:: আবু সাঈদ জুবেরী ::
ছানাপোনাদের নিয়ে আর কোনো চিন্তা নেই ওর। বড় ভাগ্যবতী সে; সব কটি ছেলেপুলে বেশ স্বাস্থ্যবান হয়েছে। প্রথমবার নাকি এরকম খুব একটা হয় না। এরই মধ্যে ছানাপোনারা শিখে গেছে ভালো খাবারটি খেতে। সবুজ শ্যাওলা কোথায় মেলে, কোথায় গেলে পাওয়া যায় মোটাতাজা সোনালি কেঁচো, এসব যেন এখন ওদের নখ-দর্পণে। মাকে আর সাঁতার কেটে দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়ে না। ভালো খাবারের খোঁজ পেলে ওদের কেউ না কেউ ছুটে আসে; বলে, মা, ওমা, দেখে এসো, কী ছুন্দর ছ্যাওলা।
ছানাপোনাদের নিয়ে আর কোনো চিন্তা নেই ওর। বড় ভাগ্যবতী সে; সব কটি ছেলেপুলে বেশ স্বাস্থ্যবান হয়েছে। প্রথমবার নাকি এরকম খুব একটা হয় না। এরই মধ্যে ছানাপোনারা শিখে গেছে ভালো খাবারটি খেতে। সবুজ শ্যাওলা কোথায় মেলে, কোথায় গেলে পাওয়া যায় মোটাতাজা সোনালি কেঁচো, এসব যেন এখন ওদের নখ-দর্পণে। মাকে আর সাঁতার কেটে দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়ে না। ভালো খাবারের খোঁজ পেলে ওদের কেউ না কেউ ছুটে আসে; বলে, মা, ওমা, দেখে এসো, কী ছুন্দর ছ্যাওলা।
গোল্ডা শুধু উচ্চারণটা ঠিক করে দেয়; ছুন্দর না সোনা, সুন্দর, সুন্দর। ছ্যাওলা না, শ্যাওলা।
তারপর সেও ছোটে ছানার পেছনে। দেরি করলে আবার রাক্ষুসে মাছের ঝাঁক চলে আসতে পারে।
শ্যাওলা দেখে গোল্ডার চোখের পাতা পড়ে না। এত বছর কেটে গেল। এই সমুদ্রের নিচে, কখনো এমন বাহারি শ্যাওলার বাগান চোখে পড়ে নি। যেমন ঢেউ খেলানো, তেমনি সবুজ। যতদূর চোখ যায়, শুধু শ্যাওলা আর শ্যাওলা। কত খাবো? বেকুবের মতো সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে যায় নিজের অজান্তেই।... যখন সে ছোট ছিল, তখন চারদিকে কত অভাব। মা দিনরাত শুধু দুশ্চিন্তায় ভুগতেন। খাবার নিয়েই খালি চিন্তা। আজ না হয় ছানাপোনাদের কিছু খাবার দেয়া গেল, কাল? কাল কোথায় খাবার মিলবে?
সাগরের তলদেশ থেকে তখন যেন সবকিছু উধাও। শ্যাওলা নেই। কেঁচো মেলে না। চিংড়ি পোনা পাওয়া যায় হঠাৎ। একটা জেলিফিশও মরে না যে ওর হাড়-মাংস পেটে দেয়া যায়, যদিও খাবার হিসেবে মড়া হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। কিন্তু খিদে বলে কথা! চারদিকে তখন শুধু খিদে আর খিদে। আর খিদের গপ্প।
সে সবের একটুও নিশানা নেই এখন। কী আয়েশেই না খাচ্ছে ওরা। কত বড় কপাল নিয়ে জন্মেছে যে পৃথিবীতে আসার পর এক বেলাও না খেয়ে থাকেনি। নিত্য-নতুন খাবারের খোঁজ পেয়ে যাচ্ছে। গত পরশু যেমন ইয়া মোটা মোটা সোনালি কেঁচোর ভোঁজ নিয়ে এসেছিল কয়েক জন। কাল গিয়েছিল চিংড়ি-ঝাঁকের কাছে, গেল্ডা এত খেল যে, সকালে ঠিক মতো ঘুম থেকে উঠতে পারে নি। ঠোঁটের সে কী হলো মা? তুমি যে কিছুই খাচ্ছ না?
