ঢাকা : ভারতের ইতিহাসে তাকে সবাই ভালভাবে চেনেন। জীবনের শেষ দু’বছর তিনি মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তার লাঠির মতো লেগে ছিলেন। তার হাঁটা, তার চলার সঙ্গে তিনি ছিলেন অবলম্বন। তারপরও তিনি রহস্যময়ী। তাকে নিয়ে এখনও রয়েছে নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসা। ১৯৪৬ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। গান্ধীকে হত্যা করার পূর্ব পর্যন্ত তিনিই ছিলেন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচরী, সঙ্গী। হ্যাঁ, তার নাম মৃদুলা গান্ধী। তাকে মনুবেন নামেও অনেকে চেনেন। এই মনুবেন দিল্লিতে ৪০ বছর বয়সে অবিবাহিত অবস্থায় নিঃসঙ্গ হয়ে জীবনের ইতি টানেন। রিচার্ড অ্যানেবরোর নির্মাণ করা ‘গান্ধী’ ছবিতে তার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুপ্রিয়া পাঠক। এই মনুবেনের মৃত্যুর চার দশকেরও বেশি সময় পরে মনুবেনের লেখা ১০টি ডাইরির সন্ধান মিলেছে। এগুলো গুজরাটি ভাষায় লেখা। এর কলেবর ২০০০ পৃষ্ঠা। এসব ডাইরি নিয়ে গবেষণা করেছেন গুজরাটের শিক্ষাবিদ রিওয়ান কাদরি। ১৯৪৩ সালের ১১ই এপ্রিল থেকে মনুবেন ওই ডাইরি লেখা শুরু করেন। এতে প্রকাশ পেয়েছে মনুবেনের ওপর গান্ধীর যৌন পরীক্ষার মনোস্তাত্ত্বিক প্রভাব কি পড়েছিল। তখন গান্ধীকে ঘিরে তার আরও যেসব তরুণী ছিল তাদের মধ্যে এ জন্য ঈর্ষা ফুটে উঠেছিল। দেখা দিয়েছিল ক্ষোভ। মনুবেনের লেখা ডাইরির বিভিন্ন সময়ের চুম্বক অংশও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মনুবেন যখন গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরব কে দেখাশোনা করার জন্য পুনেতে আগা খান প্যালেসে যান তখন থেকেই এ ডাইরি লেখা শুরু। কস্তুরবাকে জীবনের শেষ কয়েক মাস নার্সিং করতেন মনুবেন। ১৯৪৩ সালে লেখা শুরু হলেও ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারির ২২ দিন পরে তা শেষ হয়। ওইদিন নাথুরাম গডসে মনুবেনের পাশ থেকে ৯ এমএম বেরেটা থেকে গান্ধীকে তিনটি গুলি করে। মনুবেনের এই ডাইরিতে মাঝেমধ্যে স্বাক্ষর করেছেন গান্ধী। ১৯৪৬ সালের ২৮শে ডিসেম্বর ডাইরিতে বিহারের শ্রীরামপুর থেকে মনুবেন লিখেছেন, ‘বাপু আমার কাছে মায়ের মতো। ব্রহ্মাচার্য্যরে পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি আমার মানবিক শিক্ষাকে উন্নীত করেছেন। ব্রহ্মাচার্য্য হলো চরিত্র গঠনের এক মহাযজ্ঞ। এই পরীক্ষা নিয়ে কেউ যদি বাজে কথা বলেন তাহলে তা ভীষণ নিন্দনীয়।’ গান্ধীর সেক্রেটারি পিয়ারি লাল এই দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তুলেছেন ‘মহাত্মা গান্ধী: দ্য লাস্ট ফেজ’-এ। তিনি এতে লিখেছেন, তিনি (গান্ধী) তার (মনুবেন) জন্য সবকিছুই করেছেন, যা সাধারণত কোন মা তার মেয়ের জন্য করে থাকেন। তিনি তার শিক্ষা, খাদ্য, পোশাক, বিশ্রাম ও ঘুমের বিষয়ে তদারক করতেন। ঘনিষ্ঠভাবে তার দেখাশোনা ও গাইড দেয়ার জন্য তিনি তাকে নিয়ে একই বিছানায় ঘুমাতেন। কোন একজন মেয়ে, যদি তার মন নিষ্পাপ হয়, তাহলে তার মায়ের সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমানোতে সে কখনও বিব্রত হবে না। মনুবেন ছিলেন তার প্রাথমিক ব্যক্তিগত সহযোগী। তিনি তাকে ম্যাসাজ করে দিতেন, গোসল করিয়ে দিতেন। এমনকি তার খাবার রান্না করে দিতেন।
মনুবেনের ডাইরিতে বেরিয়ে এসেছে গান্ধীর সঙ্গে অন্য নারীদের যে সম্পর্ক ছিল সে বিষয়ও। এর মধ্যে রয়েছেন ডা. সুশিলা নায়ার। তিনি ছিলেন গান্ধীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও পিয়ারি লালের বোন। তিনি পরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। মহাত্মার অযৌন অথচ যৌন পরীক্ষায় কে হবে তার পরীক্ষার অংশ তা নিয়ে তাদের মধ্যে ছিল তীব্র ঈর্ষা। ১৯৪৭ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি মনুবেন বিহারের হাইমচর থেকে লিখেছেন, ‘আজ বাপু আমতুস্সালামবেনকে কড়া একটি চিঠি লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, তার সঙ্গে কৌমার্য্যরে পরীক্ষা করা হয় নি- বলে একটি চিঠি লিখেছেন তাকে।
