আলম হানিফ কুষ্টিয়া সদর আসনমুখী হওয়ায় তাঁর সমর্থক স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সাথে জাসদ কর্মীদের বিরোধ এখন কমে এক ধরনের সমন্বয় তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। মিরপুর-ভেড়ামারা আসনের এমপি জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু রাস্তা, ব্রিজ, কালভাট উদ্বোধন ছাড়া নির্বাচনী এলাকায় যান না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে, এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা জাসদ সভাপতি গোলাম মহসিন।
কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাংসদ রাশিদুজ্জামান দুদু এবং প্রভাবশালী নেতা ও পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলী একসঙ্গে বিগত জাতীয় নির্বাচনে ভোট প্রার্থনা করলেও ইলেকশনের পর আবারো আনোয়ার আলী ও দলের কমিটির সাধারন সম্পাদক আসগর আলী এবং অপর অংশের দ্বন্দ প্রকট হয়ে উঠেছে। এখানে কখনো ত্রিমুখী আবার কখনো চতূরমুখী সংকট প্রায়ই সংঘর্ষে রূপ নেয়। দলের সাবেক সাধারন সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলী সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব-উল-আলম হানিফের বিরোধ রয়েছে বলে অভিযোগ।
কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের এমপি রাশিদুজ্জামান দুদু গত সোয়া চার বছরে সব মিলিয়ে মাত্র ৪/৫ বার নির্বাচনী এলাকায় পা রেখেছেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে গত চার বছর ধরে শারীরিক অক্ষমতার কারনে তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়েও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। সাংসদের অবর্তমানে তাঁর স্ত্রীই সবকিছু দেখ-ভাল করেন। ফলে স্থানীয় নেতা-কর্মী এবং এলাকার রাজনীতির সাথে বিগত চার বছর ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এই এমপির কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে সকলেই জানেন। দলের জেলা সভাপতি ও এমপি বিহীন আওয়ামী লীগে দেখা দিয়েছে চরম আস্থাহীনতা আর নেতৃত্বের কোন্দল। দেখা দিয়েছে বিভক্তি। অভ্যন্তরীণ বিরোধ আর বিভক্তির কারণে ক্ষমতায় থেকেও তেমন সুবিধা করতে পারছে না দলটি। উপরন্তু নেতাদের পারস্পরিক বিরোধের কারণে মাঠে না থেকেও ফায়দা লুটছে বিএনপি। প্রভাবশালী নেতা ও পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলী সমালোচনা করে বলেন, সদর আসনের মতো অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে একদিকে সাংসদের অসুস্থতায় এখন তিনি পুরোপুরি অক্ষম হওয়ায় এ আসনটি ফের হাতছাড়া হচ্ছে, অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে দলের জেলা কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় রাজনৈতিকভাবে চরম দূর্বল হয়ে আওয়ামী লীগ। তিনি অভিযোগ করে বলেন, গণতন্ত্রে জবাবদিহি আছে, জনগণ প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হবে। কিন্ত এখানে গণতন্ত্র আছে, আছে জনগণের প্রশ্ন, কিন্ত জবাবদিহি করবে কে আর উত্তরই বা দেবে কে?
কুষ্টিয়া-৪ আসনে কয়েকজন প্রভাশালী নেতাকে বাদ দিয়ে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পান রাজনৈতিক পরিবারের গৃহবধূ সুলতানা তরুন। জেলা পরিষদের প্রশাসক জাহিদ হোসেন জাফর, এক কেন্দ্রীয় নেতার আর্শীবাদপুষ্ট খোকসা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দলের জাতীয় পরিষদ সদস্য আলহাজ্ব সদর উদ্দিন খান ছাড়াও স্থানীয় কতিপয় সুযোগ-সন্ধানী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুলতানা তরুনের সংকট এখন প্রকাশ্য। খোকসা ও কুমারখালী উপজেলা নিয়ে গঠিত কুষ্টিয়ার এই আসনে এমপি-নেতায় বিরোধ নিয়ে এখন দ্বিধাবিভক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ। আর এ বিরোধ মারাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে দলকে বলে মন্তব্য তৃনমূল নেতা-কর্মীদের। এ আসনের এমপি সুলতানা তরুন রাস্তা-ঘাট উদ্বোধন ছাড়া নির্বাচনী এলাকায় যান না জানিয়ে কুমারখালী উপজেলা পরিষদর চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ বলেন, এমপিকে এলাকার জনগণ আরো বেশি কছে পেতে চান।
খোকসা উপজেলা পরিষদর চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আলহাজ্ব সদর উদ্দিন খানের অভিযোগ, এমপির সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীদের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এমপি এলাকায় আসেন না, তাঁর পুত্র ঢাকাতে চাল-গমের ভাগ বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তাঁরা। অবশ্য, এমপি সুলতানা তরুনের সঙ্গে খোকসা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের এই জাতীয় পরিষদ সদস্য সদর উদ্দিন খানের বিরোধের কথা শুধু এলাকারই নয় জেলার সবাই জানেন। এই আসনে এমপি-নেতাদের পারস্পরিক বিরোধের কারণে মাঠে না থেকেও ফায়দা লুটছে বিএনপি। সরকার গঠনের পর থেকেই কুমারখালী-খোকসায় দুর্বল হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। সরকার ও দলের মধ্যে দিন দিন দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি পুনর্গঠন তো দূরের কথা এ দু উপজেলায় বিরাজমান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ নিরসনেও জেলার নেতারা কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। ফলে, কুষ্টিয়া-৪ আসনে আওয়ামী লীগ এখন নিজেই নিজের শক্র। এদিকে, এ সকল বিষয়ে এমপি বেগম সুলতানা তরুনের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার যোগ্য পুত্র হিসাবেই গোলাম মূর্শেদ পিটারকে দায়িত্ব দেয়া রয়েছে বলেই না সে তাঁর নির্বাচনী এলাকার তদারকী করে। যারা দলের বিরোধী একমাত্র তারাই তাঁর পুত্রের বিরুদ্ধে নানা অপবাদ আর রটনা রটিয়ে সরকারের এবং তাঁদের ভাবমূর্তি নষ্টের অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন বলেও এমপি সুলতানা তরুনের মন্তব্য করেন।(ডিনিউজ)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়