ঘোর কেটে গোল্ডা বলে, না না, তোমরা খাও। আমার অত তাড়া নেই। তাড়াহুড়োর কী আছে? খাবার তো অনেক, কী বলিস?
ছেলেপুলেরা মাথা নাড়ে, না মা, সবাই মিলে খেতে শুরু করলে ফুরোতে সময় লাগবে না। আমাদের পেছনে পেছনে আরও কয়েক ঝাঁক এসেছে, দেখেছে?
গোল্ডা আঁতকে উঠে শ্যাওলার ঝোপে মুখ দেয়। কয়েক লোকমা খাওয়ার পর তার ঠোঁট ফসকে বেরিয়ে যায়, ইস, কী ডেলিশাস! মনে মনে বলে, এত স্বাদের খাবারটা এতদিন কোথায় ছিল। এক লোকমা শেষ হবার পর পরই মুখে আবার লালা জমতে থাকে। এত ভালো খাবার সে জীবনে খায় নি।
খাচ্ছে আর শরীর গরম হচ্ছে, শরীরে বল বাড়ছে। গোল্ডার মন বলে, নিয়মিত এই খাবার খেতে পারলে ছানাপোনারা শিগগিরই ডাঙর হয়ে উঠবে। সোনালি পাখনা গজাবে, পুচ্ছগুলো গিয়ে উঠবে রক্ত লাল। আর সেই পুচ্ছে দিনের সোনালি আলো পড়ে ঝকমক করবে চারদিক।
অন্য কোথাও থেকে মাছ যদি চলে আসে এদেশে ছানাপোনাদের দেখে চিৎকার করে উঠবে। বলবে, আরে, দেখো, দেখো, কী সুন্দর গোল্ডার ফিশ। এ বড় সুন্দর স্বপ্ন। চোখ বুজলে সে দৃশ্যটা যেন স্পষ্ট দেখতে পায় গোল্ডা। নাকি কালকের মতো এখনই চোখে ঘুমের টোকা পড়তে শুরু করেছে।
ঠিক বুঝতে পারছিল না গোল্ডা, এসময়, যদি না কানের কাছে ফের চিৎকার উঠত, ইস, মা কী দারুণ জিনিস মিস করছ, তুমি?
লজ্জা পেয়ে গোল্ডা দাঁত বার করে রাখে। বুঝতে পারে না, কী বলবে!
ছানাপোনারা গলা ছেড়ে চেঁচায়, মা, এই যে, পাথরের নিচে নেমে এসো। এ শ্যাওলাটা খাও। এতে আছে প্রোটিন আর গাদা গাদা ভিটামিন। নিয়মিত খেলে তুমি আর সহজে বুড়ো হবে না।
আগের চাইতে ছেলেপুলেদের জানাশোনাও এখন অনেক বেশি। হাজার রকমের খোঁজখবর রাখে ওরা। এই যে ফানজাই, ভেলভেটের মতো মসৃণ ও কোমল, জন্মে এর নামও শোনে নি গোল্ডা।
ওদের সময়ে কেঁচোর খোঁজে ঘোরাই ছিল একমাত্র কাজ। কত রকমের কেঁচো সোনালি, লাল, কালো ও বাদামি, ফসফরাসের ভরপুর। এক টুকরো খেলে তো পেট জ্যাম। মাঝে-মধ্যে শ্যাওলা কিংবা চিংড়ি-পোনা যে পড়ত না এমন নয়। তবে শ্যাওলাগুলো ছিল বিচ্ছিরি। পাথরে জমানো এক ধরনের আস্তরণের মতো, দেয়ালে যেমন জমে। কেউ কেউ বলে মস; তো সেই শ্যাওলা মুখে পাওয়ামাত্র তেতো স্বাদে জিবটা কাবু হয়ে পড়ত।
ফানজাই গুচ্ছে মুখ ডুবিয়ে খেতে খেতে গোল্ডার পুরনো দিনের কথা আবার মনে পড়ছিল। আহারে, এ সময় যদি মা বেচেঁ থাকত! গোল্ডাসহ চৌষট্টিটি মাছ জন্ম দিয়ে চতুর্দশ বারের মতো মা হয়েছিল মা। কিন্তু সেই বার যেন হঠাৎ করেই বুড়িয়ে গেল। সাত দিনের মাথায় কিনা গোল্ডাকেআ চিনতে পারে না। বলে, এ্যাই, কে রে তুই?
