Tuesday, May 28

শ্রেণী কক্ষ-আসবাবপত্র কিছুই নেই, তবুও…


দেশ ও জাতিকে নিরক্ষর মুক্ত করতে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতা মূলক করেছেন। এজন্য সরকারি ভাবে শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থাও চালু রয়েছে। কিন্তু এরপরও প্রতিবছর অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে।
শুধু ঝরে পড়াই নয়, দারিদ্র্যতার কষাঘাতে অনেক শিশুই স্কুলের গন্ডিতে পা’ও দিতে পারে না। এ চিত্র সারাদেশে কম-বেশী বিদ্যমান। তাই সারাদেশের না পারলেও নিজেদের এলাকার ঝড়ে পড়া ও স্কুলের গন্ডিতে পা দিতে না পারা শিশুদের পড়াশুনা করাচ্ছেন দরিদ্র পরিবারের তিন নারী। শুধু পড়া শুনাই নয়, অসহায় শিশুদের স্কুলে ভর্তির সহযোগিতাও করছে তারা। কোন কিছু পাওয়ার আশায় নয়, শুধুমাত্র বিবেকের দংশনে তাদের এই বিদ্যাপীঠ গড়ে তোলা।
সকলের প্রিয় রেশমা আপা :
গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটার সময় দুর থেকে চোখে পড়ল ছোট্ট শিশুরা সুপারি বাগানে জড়োসড়ো হয়ে কি 
যেন করছে। একটু কাছে গিয়ে দেখা গেল তারা মাটিতে বস্তা বিছিয়ে অ, আ, ক, খ পড়ছে আর লিখছে। তাদের আওয়াজে মুখরিত পল্লীর পরিবেশ। ভিজে মাটির ঠান্ডায় গুটিসুটি হয়ে বসা কোমলমতিরা একটু উষ্ণতার জন্য যেন উদগ্রীব হয়ে পড়েছে।

তবুও থেমে নেই তাদের পড়ালেখা। আরো কাছে গিয়ে দেখা গেল প্রায় অর্ধশত শিশু শিক্ষার্থীকে মলিন কাপড় পরা সাদা মনের এক গৃহবধূ কোলে বাচ্চাকে নিয়ে পাঠদান করাচ্ছেন। বাগানে পা দিতেই শিশুরা বড় আদবের সাথে দাঁড়িয়ে সালাম জানাল। তাদের সাথে কুশল বিনিময়ের পর এলাকাবাসির সাথে কথা বলে জানা গেল এ পাঠশালার ১০টি বছরের নানা কাহিনী।
২০০২ সালে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা গ্রামের জয়নাল শেখের অষ্টম শ্রেনীতে পড়ুয়া কণ্যা রেমশা আক্তারের বিয়ে হয় বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার শৈলদাহ গ্রামের আবুল হোসেন শেখের ছেলে কৃষক নুরনবীর সাথে।

পরিবারের চাপে বাল্য বয়সে বিয়ে ও লেখাপড়া বন্ধ হওয়ায় তিনি প্রচন্ড মানসিক কষ্ট পান। তবুও বাধ্য হয়ে সব কিছু মেনে নিয়ে শুরু করেন স্বামী-সংসার। কিন্তু মন থেকে শিক্ষা না গ্রহণ করার কষ্টকে ভুলতে পারেনি কখনও। তাই আশেপাশের গ্রামের দারিদ্র পরিবারের শিক্ষা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করেন। সেই থেকে মাত্র ৭ জন শিশু শিক্ষার্থীকে নিয়ে তার পাঠশালার পথ চলা শুরু।
শুরু থেকে স্থানীয় বেল্লাল সরদারের সুপারি বাগানে পাঠশালার পাঠদান চালু হয়। সেই থেকে আজও ওই সুপারি বাগানে চলছে তার পাঠশালার কার্যক্রম। প্রতি বছর এখান থেকে ছোট্ট শিশুদের রাম সুন্দর বসাকের আদি বাল্য শিক্ষা, সতীনাথ বসাকের আদর্শ লিপি, ধারাপাত ও অংক শিক্ষা এবং মাই ফাস্ট বুক অফ স্পেলিং ভালোভাবে শিখিয়ে পাশের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি করা হয়।
শিক্ষিকা রেশমা এ পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক শিশু শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দিয়ে বিভিন্ন স্কুলে নিজেই ভর্তি করেছেন। বর্তমানের তার স্কুলে প্রায় অর্ধশতাধিক কোমলমতি শিক্ষার্থী রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে তাদের আশ্রয় হয় গোয়াল ঘরে। তবুও থেমে নেই রেশমার স্বপ্নের পাঠশালা।
শিক্ষিকা রেশমা জানান, ‘কোন কিছু পাওয়ার আশায় নয়, শুধুমাত্র বিবেকের দংশনে এই বিদ্যাপীঠ গড়ে তোলা। ওরা একদিন বড় হবে। আমার নিজের সন্তানের চেয়ে ওদের বেশি ভালবাসি। আমার সকল স্বপ্ন ওদের ঘিরে। যত কষ্ট হোক, আর বাধা আসুক আমি ওদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলব।’

