Sunday, May 19

ফের চাঙ্গা কঙ্কাল বাণিজ্য

উৎপল রায়: কঙ্কাল নিয়ে চলছে ভয়াবহ বাণিজ্য। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও একটি চক্র। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে কঙ্কাল পাচার হচ্ছে বিদেশে। রাস্তাঘাটে ফুটপাথের হাতুড়ে ডাক্তার এমনকি কবিরাজের কাছেও পাওয়া যাচ্ছে মৃত মানুষের হাড়। একেকটি কঙ্কাল বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ৫০ হাজার টাকায়। এ জন্য চক্রটি টার্গেট করে কবরস্থানকে। এছাড়া বজ্রপাতে নিহতদের হাড় চুম্বক হয়ে যায় এ গুজবেও কঙ্কাল চুরির হার দিন দিন বাড়ছে।
সমপ্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় কবর খুঁড়ে বেশ ক’টি লাশ ও কঙ্কাল চুরির ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়। গত ৪ঠা এপ্রিল শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার গেরামারা গ্রামের কবরস্থান থেকে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের ৪টি লাশ ও কঙ্কাল চুরি করেছে চোরচক্র। ১০ই এপ্রিল ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার মেগচামী গ্রামের খান বাড়ি গোরস্থান থেকে দু’বছর আগে দাফন করা দু’টি লাশের কঙ্কাল চুরি হয়। একই সময়ে উপজেলার বৈকণ্ঠপুরস্থ কবরস্থান থেকে চুরি হয় আরও দু’টি কঙ্কাল। ১৫ই এপ্রিল গভীর রাতে মধুখালী উপজেলার বেলেশ্বর কেন্দ্রীয় কবরস্থানের ৪টি কবর খুঁড়ে দু’টি কঙ্কাল নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ চোররা। এলাকাবাসী ঘটনা টের পাওয়ায় দু’টি কঙ্কাল ফেলে পালিয়ে যায় তারা। পরে কঙ্কাল দু’টি এলাকাবাসীর সহায়তায় পুনরায় দাফন করেন স্বজনরা। এছাড়া ২৮শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লার দেওভোগ নাগবাড়ী এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি কঙ্কাল উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ। ভয়ে আতঙ্কে দেশের বিভিন্ন কবরস্থানে স্থানীয় লোকজন রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, কঙ্কাল বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত দেশের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের অসাধু চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পঞ্চম বর্ষের এক শিক্ষার্থী ও হাসপাতালের চতুর্থ তলার সার্জারি বিভাগের এক ইন্টার্নি চিকিৎসক অবৈধ কঙ্কাল বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হাসপাতালের এনাটমি ও সার্জারি বিভাগের কিছু অসাধু চিকিৎসকের ছত্রচ্ছায়ায় দীর্ঘদিন অবৈধ কঙ্কাল বাণিজ্য চালিয়ে এলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলছে তাদের এ কার্যক্রম। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পেশাদার ও সংঘবদ্ধ চোরদের মাধ্যমে কঙ্কাল সংগ্রহ করে তারা এসব কঙ্কাল অবৈধভাবে বিক্রি করে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের কাছে। সমপ্রতি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, অর্ডার দিলে একদিনের মধ্যে কঙ্কাল সরবরাহ করবেন তারা। এজন্য কোন আইনি বাধ্যবাধকতার প্রয়োজন নেই। প্রতিটি কঙ্কালের দাম পড়বে ২৫ হাজার টাকা। তবে বাক্সের ভিতরে কঙ্কালের হাড়গোড় থাকবে অবিন্যস্ত অবস্থায়। কঙ্কাল ক্রেতাকে নিজ খরচে তা জোড়া লাগাতে হবে। এজন্য খরচ পড়বে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। তারা জানান, কঙ্কাল ক্রেতা বেশির ভাগই বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও চিকিৎসক। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কবর খুঁড়ে লাশ ও কঙ্কাল চুরি আইন ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একটি চরম অপরাধ ও অনৈতিক কাজ। কিন্তু দেশের বিদ্যমান আইনে এ বিষয়ে বিচার ও শাস্তির স্পষ্ট কোন নির্দেশনা নেই। তাই কিছু ক্ষেত্রে অপরাধী ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোকরে তারা পার পেয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ডিএমসি) হাসপাতলের এনাটমি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপিকা শামীম আরা বলেন, মেডিকেল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণায় মৃত মানুষের লাশ ও কঙ্কাল বাধ্যতামূলক। তাই সবার আগে প্রয়োজন লাশ সংগ্রহ। এজন্য মরণোত্তর দেহদানকারী ব্যক্তি ও বেওয়ারিশ লাশ আইনি বাধ্যবাধকতায় আমরা সংগ্রহ করি। তিনি জানান, সংগৃহীত লাশ ও কঙ্কাল গবেষণার প্রয়োজনে বিভিন্ন কেমিক্যালের মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে হয়। দেশের সব ক’টি সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে এটি করা হয়। এক্ষেত্রে কবর খুঁড়ে কেন লাশ ও কঙ্কাল তুলে আনতে হবে তা বোধগম্য নয়। এটি একটি অনৈতিক কাজ। যারা এসব করে বুঝতে হবে তাদের অসৎ কোন উদ্দেশ্য আছে। তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। বজ্রপাতে নিহত মানুষের দেহ চুম্বক হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে অধ্যাপিকা শামীম আরা জানান, বিষয়টির কোন রকম সত্যতা নেই, এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। এটি একটি গুজব মাত্র। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৭৫টি। এর বেশির ভাগ রাজধানী ঢাকায়। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও এনাটমি বিভাগ থেকে সুনির্দিষ্ট নিয়মে ও আইনি প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত লাশ ও কঙ্কাল সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ  এনাটমি বিভাগের শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও গবেষণার জন্য কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধ উপায়ে কঙ্কাল সংগ্রহ করে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানে মৃত লাশ ও কঙ্কাল সংগ্রহ করার নিয়ম নেই। কেউ যদি নিয়ম ভঙ্গ করে তা অবশ্যই অপরাধ। এ বিষয়ে ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি বিভাগে  যোগাযোগ করা হলে, ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবদুর রশিদ কোন কথা বলতে রাজি হননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক জানান, কবর খুঁড়ে লাশ ও কঙ্কাল চুরি খবর আমরাও শুনেছি। আর বজ্রপাতে নিহত মানুষের শরীর চুম্বক হয়, এটি স্রেফ গুজব। যারা এসব প্রচার করে ও কঙ্কাল বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত অসৎ উদ্দেশ্যেই তারা এসব করছে। আমাদের বুঝতে হবে, বর্তমানে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ মেডিকেল শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা গবেষণার প্রয়োজনে ‘মরণোত্তর দেহদান’ করছেন। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে।-মানবজমিন

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়