মাকে যদি এই ফানজাই নিয়মিত খাওয়াতে পারত, তাহলে নিশ্চয় অমন ভুল করত না। স্মরণশক্তি ঠিকঠাক থাকত, গায়েও বল পেত। ছানাপোনাদের নিয়ে রোজ একপাল্লা সাঁতরে নামতে পারত খুশি মনে। আর দীর্ঘ দিন বাঁচত।
মনে পড়ে, সেই বার পরিচয় পাওয়ার পর গোল্ডাকে কী খাতির করল মা!
বাড়িতে নিয়ে গেল জোর করে। গর্তে জমানো সোনালি কেঁচোর টুকরো বার করে খাওয়াল। জানতে চাইল, কোথায় থাকে এখন। বিয়ে করেছে কি-না। বরের স্বাস্থ্য কেমন। ওর বাড়িতে খাবার-দাবার ভালো কিনা। এক গাদা প্রশ্ন। স্নেহ-উপচে-পড়া কত যে কথা; তোর স্বাস্থ্য দেখেই বুঝতে পেরেছি, তুই খুব ভালো আছিস। রোজ ভালো খাবার-দাবার খাস। পর মুহূর্তেই প্রশ্ন, তোর নাম জানি কী বললি?
হেসে ফেলেছিল গোল্ডা।
এই সব মন খারাপ-করা স্মৃতির মাঝে, ছেলেমানুষের মতো মায়ের ওই প্রশ্ন, এখনো মনটাকে বড় কাবু করে দেয়। সারাটা জনম যে মা ছেলেপুলেদের খাবারের জন্য শুধু ছুটে বেড়াল, সেই মা কিনা নিজের সন্তানকে চেনতে পারে না।
হিসেব কষলে গালে হাত দিয়ে তাজ্জব বনে যায় গোল্ডা, মা আর সমুদ্র যেন কাছাকাছি থাকে সবসময়। সমুদ্র বছরের পর বছর খাবার যোগান দিচ্ছে। আর মা, এই তো শেষ বার তাকে-সহ চৌষট্টি জনকে জন্ম দিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে দিব্যি তাদের বড় করে তুলল। একবার নয়, চৌদ্দ বারে ওই একজন মা’র বদৌলতে আট শত ছিয়ানব্বইটি গোল্ডেন ফিশ এসেছিল পৃথিবীতে। মা যেমন সমুদ্র, সমুদ্র তেমনি আরেক মা। দু’জনই জীবন দিয়ে খাবার যোগায়। সমুদ্র বেঁচে আছে আজও। মা’টা যদি আরও কয়েক বছর বাঁচত।
ভালো খেতে না পেয়ে মা অকালেই চলে গেল। মৃত্যুর ওই সকালটি এখনো স্পষ্ট চোখে ভাসে গোল্ডার। দুর্বল শরীরর বলে পাথরের ওপর উল্টে পযেছিল মা। কয়েকটি ধাড়ি চিংড়ি ছুটে এল শুঁড় উঁচিয়ে। গোল্ডা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিমটির মতো নখর বাড়িয়ে থাবা মারল মাকে। তারপর একটার পর একটা প্রচণ্ড থাবা পড়তে লাগল।
পাথর থেকে গড়াতে গড়াতে মা শুধু বলল, খাবার, একটু খাবার। তারপর শেষ।
দুই
এখন খাবারের কোনো অভাবই নেই। প্রতিদিন ভালো ভালো খাবারের খোঁজ নিয়ে আসছে ছানাপোনারা। এই যে বিশাল ফানজাই বাগান, মনে হয় না তার ছানারা খেয়ে শেষ করতে পারবে।
এখন খাবারের কোনো অভাবই নেই। প্রতিদিন ভালো ভালো খাবারের খোঁজ নিয়ে আসছে ছানাপোনারা। এই যে বিশাল ফানজাই বাগান, মনে হয় না তার ছানারা খেয়ে শেষ করতে পারবে।
শুধু কি ফানজাই? আজ ফানজাই খাও তো, অন্য কোথাও জমে যায় হাজার হাজার কেঁচো। কেঁচোর পেছনে দু’দিন লেগে থাকার পর শ্যাওলার বাগানে গিয়ে দেখো, আর ঢোকাই যাচ্ছে না, এমন ঘন।