শিশুদের নিয়ে আগামী দিনের পরিকল্পনার কথা জানালেন রেশমা। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি স্থায়ী ঠিকানা খুঁজছেন তিনি। নিজস্ব কোন ঘর না থাকায় খোলা আকাশের নিচে বসে তাদের পাঠদান করানো হয়। মেঘ-বৃষ্টি এলেই ছুটি দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। আধুনিক শিক্ষা ব্যাবস্থার যুগে ও প্রত্যন্ত গ্রামের এ ছোট্ট শিশুদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রেশমা প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও আগ্রহের কথা জানালেন এভাবে।
অভিভাবক আনোয়ারা বেগম জানান, তিনি শুনেছেন এই পাঠশালায় মায়ের মমতা দিয়ে শিশুদের শিক্ষা দান করা হয়। তাই তিনি তার শিশু পুত্রকে এই পাঠশালায় পড়াচ্ছেন। অন্য এক অভিভাবক মো. রুবেল সেখ জানান, এই এলাকার দরিদ্র পরিবারের শিক্ষা বঞ্চিত শিশুরা এই পাঠশলায় পড়ে উপকৃত হচ্ছে। না হলে এদের লেখাপড়া হতো কিনা এটা বলা মুশকিল।
তবে ওই ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য সদস্য শেখ কামাল আহম্মেদ জানান, ছোট্ট শিশুদের কথা ভেবে রেশমা একটি পাঠশালা ঘরের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু আজও সে পাঠশালার ঘর তুলতে পারে নাই। অথচ সরকারের টিআরের কোটি কোটি টাকা’র চাল বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ হলেও এখানে কোন বরাদ্দ হয় না। আর এনজিও গুলোও সমাজ সেবার বিভিন্ন প্রতিশ্র“তি দিয়ে মাইক্রোক্রেডিটের ব্যবসা করলেও এগুলো তাদের চোখে পড়ে না।

দিদিমনি বনানী পোদ্দার :
ছোট্ট শিশুদের আওয়াজে মুখরিত পল্লীর পরিবেশ। দেখা গেল একটি বাড়ির স্যাঁতস্যাঁতে বারান্দায় পাটি বিয়েছে এক গৃহবধূ কোমলমতিদের পাঠদান করাচ্ছেন। তাদের সাথে কুশল বিনিময়ের পর জানা গেল ভ্রাম্যমান এ পাঠশালার নানা কাহিনী।
বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের গৃহবধূ ও পাঠশালার শিক্ষিকা বনানী পোদ্দার জানান, পত্যন্তপল্লীর অসহায় গরীব পরিবারে শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে তিনি ২০১০ সালে এই পাঠশালা শুরু করেন। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ এলাকায় একটা সুনাম অর্জন করতে পেরেছেন। সুনাম অর্জন করলেও আজও সৃষ্টি করতে পারেনি নিজস্ব একটা ঠিকানা।

তাই স্কুলের পাঠদানের কাজ চালান কখনও রাস্তার পাশে। কখনও গাছের নিচে। আবার কখনও একটু ঝড়-বৃষ্টি হলে মানুষের ঘরের বারান্দায়। এজন্য এলাকাবাসি এর নাম দিয়েছেন ভ্রাম্যমান পাঠশালা। এভাবে দু’বছর ধরে চলছে বনানীর পাঠশালা বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ জনের মত। তার ইচ্ছা এই প্রতিষ্ঠানকে একটি স্থানে দাঁড় করিয়ে প্রতিষ্ঠা করা।
ঝরে পড়া শিশুদের সাবেরা আপা : 
গৃহবধু সাবেরা বেগম (৪০) স্বামী দিন মজুর। বসত বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কুনিয়া গ্রামে। 
ছেলে-মেয়ে নিয়ে ৫ সদস্যর পরিবার তার। নিজে বেশী দূর লেখাপড়া করতে পারেনি। তাই সমাজের অসহায় দরিদ্র পরিবারে শিক্ষা বঞ্চিত ছেলে-মেয়েদের দেখে মনে মনে মর্মাহত হন।

তাই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন এলাকার ঝড়ে পড়া ও স্কুলের গন্ডিতে পা দিতে না পারা শিশুদের লেখাপড়া শিখিয়ে স্কুলে ভর্তি করার। সেই থেকে শুরু। আজ প্রায় শতাধিক শিশু শিক্ষার্থী তার পাঠশালায়। প্রতিদিন সকালে বাড়ির আঙিনায় ছালা (চটের বস্তা) ও পাটি বিছিয়ে শুরু হয় ক্লাস। চলে বেলা ১১ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত। প্রথম দিকে দরিদ্র পরিবারে শিশুরা পাঠশালায় না আসতে চাইলেও এখন তারা উৎফুল্ল ভাবে ক্লাস করতে আসে।
সাবেরা বেগম জানান, তিনি অসহায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে ভর্তি ও ঝড়ে পড়া রোধে ফ্রি ক্লাস পরিচালনা করে আসছেন। শিক্ষার আলো ছড়াবার লক্ষ্যে পাঠশালার কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। শিক্ষিকা সাবেরা বেগম আরও জানান, তার নিজের কাজের পাশাপাশি গরীব, দুস্থ শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার গুণগত মানউন্নয়নে কাজ করছেন। এছাড়াও তিনি অসহায় দারিদ্য্রদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।

এস এস সাগর, চিতলমারী,বাংলাপোষ্ট২৪



শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়