Saturday, May 18

যেমন হলো পাকিস্তানের নির্বাচন

হামিদ মীর
পাকিস্তানে গত ১১ মে’র নির্বাচনে কেউ বিজয়ী হয়েছেন আবার কেউ মানুষের মন জয় করেছেন। কিছু প্রার্থী জিতেও হেরে গেছেন, আবার কোনো কোনো প্রার্থী হেরেও জিতে গেছেন। নির্বাচনের আগে আমি বার বার বলছিলাম, এবারের নির্বাচনে পাকিস্তানে কোনো বিপ্লব হবে না। সঠিক সময়ে নির্বাচন হওয়া এটা কোনো দল বা প্রতিষ্ঠানের নয় বরং গোটা পাকিস্তানের বিজয়। এছাড়া এবারের নির্বাচনে পাকিস্তানের তরুণরা নিজ নিজ দলের জয়-পরাজয়কে জীবন-মরণের প্রশ্ন বানায়নি। আমরা আগেই জানতাম, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও খায়বার পাখতোয়ায় স্বতস্ফূর্ত নির্বাচন হবে। আবার বেলুচিস্তানে সহিংসতা ও সংঘাতের আশঙ্কা ছিল। আমাদের এটাও আশঙ্কা ছিল, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও খায়বার পাখতোয়ায়ও বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ হতে পারে। কারণ পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন ও স্বায়ত্বশাসিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

১১ মে সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমি যথারীতি করাচিতে স্থাপিত জিও টিভির প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে সম্প্রচারে ব্যস্ত ছিলাম। এ সময় খবর পেলাম করাচির একটি কেন্দ্রে ভোটার আছে কিন্তু পোলিং এজেন্ট নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে সংঘর্ষের খবরও আসতে লাগল। দুপুর ১২টার দিকে এমকিউএম সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, তাদের পোলিং এজেন্টকে গুম করা হয়েছে। দুপুর ২টার দিকে জামায়াতে ইসলামীও করাচি ও হায়দারাবাদে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়। কিছুক্ষণ পর পিপলস পার্টিও সংবাদ সম্মেলন করে।

পাঞ্জকোর, আওয়ারান, খাজদার ও ঢিরাবিগটি এলাকা থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। সেখানে কোনো টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরা ছিল না। এসব এলাকার কয়েকটি কেন্দ্রে সারা দিন নির্বাচনী কর্মকর্তা না থাকলেও সন্ধ্যায় হাজার হাজার ভোট পড়েছে বলে জানানো হয়। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে এটা বলা ভুল হবে না, এবারের নির্বাচনে তালেবানদের পক্ষ থেকে নাশকতার যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল তা না হলেও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও দায়িত্বে অবহেলা ছিল চোখে পড়ার মতো।

সার্বিকভাবে নির্বাচনী ফলাফল অবিশ্বাস্য নয়। বেশির ভাগ জরিপ ও পর্যবেক্ষণে নওয়াজ শরিফের দল মুসলিম লিগের এগিয়ে থাকার বিষয়টি ছিল স্পষ্ট। তবে ইমরান খানের তেহরিক ই ইনসাফ ও বিলওয়ালের পিপলস পার্টি ধারণার চেয়েও কম আসন পেয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণায় মুসলিম লিগের সঙ্গে তেহরিকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্পষ্ট নজরে এলেও ফলাফলে মুসলিম লিগ এগিয়ে, দ্বিতীয় অবস্থানে পিপলস আর তৃতীয় তেহরিক। মুসলিম লিগ পাঞ্জাবে, পিপলস পার্টি সিন্ধুতে আর তেহরিক খায়বার পাখতোয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বেলুচিস্তানে আঞ্চলিক কয়েকটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিছু বালুচ প্রার্থী প্রাদেশিক নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের পক্ষে কাজ করেন, এখন তাদের জাতীয় পরিষদে মূল্যায়ন করা মুসলিম লিগের দায়িত্ব। বেলুচিস্তানে মুসলিম লিগ ধারণার চেয়েও বেশি এবং খায়বার পাখতোয়ায় প্রত্যাশার চেয়ে কম আসন পেয়েছে। তবে জাতীয় পরিষদে তাদের আসন প্রাপ্তি ধারণার কাছাকাছি।
সার্বিক বিবেচনায় এবারের নির্বাচনে খুব বেশি অস্বচ্ছতা নজরে আসেনি। তবে ইমরান খান ২৫ আসনে পুনর্বার ভোট গণনার দাবি জানিয়েছেন। তার কোনো কোনো প্রার্থী পুনর্বার ভোটগ্রহণেরও দাবি করেছেন। কিন্তু এটা কঠিন হবে। তবে করাচির এনআই-২৫০ আসনে পুনর্বার ভোটগ্রহণের দাবি জানিয়েছে এমকিউএম ও তেহরিক ই ইনসাফ। নির্বাচন কমিশনের উচিত অন্তত এই আসনে পুনর্বার ভোটগ্রহণ করা।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা ৯০ ভাগ কেন্দ্রে ভোটের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যে ১০ ভাগ কেন্দ্রের ব্যাপারে অস্বচ্ছতার অভিযোগ করেছেন সেগুলো করাচি, বেলুচিস্তান ও পেশোয়ারে। এছাড়া লাহোরের কিছু কেন্দ্রেও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ শোনা গেছে। পাঞ্জাব, সিন্ধু ও খায়বার পাখতোয়ায় অস্বচ্ছতা ও গোলযোগের অভিযোগ যারা করছেন তাদের উচিত প্রমাণ পেশ করা। তেহরিক ই ইনসাফের প্রচার সম্পাদক ডা. শিরীন মাজারি আমাকে লাহোরের ১২৫ নম্বর আসনের একটি কেন্দ্রের ভিডিও দিয়েছেন। এতে তিনি এক মহিলা জাল ভোট দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন। তবে আমি অভিযোগের তেমন সত্যতা পাইনি।