তবে এক জিনিস টানা বেশি দিন খাওয়া ঠিক নয়। এতে অপচয়ের আশঙ্কা থেকে যায়। সাত দিনের একটা ম্যানু করে নেয়া ভালো। আজ মন্দ খেলে তো, কাল ভালো খাও। যে জিনিস কম হয়, তা কম খাওয়াই ভালো। গোল্ডা ভাবে, ছানাপোনাদের উদ্দেশে কথাগুলো বলে রাখা দরকার। কথাগুলো ওদের জন্য জরুরি।
মজার মজার খাবার পেয়ে ভবিষ্যতের কথা ভুলে গেলে মহাবিপদ নেমে আসে। অপচয়ে নেমে আসে অভিশাপ। খেতে খেতে সব সময় আগামীর কথা ভাবতে হয়। মিলেমিশে খাওয়া সবচেয়ে উত্তম।
কথাগুলো একর পর এক সাজাল গোল্ডা। তারপর যাচাই করল মনে মনে, কথাগুলো সত্যি কিনা। মন বলল, ঠিক।
তার জীবনের কথাগুলোই তো সাক্ষী।
ওরা যখন ছোট ছিল, তখন বেশির ভাগ গোল্ডেন ফিশই ছুটত কেঁচোর পেছনে। খাবারের পদ বাড়ানোর কোনো খেয়াল ওদের ছিল না। গোল্ডা পর্যন্ত মা হওয়ার আগ অবদি জানত না যে কেঁচো ছাড়া সাগরের নিচে আরো হরেক পদের খাবার আছে! সেও সমানে সবার সঙ্গে কেঁচো গিলেছিল।
দেখতে না দেখতে কেঁচোর আস্তানা শূন্য হয়ে গেল। যারা বেশ মোটাতাজা হয়ে উঠেছিল, খাবারের অভাবে কিছুদিনের মধ্যেই তারা শুকিয়ে জিরজিরে।
গোল্ডার মা ছানাপোনাদের নিয়ে ছুটল উত্তরে, অনেক দূরে। ওখানে নাকি খাবারের আধার। খাবার অবশ্য মিলেছিল, কিন্তু তুলনায় একেবারে কম। পেটই ভরলা না কারও।
এসব অভিজ্ঞতার কথা ছানাপোনাদের বলা দরকার। শোনো সোনামণিরা, আমরা খাবারের জন্য বেঁচে থাকি না, বেঁচে থাকার জন্য খাই। কথাটা মনে রাখা উচিত।
গোল্ডা পানিতে সামান্য বুদবুদ ওঠাল। তার মানে সংকেত, কথা আছে। ছানাপোনারা খাবার না খেয়ে মার দিকে তাকাল। সোনা’মনিরা, শোনো, আমি তোমাদের কিছু কথাবলতে চাই। মন দিয়ে শুনবে এবং মনে রাখবেÑ
ঠিক আছে-
এক সঙ্গে সবাই মাথা কাত করল এবং এক সঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠ সাগরের নিচে প্রধ্বিনি তুলল, ঠিক আছে।
খাবার নিয়ে ভেবে রাখা কথাগুলো একে একে বলতে লাগল গোল্ডা। সবশেষে জুড়ে দিল সেই বাক্যÑ সবাই মিলেমিশে খাবে। আর খাবারের অপচয় কখনো করবে না।
কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ থেমে পড়ল সে। তার চোখ দুটো ততক্ষণে ছানাবড়া। কল্পনাও করে নি, এ রকম একটা দৃশ্য সে দেখবে।
তার মাত্র তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে একটা লিকলিকি মাছ কাঁপছে। মাছ নাকি মাকড়সা? শ্বাস নিতে পারছে না ভালো করে। লিকলিকে শরীর, হাড়-হাড্ডি খালি চোখে দিব্যি দেখা যাচ্ছে।
গোল্ডার বুকটা ধড়াস করে উঠল। তার গলার স্বর শোনাল আর্তনাদের মতোÑ এ কেরে? হেসে ফেলল এক দঙ্গল ছানাপোনা, একসঙেই তাদের উল্টো প্রশ্ন, তুমি ওকে চিনতে পারছ না মা?
