Friday, June 21

সন্ত্রাস বিরোধীআইন :উদ্দেশ্যও বাস্তবতা

এহসানুল হক জসীম
বহুল আলোচিত "সন্ত্রাস বিরোধী (সংশোধন) বিল, ২০১৩" গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয়। বিরোধী দল এ বিল পাসের বিরোধিতা করে। এটাকে তারা দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য আইন হিসেবে অভিহিত করেছে। ১৯৭৪ সনে প্রণীত বিশেষ ক্ষমতা আইনের চাইতেও এটিকে আরো 'কালো' এবং 'ভয়ংকর' হিসেবে উল্লেখ করেছে। বলেছে সংবিধান বিরোধী। বিএনপি ও তার মিত্রদের অভিযোগ সরকার শুধু বিরোধী দলের গণআন্দোলন দমনের জন্য এ আইনে সংশোধনী এনেছে। এর প্রতিবাদে বিলটি পাসের মুহূর্তে তারা সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে-'বিলটি বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি ও নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি অতীব গুরুত্বপুর্ণ বিল'। 

সরকার মূল আইনটি ২০০৯ সালে সংসদে পাস করে। ঐ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আইনটি রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সরকার বিরোধী দলকে দমনের জন্য আইনটি পাস করে বলে সে সময়ও অভিযোগ ওঠে। তিন বছর যেতে না যেতেই সরকার আইনটি সংশোধন করে, যা ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে এবং গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এক বছর যেতে না যেতেই আবারো সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

কী আছে বিলটিতে? কেনই বা এত আলোচনা, সমালোচনা? আসলে এ বিলে অনেকগুলো অসংগতি ও কালো দিক রয়েছে। আমরা এখানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ, বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ এবং পুলিশকে প্রদত্ত অপরিসীম ক্ষমতার বিষয়ে একটু আলোচনা করার প্রয়াস পাব। 

তথ্য-প্রযুক্তির জয় জয়কার আজ বিশ্বময়। চলছে অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগ। এ সময়ে সামাজিক নেটওয়ার্কের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রচেষ্টা মোটেও কাম্য নয়। কিন্তু সংশোধিত এ আইনের ২১ ধারার (৩) উপ-ধারায় বলা হয়েছে-"কোন সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সত্তা কর্তৃক ব্যবহূত ফেসবুক, স্কাইপি, টুইটার বা যে কোন ইন্টারনেট এর মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা অথবা তাহাদের অপরাধ সংশ্লিষ্ট স্থির বা ভিডিও চিত্র পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক কোন মামলার তদন্তের স্বার্থে যদি আদালতে উপস্থাপন করা হয়, তাহা হইলে সাক্ষ্য আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, পুলিশ বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক আদালতে সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য হইবে।" পুলিশের এ 'সাক্ষ্য'র ভিত্তিতে একজন ফেসবুক বা অন্য মাধ্যম ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেলের ঘানি টানতে হতে পারে। 

প্রচলিত সাক্ষ্য আইনে এ ধরনের আলামত আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়। আর তাই 'যাহা কিছুই থাকুক না কেন'- এমন অংশের সংযোজনের মধ্য দিয়ে এ আইনে স্পষ্টভাবে সাক্ষ্য আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত: সরকার ফেসবুক-টুইটার ব্যবহারকারীদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করেছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক ব্যবহারে সাবধান করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে সরকার একজনের ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং তার চিন্তা ও সমালোচনার স্বাধীনতার উপর সুস্পষ্টভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। যা মানবাধিকারেরও লংঘন বটে। তৃতীয়ত: ভিন্নমতাবলম্বীদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে এ আইনে। চতুর্থত: এই বিল পাসের মধ্য দিয়ে পুলিশকে অপরিসীম ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, যে ক্ষমতার একটা অংশ বিচারক-জজ সাহেবদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া। পুলিশও আমাদের ভাই। আমরা তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির বিরোধিতা করতে পারি না। কিন্তু যে ক্ষমতা বিচারক-ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া, সাধারণ জনগণের মৌলিক মানবাধিকার লংঘন করে প্রদান করা, এমনকি পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও ক্ষমতা খর্ব করে এ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা-আমরাতো এমন অপরিসীম ক্ষমতাকে মেনে নিতে পারি না। পুলিশের এসি, ডিসি, এসপি বা এএসপিদের ক্ষেত্রে বিষয়টি হয়তো অন্যভাবে ভাবা যেতো। কিন্তু একজন সাধারণ এসআই একজন সাংবাদিককে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করতে পারবে, ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া যে কোন নাগরিকের মালামাল ক্রোক করতে পারবে—এমনটি মেনে নেয়া কিভাবে সম্ভব হতে পারে?

এখন কথা হলো ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে একজন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী বানানো কিংবা অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করার কোন যুক্তি আদৌ আছে কি? ভুয়া আইডি খুলে যে কেউ এই কাজ করতে পারে। কেউ যদি ফেসবুক-টুইটারে অন্যায় কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ করে কিংবা অশ্লীল ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়- সে ব্যাপারে আমাদের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ছিল। 

এবারের সংশোধিত এ বিলে পুলিশকে শুধু যেনতেন রকমভাবে গ্রেফতার করার ক্ষমতাই দেয়া হয়নি; তাদেরকে মামলা করার অবাধ ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। মামলার বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে শুধু অবহিত করা হবে। এমনিতেই আমাদের দেশের পুলিশের দুর্নামের অন্ত নেই। ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তো অহরহ। সেখানে যদি বিচারক আর ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতা কমিয়ে পুলিশের ক্ষমতা বাড়ানো হয়, সন্দেহ নেই এটা জাতির জন্যে এক অশনি সংকেত।

আওয়ামী লীগ তার বিগত আমলের শেষ বছরে তথা ২০০০ সালে কুখ্যাত জননিরাপত্তা আইন করেছিল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে। ওই সময়ে ঢালাওভাবে বিরোধী নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হয়েছিল। ওই জননিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের ফলে পরবর্তী নির্বাচনে তারা মাত্র ৬২ আসন পেয়েছিল। এবারো এ পথে হাঁটছে সরকার। অন্যদিকে বিএনপি এ আইনকে 'কালো আইন', 'সংবিধান বিরোধী আইন' এবং 'নিপীড়নমূলক আইন' বললেও 'বিএনপি ক্ষমতায় আসলে এ আইন বাতিল করা হবে'—এমন ঘোষণা কিন্তু দেয়নি। অতএব বার্তা স্পষ্ট। দুই পক্ষের ক্ষমতার লড়াইয়ে মধ্যখানে পিষ্ট আমরা যারা আমজনতা।

লেখক : সাংবাদিক ও এম.ফিল. গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল: ehsan.jasim@yahoo.com



শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়