Sunday, May 19

লাল অশ্বথ

শারমিন আক্‌তার
এক
ঢাকা শহরের প্রান্তে পতিত জমির উপর ডোবার আশে পাশে চিন্তিত মনে ঘোরাঘুরি করছেন ড. আশফাক চৌধুরী । দু’ তিনটি মাস্তান গোছের ছেলে সেখানে আসলো। তাদের মধ্য থেকে একজন ড. আশফাকের উদ্দেশ্যে বলল-
- সলামালাইকুম । কেমন আছেন স্যার ?
- ওয়াআলাইকুম । ভাল । তোমাদেরকে ঠিক চিনতে পারলাম না ।
- আমাগো আপনি চিনবেন না । আর চেনারও দরকার নেই । যা বলছি শুধু সেটা মনে রাখার চেষ্টা করবেন । আর পালন করবেন । ব্যাস্ হয়ে গেল । তাতে আপনারও লাভ, আমাদেরও লাভ । নইলে.....।
- তোমাদের কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না ।
-শুনেন বিজ্ঞানী সাহেব! পাগলামী ছাইড়া সঠিক পথে চইলা আসেন । কি দরকার কোটি টাকার জায়গায় জঙ্গল করার ? কোটি টাকার জায়গায় কোটি টাকার কারবার হইবো । এখানে দশতলা বিল্ডিং হইবো । সুইমিং পুল। দু’ টাকার গাছ লাগাইয়া কি লাভ ? মাথা খারাপ হইছে নাকি আপনার ? একটা ডাক্তার দেইখা লইয়েন । আর আপনার সাথে সাথে মনে হচ্ছে সরকারের কয়েকজন লোকেরও মাথা খারাপ হইয়া গেছে । কি সব কারবার ! সব গুলারে পাবনায় পাঠানো দরকার ।
সবাই হো হো কেরে হেসে উঠলো । আশফাক সাহেব তাদের কথার জবাবে একটি কথাও বললেন না । আর কি বা বলতে পারেন তিনি ? যে দেশের উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষিত লোকেরাও প্রকৃতি ও পরিবেশর মূল্য বুঝে না, সেখানে অশিক্ষিত গুন্ডারা বুঝবে কি করে ?
সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সহযোগীতায় এ জায়গার উপর একটা এনভায়রোনমেন্টাল ইনস্টিটিউট এবং তার আশে পাশে বিভিন্ন ধরণের এনডেনজারড প্লান্ট সহ ঔষধি ও ফলজ গাছের বাগান তৈরীর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে একটি বেসরকারী এন.জি.ও.। ড. আশফাক পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ অধিদপ্তরে চীফ এনভায়রোনমেন্টালিস্ট হিসাবে কাজ করছেন । দেশের পরিবেশ রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন তিনি। পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাকে প্রায়ই প্রধান প্রতিনিধি হিসাবে পাঠানো হয় বিভিন্ন দেশে । পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেই তাকে স্পেশালিস্ট হিসাবে পাঠানো হয়েছে এই এনভায়রোনমেন্টাল ইনিস্টিটিউট এর কাজ পর্যবেক্ষণ করার জন্য ।