গোল্ডা মাথা নাড়ল।
সে কী! ছানাপোনারা অবাক! ও যে আমাদেরই সবচে ছোট বোন, পুঁচকে।
বিস্ময়ে গোল্ডার জিভ বেরিয়ে গেল, বলিস কীরে, ও আমার মেয়ে? তা এমন রোগা-পটকা কেন?
হবে না? একটা ছানা উল্টে প্রশ্ন করল, বেচারি যে খেতেই পারে না তো মোটা হবে কোত্থেকে?
কেন, খেতে পারে না কেন?
তিন-চার দিন আগে পুচঁকেটা ধরা পড়েছিল মানুষের হাতে। ওরা ওকে নিয়ে একটা কাচের বাক্সে নাকি রেখেছিল। সেখানে বিশ্রি সব শব্দ। মাথার ওপর দিনরাত লাইট জ্বলে। বাক্সের ভেতরে আবার একগাদা গাছপালা বুদবুদ তোলার যন্ত্র।... এই সব দেখে বেচারি পুঁচকে নাওয়া-খাওয়াই ছেড়ে দিল। শেষে ওরা মড়া ভেবে ওকে কাল এখানে ফেলে দিয়ে গেল।
ওমা, এত সব কাণ্ড! অথচ আমি কিছুই জানি না। গোল্ডা নিজের ওপর বিরক্ত হলো। যে ছানাটা এতক্ষণ কথা বলছিল, সে এবার পুঁচকেকে তাড়া দিল, এ্যাই পুঁচকে, আমি অনেক বলেছি। এবার তোর কথা তুই বল।
পুঁচকে কথা বলার বেজায় চে®টা করতে লাগল। কিন্তু কোনো শব্দ পর্যন্ত বেরুল না। দু’দিনটি বুদবুদ উঠল মাত্র। খুব কষ্ট হচ্ছিল তার।
গোল্ডা বাধা দিয়ে বলল, থাক্, তোকে আর কষ্ট করতে হবে না। ক’দিন ভালো করে খাওয়া-দাওয়া কর। আর ধুমসে ঘুমা, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কে জানি বলল, ও খেতেই পারে না। ঘুমাবে কী করে?
কেন? খেতে পারে না কেন?
পুঁচকে অনেক কষ্টে ফিসফিসিয়ে বলল, সবার সামনে খেতে আমার লজ্জা করে, মা।
গোল্ডা আকাশ থেকে পড়ল, বলিস কীরে? খেতে লজ্জা করে? তুই কি চুরি-ডাকাতি করে খাস। হাতাশায় একেবারে ভেঙে পড়ল তার গলা, আমার মেয়ে হয়ে তুই এসব কী বলছিস?