এসব ডাইরি ২০১০ সালে দিল্লিতে জাতীয় আরকাইভে চলে গেছে। এতে আরও দেখা যায় ৪৭ বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও পিয়ারি লাল সুশিলা নায়ারকে নিয়ে মনুবেনের কাছে নানা কথা বলতেন। ১৯৪৭ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মনুবেন বিহারের দাস্তধারিয়া থেকে লিখেছেন, ‘ আমি পিয়ারি লালকে আমার বড় ভাইয়ের মতো দেখি। এর বাইরে কিছুই নয়। যেদিন আমি আমার গুরুকে, আমার বড় ভাইকে অথবা আমার গ্রান্ডফাদারকে বিয়ের করার সিদ্ধান্ত নেব সেদিন আমি তাকে বিয়ে করব। এ নিয়ে আমার সঙ্গে কোন বাড়াবাড়ি করো না।’ কৌমার্য্যরে পরীক্ষা নিয়ে গান্ধীর অনুসারীদের মধ্যে এক ধরনের নীরবতা লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৭ সালের ৩১শে জানুয়ারি। সেদিন বিহারের নবগ্রাম থেকে ডাইরি লিখেছেন মনুবেন। এতে তিনি গান্ধীর ঘনিষ্ঠ এক অনুসারী কিশোরী লাল মাশরুওয়ালার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। গান্ধী তাকে মায়া নামে ডাকতেন। তিনি মহাত্মাকে লঠি থেকে নিজেকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর জবাবে গান্ধী বলেছেন, তোমার যা খুশি তা-ই কর। কিন্তু এই পরীক্ষার মাধ্যমে আমি ভাল আছি।
মনুবেন এবং গান্ধী যখন বাংলাদেশের নোয়াখালীর ভিতর দিয়ে হাঁটছিলেন তখন তার সঙ্গে দুজন সঙ্গী ছিলেন। তাদের একজন হলেন আরপি পরশুরাম। তিনি তার সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরেকজন হলেন নির্মল কুমার বোস। তিনিও তার সেক্রেটারি ছিলেন। পরে অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার পরিচালক হন তিনি। তারা দু’জনেই গান্ধীর ব্যবহারে কষ্ঠ পেয়েছিলেন। গান্ধীকে ১৯৪৭ সালের ২৫শে জানুয়ারি এক চিঠি লেখেন সরদার বল্লভভাই পাতেল। বর্তমানে পাতেল পেপারস নামে ওই চিঠিটি রয়েছে জাতীয় আরকাইভে। তিনি ওই চিঠিতে কৌমার্য্যরে ওই পরীক্ষা বন্ধ করতে বলেছিলেন। পাতেল এ পরীক্ষাকে ভয়াবহ এক কর্মকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ১৯৫৫ সালের আগস্টে অজ্ঞাত এক রোগে অসুস্থ হয়ে মুম্বই হাসপাতালে ভর্তি হন মনুবেন। এ প্রসঙ্গে ওই বছরের ১৯শে আগস্ট মোরাজি দেশাই একটি চিঠি লেখেন জওয়াহার লাল নেহরুকে। এতে দেশাই লিখেছেন- মনুর সমস্যা যতটুকু শারীরিক তার চেয়ে বেশি মানসিক। সে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। সব রকম ওষুধেই তার এলার্জি হচ্ছে।
১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি বিকাল ৫টা ১৭ মিনিটে দিল্লির বিরলা হাউজে মহাত্মাকে যখন নাথুরাম গডসে গুলি করে তখন মহাত্মার পাশে যে দু’জন ছিলেন তাদের একজন মনুবেন। আরেকজন ছিলেন আভাবেন গান্ধী। তিনি তার ভাতিজা কানু গান্ধীর স্ত্রী। পরের দিন মনুবেন লিখেছেন- যখন বাপুর মৃতদেহে আগুন দেয়া হয় সেই আগুনে তাকে যখন গ্রাস করছিল তখন মনে হচ্ছিল ওই আগুনে আমি বসে আছি এবং তা অব্যাহত থাকবে চিতায় যতক্ষণ আগুন থাকবে। সরদার পাতেল আমাকে সান্তনা দিয়েছেন। আমাকে নিয়ে গিয়েছেন তার বাড়িতে। আমার কাছে এটা ছিল একটি অকল্পনীয় বিষয়। এখানেই দু’দিন আগে ছিলেন বাপু। গতকালও এখানে ছিল তার দেহ। কিন্তু আজ! আজ আমি একেবারে একা। আমি একেবারে হতাশ। এরপর ডাইরিতে সর্বশেষ লেখা লিখেছেন ১৯৪৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। এদিন তিনি ট্রেনে করে দিল্লি থেকে মহুয়া ফেরেন। এদিন তিনি লিখেছেন- আজ আমি দিল্লি ছাড়লাম। কাকা (গান্ধীর ছোট ছেলে দেবদাস) আমাকে সতর্ক করেছেন আমি যেন এই ডাইরি কোনদিন কারো কাছে প্রকাশ না করি। তিনি বলেছেন, তুমি এখনও যুবতী। কিন্তু এখনও তোমার মধ্যে রয়েছে মূল্যবান সাহিত্য।(ডিনিউজ)
খবর বিভাগঃ
দেশের বাইরে
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়