Friday, April 26

কেবলই ক্রমাগত শোক পালন!

এম এম খালেকুজ্জামান
বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই  রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ আসনে আসীন পদাধিকারীরা শোকবানী দেন।  জাতীয় শোকদিবস ঘোষণা করা হয়। একটা দুটো তদন্ত কমিটি করা হয়। এই আটপৌরে প্রোটোকলের বাইরে তারা এখনো বের হয়ে আসতে পারেননি।

রানা প্লাজা ধসের মতো ভয়াবহ ঘটনার দুর্ঘটনাস্থলে দেখা যাচ্ছে  মন্ত্রীদের। টিভি ক্যামেরা উদ্ধারকাজের  চিত্রধারণ বন্ধ রেখে ক্যামেরা ফোকাস করছে উপস্থিত মন্ত্রীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রচারে। আর আমরাও দু তিন কিংবা ছয় মাস পর কখনো তাজরীন ফ্যাশনস ট্রাজেডি, কখনো রানা প্লাজা ধসে পড়ার বিয়োগান্তক ঘটনার বিপরীতে সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় লেখার বেদনা বিধুর অবকাশ পাই। যে যে সংবাদভিত্তিক চ্যানেলগুলো ঘটনার অব্যাবহিত পর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ নিয়ে জমানো টক শো উপহার দিতে পারবে তাদের টিআরপি বাড়বে। আর আমরা অপেক্ষায় থাকবো আরো বড় কোনো মানবিক বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কায়।

এপ্রিল-মে মাসের বিকেল-সন্ধ্যায় ক্রিকেট পাগল বাঙালি  টিভি সেট এ চোখ রাখেন  আইপিএল’র ম্যাচে কত রান কয় উইকেট পড়লো তা দেখার জন্য । তবে এপ্রিলের ২৪ তারিখ বিকেল সন্ধ্যায় সবাই বেদনাহত আগ্রহ নিয়ে টিভিতে চোখ রাখছিল দালানে চাপা নিহত  শ্রমিকের  সংখ্যা কত তা জানতে। যে অল্প কয়েকটি কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে শিরোনাম হয় তার মধ্যে গার্মেন্টস অন্যতম। আমরা আবারো শিরোনাম হলাম- তবে তা  পোশাক শিল্পে অবহেলাজনিত গণহত্যার কারণে।

বাংলাদেশের শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের জীবন কখনোই নিরাপদ নয়। তারা পথে-ঘাটে বেঘোরে মারা যাবেন-এটাই যেন নিয়তি। তারা মারা যান ত্রুটিপূর্ণ দালানের  ছাদের নিচে চাপা পড়ে। তারা মারা যান লঞ্চে ট্রাকে, বাসে,  কিংবা অন্য কোনো বাহনে। যেকোনো প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের প্রথম ও প্রধান শিকার এই দরিদ্র মানুষেরা।  শত শত শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের জীবন যেন সংখ্যামাত্র। মহাভারতের পাণ্ডব নিধনের জন্য যেমন ছিল জতুগৃহ, আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্র কখনো কখনো তাই হয়ে উঠে।

১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর  সারাকা গার্মেন্টসে আগুনে মারা গিয়েছিলেন ৩০ জন পোশাকশ্রমিক। এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে  হয় আগুন লেগে না হয় ভবন ধসে  মরছে শ্রমিক। ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে গরীব অ্যান্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে আগুনে মারা যায় ২১ শ্রমিক এবং ২৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় হা-মীম গ্রুপের একটি কারখানায় আগুনে মারা যায় ৩০ শ্রমিক। চিত্রনাট্য মেনে  সব কটি ঘটনার ক্ষেত্রেই নাশকতার অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু কখনোই ওই সব নাশকতা বা ষড়যন্ত্র কারা করেছে, তার কোনো প্রমাণ সরকার  দিতে পারেনি।

মাস ছয় আগে তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনায় তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর পরামর্শে দেলোয়ার হোসেন আড়ালে থাকছেন, ষড়যন্ত্র ও নাশকতার অভিযোগ তুলে দায়দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে বরাবরের মতো। বিজিএমইএকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছে সরকার।

একদিকে একটি  তদন্ত কমিটি গঠন, সাথে আরেক দিকে নাশকতা ও ষড়যন্ত্রতত্ত্ব  প্রচার - এই দুটি কাজ দিয়ে বাংলাদেশে যেকোনো বড় ঘটনা ধামাচাপা দেয়া যায়।  অতীতের নজিরের সাথে তাল রেখে এবারও তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রাথমিক দায়িত্ব সম্পাদন সমাপ্ত। আর সাথে ষড়যন্ত্র তত্ত্বও ছড়াতে বাকি নেই।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর বিবিসিকে বলেছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ইমারত নির্মাণের নিয়ম-কানুন যথাযথ অনুসরণ করা হয়নি বলেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে একইসাথে মন্ত্রী বলেন, কিছু হরতাল সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নড়াচড়া করেছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে সেটাও একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। মন্ত্রী জানান, তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারপরই দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ কিছুদিন আগেই তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায়  আন্তর্জাতিক প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে । ওই ঘটনায়  বিশ্বের খ্যাতনামা ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাশালী ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রম অধিকার সংগঠন ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইন  বিশ্বখ্যাত সব ব্র্যান্ড, যারা তাজরীনকে কাজ দিয়েছে, তাদের অভিযুক্ত করেছে। তারা  এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডগুলোর কাছ থেকে  কড়া পদক্ষেপের দাবি তুলেছে।

আমেরিকার প্রভাবশালী এবিসি নিউজকে সেখানকার শ্রমিক অধিকার-সংক্রান্ত একটি গ্রুপ ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়ামের নির্বাহী পরিচালক স্কট নোভা বলেন, ইউএস’র পোশাক ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের জীবন চরম বিপদাপন্ন উল্লেখ করে বারবার সতর্ক করেছে। কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। নোভা বলেন, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে  ইতিহাসের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক  শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে এবং এটি যেকোনো দেশের তুলনায় অন্যতম নিকৃষ্ট ঘটনা।

ওয়ালমার্ট এবিসি নিউজকে বলেছে, গত বছর এই তাজরীন ফ্যাশনসকে তারা কারখানার ভয়াবহ পরিস্থিতি বিষয়ে সতর্ক করেছিল। দেশের কর্মক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিবর্ণ দিক আমাদের পোশাকশিল্পের জন্য ভয়াবহ মন্দা নিয়ে আসতে  পারে। শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নেই। এ সমস্ত ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার আশু এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ওপরই ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে পোশাকশিল্পের।

‘ভিক্ষা করবো তবু আর গার্মেন্টসে কাজ করবো না’,  তাজরীন ফ্যাশনস’র অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনার পর অনেক নারী শ্রমিককে এই ক্ষেদোক্তি করতে শোনা গেছে  ঠিকই; কিন্তু জিনিসপাতির ক্রমাগত ঊর্ধ্বদামের রুদ্ধশ্বাস আবহাওয়ায় নিরুপায় এইসব খেটে খাওয়া মানুষেরা দারিদ্র্যের কোপানল থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কোনো পথ না পেয়ে তারা আবারো কাজ নেবে তাজরীন কিংবা অন্য কোনো গার্মেন্টসে । তারপর একদিন প্রাণহীন মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়ে আমাদের শোকাভিভূত করে নাম লেখাবে- কখনো পরিচয়ে, কখনো অজ্ঞাত লাশের মিছিলে।

এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
khaliik@yahoo.com(নতুন বার্তা)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়