ক’জন ছানাপোনা বলল, মা, বাদ দাও তো। ওর সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। পৃথিবীতে গিয়ে ওর বদ অভ্যাস হয়ে গেছে। কারও সামনে খেতে পারে না। চলো মা, আমরা চলে যাই। পুঁচকেটা পেট পুরে খাক।
তিনসবাই চলে যাবার পর নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ। একেবারে সুনসান। শুধু ঢেউয়ের ঝাপটায় ক্রমাগত মাথা নাড়ছে ফানজাই গুচ্ছ।
পুঁচকে মুখ ডোবাল। প্রথমে এক লোকমা খেয়ে পরখ করে নেবে ভেবেছিল, কিন্তু আর চিবুনো বন্ধ করতে পারল না। বড় স্বাদ,বড় ভালো লাগছে খেতে। খাবারে যে এমন মজা, জানাই ছিল না পুঁচকের। খেতে খেতেই ফানজাই বাগানের আরও গভীরে ঢুকে গেল সে।
চোখে পড়ল বিশাল বড় একটি ঝামা-পাথর নাকি কোরাল পাথরের অংশ। না, আরও কয়েক কদম এগুনোর পর আরও কয়েকটি পাথর। একটার পর একটা সাজানো।
উত্তরের একটি পাথরের গায়ে এইটুকুন একটা ছিদ্র। পায়ে পায়ে এগিয়ে উঁকি দিল পুঁচকে। তার চোখ দুটো ইয়া বড় হয়ে গেল। ওমা, অত্ত, খাবার! রসগোল্লার মতো বড় বড় দুটি চোখ পুঁচকে দেখল। আর খাবার । সোনালি কেঁচো, লাল কেঁচো, ফানজাই, ভিতরে সাজানো। কষ্ট করতে হবে না, শুধু হা করে থাকলেই হবে, খাবার এসে ঢুকে যাবে মুখে।
জিভটা রসে টইটম্বু হয়ে গেল। আবার খিদে পেল তার। কতদিন ধরে সে ভালো খাবার খায় না। ছিদ্রের ওপর ফের চোখ রাখল পুঁচকে। এই পথে কি ভেতরে ঢোকা যাবে? চেষ্টা করতে লাগল পুঁচকে। তারপর অনেকক্ষণ চেষ্টার ফল পেল। ভেতরে ঢুকে যেতে পারল পুঁচকে।
প্রথমেই মনে হলো, এই গুহাটা কাউকে দেখানো যাবে না। এখানকার খাবার শুধু তার জন্য। এখানে বসে সে রকমারি কেঁচো খাবে, শ্যাওলা খাবে, ফানজাই খাবে, চিংড়ি পোনা খাবে। খাওয়ার পর হাই তুলবে। ঘুমাবে। ঘুম থেকে উঠে আবার খাবে। খেতে খেতে অল্প সময়ের মধ্যে সে রীতিমতো পালোয়ান হয়ে উঠবে।
গুহাটা এক্কেবারে অন্ধকার। প্রথমে কিছুই দেখার উপায় নেই। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে আসে সব। খাবারগুলো একেবারে আলাদা করে চেনা যায়। জায়গা-জমির নিশানাও মিলছে ঠিকঠাক। এক কোণে স্বচ্ছ পানি আয়নার মতো থির হয়ে আছে। এটা হবে তার ড্রেসিং রুম। পুঁচকে ভাবল, মাঝে-মধ্যে এখানে এসে চেহারা দেখে নেয়া যাবে। তারপর সে খেতে শুরু করল। পুঁচকে একটু খায়, একটু ঝিমায়। এই করে করে অনেকক্ষণ কেটে গেল।
গুহার ভেতরে নেমে এল আরও অন্ধকার। সূর্য বোধহয় ডুবে গেছে। এখন কিসসু দেখার উপায় নেই।
বেরুনোর কোনো চেষ্টা না করে পুঁচকে ঘুমানোর আয়োজন করতে লাগল।
এই বরং ভালো। বেরুনোর আর দরকার কী? এখানে থাকবে, খাবে আর ঘুমাবে। ক’দিন পর সবাই তার কথা দিব্যি ভুলে যাবে। আর কেউ খুঁজতে আসবে না, তখনই হবে মহামজা। এ জায়গাটা হবে তার, একান্তই তার। এই বিশাল গুহার একচ্ছত্র রাজা হবে সে। এত খাবার এখানে থাকতে বাইরে গিয়ে সবার সঙ্গে কষ্ট করার কোনো মানে নেই।
মনের সঙ্গে বোঝাপড়ার পর পুঁচকে চোখ বুজল। ঘুম, ঘোর ও খাওয়া-দাওয়ায় কেটে গেল চার দিন।
পঞ্চম দিনের ভোরে গুহার বাইরে সে বুকফাটা আর্তনাদ শুনতে পেল, পুঁচকেরে, ও সোনামেয়ে, কই গেলি তুই?