শুধু তেহরিকই নয় পিপলস পার্টি ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতও জাল ভোটের অভিযোগ করেছে। সিন্ধুতে ন্যাশনাল লিগ, আওয়ামি তাহরিক ও জামায়াতে ইসলামি কারচুপির অভিযোগ এনেছে। বেলুচিস্তানে ন্যাশনাল পার্টিসহ কয়েকটি দল কারচুপির অভিযোগ করেছে। খায়বার পাখতোয়ায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান তেহরিক ই ইনসাফের প্রার্থী বিজয়ী হওয়াকে মেনে নেননি এবং আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। মাওলানা সাহেবের প্রতি আমার অনুরোধ, তিনি যেন অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ পেশ করেন। তিনি হয়তো জানেন না, ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন নেটওয়ার্কের (ফাফিন) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী খায়বার পাখতোয়ার কয়েকটি আসনের যেসব কেন্দ্রে শতভাগের বেশি ভোট পড়েছে এর মধ্যে তেহরিক ই ইনসাফের প্রাদেশিক প্রধান আসাদ কায়সার ও খোদ মাওলানা ফজলুর রহমানও বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের উচিত, কারচুপির অভিযোগের ব্যাপারে চোখ বন্ধ না রাখা। যেসব কেন্দ্রে যথাসময়ে ভোটগ্রহণ শুরু হয়নি অথবা ভোটারের চেয়ে বেশিসংখ্যক লোক ভোট দিয়েছেন অথবা স্থুল কারচুপি হয়েছে সেখানকার নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। অন্যথায় নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে তা বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

নির্বাচনী প্রচারণায় নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ আর ইমরান খানের তেহরিক পরস্পরের কড়া কড়া সমালোচনা করেছে। কিন্তু নির্বাচনে জয় লাভের পর মুসলিম লিগের প্রধান নওয়াজ শরিফ উদারতা দেখিয়ে শওকত খানম হাসপাতালে গিয়ে ইমরান খানের অসুস্থতার খোঁজখবর নিয়েছেন এবং তার সঙ্গে একটি সমঝোতা করেছেন। নওয়াজ শরিফ খায়বার পাখতোয়ায় তেহরিকের বিজয়ও মেনে নিয়েছেন। তিনি খুব সহজেই মাওলানা ফজলুর রহমানের সহযোগিতায় খায়বার পাখতোয়ায় তেহরিককে ক্ষমতার বাইরে রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। খায়বার পাখতোয়ায় আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টিকে বড় পরাজয়ের মুখে পড়তে হতো। কিন্তু আইএনপি নিজেদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়। দলটি হেরেও অনেকের মন জয় করে নিয়েছে। কারণ এই দলটি যদি তালেবানের হামলার পর নির্বাচন বয়কট করতো তাহলে অন্য দলগুলোও এই বয়কটে শরিক হতো। তখন নির্বাচনের আর কোনো গুরুত্ব থাকতো না। আমার এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না, আইএনপি তেহরিক ই ইনসাফ, জিইউআই ও জামায়াতে ইসলামিকে নিজের আহত কাঁধে উঠিয়ে সংসদ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে।

এবারের নির্বাচনে পিপলস পার্টি নিজের ভুলের কারণে নিজেরই ক্ষতি করেছে। যে দলটিকে জেনারেল জিয়াউল হক ও পারভেজ মুশাররফ নিঃশেষ করে দিতে পারেননি সেই দলটি নিজেরাই নিজেদেরকে সিন্ধুতে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। সিন্ধুতেও যদি এই দলটির নেতৃত্ব নির্দিষ্ট একটি পরিবারের কাছে আবদ্ধ থাকে তাহলে একদিন এ প্রদেশেরও তাদের পতন ঘটবে। এই প্রদেশে পিপলস পার্টি জিতেও পরাজিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে দলটি যদি নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সিন্ধুতে একটি পরিচ্ছন্ন শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনসাধারণের সেবা করে যায় তাহলে পাঁচ বছর পর এই পিপলস পার্টিই পাঞ্জাব, খায়বার পাখতোয়া ও বেলুচিস্তানেও বিজয়ী হবে।

দৈনিক জং-এর সৌজন্যে। উর্দু থেকে অনুবাদ: জহির উদ্দিন বাবর

হামিদ মীর: পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক; প্রধান নির্বাহী, জিও টিভি(নতুন বার্তা)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়