দুই
বেসরকারী এন.জি.ও.টির চেয়ারম্যান ড. আশফাকের সাথে দেখা করতে আসলেন ।
- আসসালামুআলাইকুম স্যার ।
- ওয়াআলাইকুম আস্‌সালাম ।
-কেমন আছেন স্যার?
-এইতো, ভাল আছি । আপনার কি খবর?
- স্যার আছি কোন মতে ।
- আমি ঠিক বুঝলাম না । কালকে সাইটে গিয়েছিলাম । গুন্ডা টাইপের কয়েকটা ছেলে এসেছিল । মনে হল ওখানে ইনস্টিটিউট হোক ওরা চায়না । কে ওরা?
- ওরা লস্করের লোক ।
- লস্কর! সে আবার কে?
- বেশ ক্ষমতা ওয়ালা লোক সে । বেআইনীভাবে জায়গাটা দখল করে তার লস্কর রিয়েল স্টেটের অধীনে নিয়ে প্লট আকারে বিক্রির প্লান করেছে ।
- কেন? ওটা তো সরকারের খাঁস জমি ?
-হ্যাঁ স্যার । তারপরও ক্ষমতার জোর খাঁটিয়ে জায়গাটা নিজের কাজে লাগাতে চায় সে ।
- আচ্ছা আপনি আপনার কাজ এগিয়ে নেন । আমি বিষয়টা দেখবো । স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলা হবে ।
ড. আশফাক বেশ আশ্বাসের সূরে এন.জি.ও.টির চেয়ারম্যানকে বললেন । আশ্বাস পেয়ে কিছুটা সাহসের সাথে ড. আশফাকের দিকে তাকিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব বললেন
-স্যার পরিবেশ,প্রকৃতি,উদ্ভিদ; এসব কিছু কেউ বুঝে না । বুঝতে চায়ও না । সবাই বুঝে শুধু টাকা । যে জিনিস থেকে কোন ফাইন্যান্সিয়াল হেল্প আসেনা; সে জিনিসের দরকার কি ?
- ঠিকই বলেছেন । এমনকি আমাদের মন্ত্রণালয়ের গুটি কয়েক লোক ছাড়া অন্য সব মন্ত্রণালেয়র কেউ বুঝতে চায়না পরিবেশ ও প্রকৃতির কদর । অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করে- এত গাছ লাগায় করবেন কি ?
মাঝে মাঝে তো দু-একজন ইয়ার্কি করে বলেই ফেলে- দেশটা কি গাছগাছালিতে ভরে ফেলবেন বিজ্ঞানী সাহেব ?
-স্যার সাসটেইন্যাবল ডেভেলোপমেন্টের দিকে খেয়াল না করে শুধু অর্থনৈতিক দিকটা মাথায় রাখলে একদিন দেশ পঙ্গু হয়ে যাবে । মরুভূমিতে রুপান্তরিত হবে আমাদের দেশ ।
উত্তরবঙ্গে তো ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে মরুকরণ ।
তার কথার সাথে সূর মিলিয়ে ড.আশফাক বললেন
- মাথা তুলে দাড়াতে পারবে না । আর উদ্ভিদ ও সুস্থ পরিবেশের কদর না করায় বিভিন্ন ধরণের ব্রাংকিয়াল ও স্কিন ডিজেজ দেখা দিচ্ছে । খাদ্য সংকট, খাবার পানির সংকট তো নিত্ত নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দেখা দিয়েছে ।
-তারপরও স্যার এ ব্যাপারে কারও কোন মাথা ব্যাথা নেই । পরিবেশ ও প্রকৃতির দিকে খেয়াল না করে শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি বিবেচনায় রাখার ফলেই যে এসব হচ্ছে তাই হয়তো অধিকাংশ মানুষ আজও বোঝে না ।
- যাই হোক ইউনেপ থেকেও আমরা বেশ সহযোগীতার আশ্বাস পেয়েছি । আশা করছি আমাদের এনভায়রোনমেন্টাল ইনস্টিটিউট ও গাছ লাগানোর অভিযান বেশ সফল হবে । এখান থেকে বিভিন্ন ধরণের এনডেন্জারড প্লান্ট এবং পাশাপাশি ঔষধি ও ফলজ গাছের চারা উৎপাদন করে বিনা মূল্যে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হবে । আপনি আপনার কাজ এগিয়ে নিন ।
- ও.কে. স্যার । থ্যাংক ইউ ।
-ওয়েলকাম ।

তিন
চরিদিকে অনেক লোক জনের সমাগম । কয়েকটি পত্রিকার ফটোগ্রাফারও এসেছে । প্রস্তাবিত এনভায়রোনমেন্টাল ইনস্টিটিউট এর সম্মুখ প্রান্তে একটি অশ্বথ গাছ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছেন ড. আশফাক । এই কার্যক্রমের অগ্রসেনা হওয়ায় প্রথম গাছ লাগানোর দায়িত্বও পড়েছে তারই কাঁধে । আশফাক সাহেব গাছটা হাতে নিয়ে মাটির গর্তে রোপণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । এমন সময় কোথা থেকে হঠাৎ ড. আশফাকের বুক ভেদ করে গুলি প্রবেশ করল। বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হল । ওহ ! বলেই মটিতে ঢলে পড়ে গেলেন তিনি। গাছটা তার হাত থেকে পাশেই ছিটকে পড়ে গেল । তিনি ডান হাতে বুকের গুলি লাগা যায়গায় চেপে ধরে বাম হাতে ক্রলিং করে অশ্বথ চারাটার কাছে গেলেন । চারাটাকে হাতে তুলে নিয়ে অতি যত্নে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বিদায় বেলায় বাবা-মা সন্তানকে যেমন পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে, ঠিক সেভাবে গাছটাকে আঁকড়ে ধরলেন ড. আশফাক । ফটোগ্রফাররা তার ছবি তুলছে। অধিদপ্তরের কর্মচারীরা ছুটোছুটি করছে । অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হচ্ছে। কেউ গুপ্ত ঘাতকেকে ধাওয়া করার চেষ্টা করছে। সব চেষ্টা, শ্রম ব্যার্থ করে দিয়ে অশফাক সাহেব নিথর হয়ে অশ্বথ গাছ বুকে জড়ায় মাটির উপর পড়ে রইলেন। তার বুকের উপর রক্তে রঞ্জিত লাল অশ্বথ চারাটি দাড়িয়ে আছে । যে অশ্বথ চারার জন্য আশফাক সাহেরে জীবন ঝরে গেল । যে চারাটি আমাদের সুস্থভাবে বাঁচার জন্য তার ছোট্ট রন্দ্রে পৃথিবীর বুকে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল; সেই অশ্বথ চারাটি ও ড আশফাক উভয়েই কালের পাতায় অতীত হয়ে গেলেন।(ডিনিউজ)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়