ছুটে প্রায় গুহার মুখে চলে এল পুঁচকে, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল। উত্তর দিলেই জানাজানি, জানাজানি হলে বিপদ। নিমিষে সব খাবার শেষ হয়ে যাবে। তার ভাইবোনের সংখ্যা কি আর কম? একবার এই গুহায় ঢুকতে পারলে সব উজাড় হতে এক ঘণ্টাও লাগবে না।
সেই সকালে খুব একচোট কাঁদল পুঁচকে। নিজেকে গালাগালি দিল প্রচণ্ড। তুই বড় পাষাণীরে। তারপর নিজেই প্রশ্ন তুলল, কে পাষাণী, আমি, নাকি এই খাবার।
কান্না সামলে সে চোখে পানির ঝাপটা দিল। তারপর তিন-চারটা চিংড়ি-পোনা খেয়ে ফেলল ঝটপট। পোনাগুলো যেন ঘুমের ক্যাপসুল। এমন স্বাদু যে, পেটে পড়া মাত্র পাতা দুটো বুজে এল আয়েশে।।
ঘুম ভাঙল সেই বিকেলে। ঘুম থেকে উঠে আবার খেলো। সবুজ শ্যাওলা আর কয়েক টুকরো ফানজাই। পরিমাণটা বোধহয় বেশি হয়ে গেছে। শরীরটা ভারি হয়ে এল। ঘুমিয়ে হিস-হিস শব্দ শুনতে পেল।
উঁকি দেয়ার পর পুঁচকের শরীর এবোরে হিম। লম্বা বেশ কয়েকটি ডোরাকাটা সাপ। এগুলো আবার মাছ খাওয়ার ওস্তাদ। কে জানে, খোঁজখবর নিয়েই এ দিকটায় এসেছে কিনা। ফানজাই বাগানের গভীরে ঢুকে গেল পুঁচকে। তারপরও দুরুদুরু ভাবটা গেল না মন থেকে। যদি এখানে ঢুকে পড়ে?
না, পানির শব্দেই টের পেল, ডোরাকাটাগুলো চলে যাচ্ছে। হাঁফ ছাড়ল সে।
কিন্তু রাতে এক ফোঁটা ঘুম হলো না। ভোর হলো। ঢেউ ঢুকছে গুহায়, ঢেউয়ের সঙ্গে আসছে রকমারি খাবার। সাদা চিংড়ির পোনা, সোনালি কেঁচো আর কেঁচোর ডিম- এত খাবার কোনোদিনও ফুরোবে না। এ ভোরটা অন্যরকম মনে হলো তার কাছে।
পুঁচকে কানের পাশ থেকে সেই ভয়ঙ্কর হিসহিস শব্দগুলো তাড়াতে পারছে না। ওই শব্দ তাকে বারবার মা ও ভাইবোনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। পুরনো দিনগুলো ভেসে উঠছে চোখের সামনে। কতদিন হলো সে ভাইবোন ছাড়া? কতদিন হলো সে এখানে একা বাস করছে?
পুঁচকে দৌড়ে গেল সেই স্বচ্ছ পানির আয়নার কাছে। মনে মনে বলল, দেখ তো দিদি, আমি কি খুব বড় হয়ে গেছি?
আয়না কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু পানির আয়নায় নিজের মস্ত বড় শরীর দেখে সে নিজেই আঁতকে উঠল। এ তো দেখছি রীতিমতো একটা হাঙর-ছানা। কোথায় সেই এইটুকুন পুঁচকের শরীর? নিজেকে চেনার কোনো উপায় নেই। আবার চোখ খুলল সে, ভয়ে ফের বন্ধ করে ফেলল, আবার তাকাল। বুকের মধ্যে ধুকধুক শব্দটা বাজতে লাগল সারাক্ষণ।
বুঝে গেল পুঁচকে। যা বোঝার, তা এতক্ষণে জলের মতো পরিষ্কার। তার দিন ফুরিয়ে এসেছে। কেন সে এভাবে বসে বসে হাঙরের মতো গোগ্রাসে গিলেছে? এ হচ্ছে তারই ফল। এক সময় ভেবেছিল, খাবার ফুরোলে সে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে। আজ বুঝতে পারছে, এখানকার খাবার কখনো বেরুতে পারবে না।
না,না, না। চিৎকার করে উঠল পুঁচকে। তারপর পিছু হটল। প্রাণপণ শক্তিতে চেষ্টা করল বাইরে বেরুতে। পারল না। গুহামুখে ছিদ্র তো আগের মতো, মাঝখান থেকে কয়েক গুণ বড় হয়ে গেছে সে।
রাগে, দুখে, যন্ত্রণায় সে আবার খেতে শুরু করল। একবার ফানজাই খায়, একবার শ্যাওলা, আরেক বার চিংড়ি পোনা। খেয়ে সব ধ্বংস করে দেব, শেষ করে দেব।
আশ্চর্য, সে খাবার কমতির কোনো লক্ষণ নেই। বরং গুহামুখ দিয়ে সমানে ঢুকছে শুধু খাবার আর খাবার। সোনালি কেঁচো, চিংড়ি পোনা, হরেক রকমের শ্যাওলা।
হঠাৎ খুব কান্না পেল তার। সে ছুটে গেল গুহামুখে, চিৎকার করে ডাকল সবাইকে, খাবার, মজার খাবার, কে কে খাবে এসো। তার চিৎকারে অসংখ্য মাছ ছুটে এল, কিন্তু কেউ গুহায় ঢোকার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না। একজন তো বাঁকা হেসে বলল, সামান্য খাবারের জন্যে পুরো জীবনটা খোয়াব নাকি? পুঁচকে বলল: না না সামান্য কোথায়? এখানে সব পুষ্টিকর খাদ্য। একবার এসেই দেখো না। একটা গোল্ডেন ফিশ বলল: তোমার গলার স্বর খুব চেনা মনে হচ্ছে। অনেক দিন আগে আমার বোন হারিয়ে গেছিল, ওর কথাবার্তা তোমার মতোই ছিল।
...... এই গুহায় ঢুকে কি প্রাণ হারাব?
পুঁচকে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলল।
মাছগুলো এক এক চলে গেল, সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল নীরবতা, আর সেই অজানা ভয়। পেছনে হটে গুহার বাইরে আবার বেরুনোর চেষ্টা করতে লাগল পুঁচকে।
একবার, দু’বার, তিনবার। বারবার।
ভীষণ হাঁপাচ্ছে সে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। বুকের খাঁচাটা বুঝি এখনই ভেঙে যাবে। চোখ দুটো জলে ভরে গেছে। এক জীবনের সব কান্না বুঝি আজই ঝরে পড়বে। ঝরতে শুরু করল। গুহামুখে ঠিক এসময় হিসহিস শব্দ। এবার একটি দুটি নয়, অসংখ্য ডোরাকাটা শব্দ হচ্ছে একসঙ্গে, হিসহিস।
আবার প্রাণপণ শক্তিতে নিজেকে বাইরে ঠেলে দিতে চাইল পুঁচকে। পারল না। সে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল, মা, মাগো...।
আজও সাগরের তলদেশে সে চিৎকার ভেসে বেড়ায়।(পরবির্তন)
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়