Monday, April 29

রানা-প্লাজায় ধস এবং কিছু কথা

ড. ইকবাল হোসেন
আজকের লেখাটি আমি লিখছি একটি বিশেষ দায়ভার  থেকে। দায়ভারের  প্রেক্ষাপট-টি প্রথমেই  একটু বলে নেয়া যাক। আমার  পিএইচডি থিসিস জমা দিয়েই চলে আসি বাংলাদেশে। অতঃপর প্রায় আট মাস  নির্বাহী পরিচালক হিসেবে যুক্ত ছিলাম  পারিবারিক এক তৈরি পোশাক কারখানায়। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা ও সমস্যা সম্পর্কিত বেশকিছু  বিষয় খুব  কাছ থেকে উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছিল আমার।  আমার স্বল্প অভিজ্ঞতা থেকে শুধু এটুকু বলব যে, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও চেষ্টা থাকলে পোশাক শ্রমিকদের পূর্ণ-নিরাপত্তা এবং জীবনযাপনে একটা সন্তোষজনক মান  নিশ্চিত করেই এই শিল্পকে অনেক দূরে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। কিছু কিছু  তৈরি পোশাক কারখানা  এভাবে  এগিয়েও যাচ্ছে দিন দিন।যাই হোক, পরিবার-পরিজন নিয়ে আমি আজ যে জীবনযাপন করছি, এর পেছনে আজো এক ধরনের সম্পৃক্ততা রয়েছে  এই তৈরি পোশাক শিল্প তথা এ শিল্পে কর্মরত  শ্রমজীবী মানুষের। সুতরাং সেই দায়ভার  থেকে এই  ক্রান্তিলগ্নে  আজ কিছু লেখা।

সকালে ঘুম ভাঙলেই জানতে পাই,  সাভারের রানা-প্লাজা ধসের ঘটনা। দৈন্যদিন জীবনে আমাদের নেতিবাচক ঘটনাগুলোর সঙ্গে এখন এত বেশি  মুখোমুখি হতে হয় যে, কোনো ঘটনাই প্রাথমিকভাবে খুব একটা গুরুত্ব পায় না। সময়ের প্রবাহে ধসের তীব্রতা  প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। দু’চোখ ঝাপসা ও কণ্ঠভার হয়ে উঠে। উদ্ধারকৃত এক একটি লাশের খবর  যেন ঠিক বুকের ভেতর চাপ দিয়ে বসে। নতুন করে আজ অন্য কিছু/কাউকে দায়ী করার  আদৌ কি কোনো প্রয়োজন রয়েছে? আর দায়ী যে-ই হোক না কেন, বরাবরের মতো মর্মান্তিকভাবে নিস্পেষিত হলো তো সেই খেটে  খাওয়া শ্রমজীবী মানুষগুলোই।

নিঃস্ব হলো তো রেখে যাওয়া তাদের পরিবারগুলো। শ্রমজীবী মানুষ ওরা, ওদের ভাগ্যে এর চেয়ে বেশি আর কী থাকবে? অবশেষে এই দুর্ঘটনার যে সুরাহা  হবে তার ছকও তো আমাদের অনেকটা জানা আছে। তারপরও নিজে নিজেই সান্ত্বনা নেয়ার বৃথা চেষ্টা চলে ভিন্ন ভিন্নভাবে। পাল্লা দিয়ে ভেসে আসে রাজনৈতিক নেতাদের সেই একই ধাঁচের নিয়মিত বক্তব্য। হঠাৎ  করে আসা  দু’টি বক্তব্য আমাদের মর্মাহত করে। শুধু মর্মাহত-ই না, এক ধরনের স্তম্ভিতও করে।

দুর্ঘটনার দিন বুধবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ডেমো ট্রেন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা আগে থেকেই সচেতন ছিলাম। আমরা জানতাম বলে সব লোক সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু মূল্যবান জিনিস সরিয়ে নিতে সকালে লোকজন সেখানে গিয়েছিল। তারাই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।” প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলতে পারবেন, কী তার উদ্দেশ্য ছিল এই বক্তব্যের পেছনে। তবে বক্তব্যের  এই ভাষা থেকে বোধসম্পন্ন যেকোনো নাগরিকের কাছেই তার লক্ষ্য/ উদ্দেশ্য অনুমেয়। যা হলো- খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষগুলো সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজেদের দোষেই এই পরিণতির  শিকার  হয়েছে। সুতরাং  দায়দায়িত্ব সরকার বা অন্য কারো  নয়, নিস্পেষিত হওয়া ওই শ্রমজীবী  মানুষের ওপরই বর্তায়। আর এই যদি প্রকৃতভাবে প্রধানমন্ত্রীর ওই শ্রমজীবী মানুষগুলো যদি সত্যিকার অর্থেই নিজেদের দোষে এই পরিণতির শিকার হয়ে থাকেন, তারপরও মানবিক-রাষ্ট্রীয়  দিক বিবেচনায় একজন সরকারপ্রধান  কখনই এই ধরনের বক্তব্য প্রদান করতে পারেন না।

পাশাপাশিভাবে সরকার নাগরিকের সঙ্গে শুধু ভোট-সূত্রে বাধা। আর এ ধরনের সরকার-নাগরিক ব্যবস্থাপনা কখনোই সুস্থ-সংস্কৃতির ধারা হতে পারে না। কেননা, এই ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণ রাষ্ট্রই একসময়ে ভঙ্গুর হয়ে পরাটা  সু-নিশ্চিত।

আসা যাক শ্রমজীবী ওই মানুষগুলো আসলেই  স্বেচ্ছায় ওই মৃত্যুকোপে গিয়েছিল কি না সে প্রসঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীর  ওই  বক্তব্য  দেয়ার বেশ খানিক আগেই গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানতে পারি যে, নিরূপায় মানুষগুলোকে একরকম কৌশলগতভাবে  বাধ্য করা হয়ে ছিল কাজে যোগদানের জন্য। প্রধানমন্ত্রী কি এই ব্যাপারে অবগত নন? আর যদি সে আসলেই বিষয়টি জেনে না থাকেন, তাহলে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ে তার সুবিশাল সহকারী-উপদেষ্টা দল  পোষা-টা  কতটুকু যৌক্তিক? পাশাপাশি, ওই সহকারী-উপদেষ্টাদের  এহেন পরিস্থিতিতেও স্বপদে বহাল থাকা-টা  কতটুকু নৈতিক, প্রশ্ন জাগে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও কি বিষয়টি না জানার দায়ভার এড়াতে পারবেন? ভেবে দেখার আহ্বান রইলো।

অপর বক্তব্যটি আসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের পক্ষ থেকে। তিনি বিবিসি-কে দেয়া এক বক্তব্যে বলেন- “আমি শুনেছি, সাভার এলাকার যে স্থানে রানা প্লাজা সেটি মৌলবাদীপ্রবণ এলাকা।  তাছাড়া কিছু হরতাল সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে। ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে সেটাও একটি সাম্ভাব্য কারণ হতে পারে।” (নতুন বার্তা ডটকম, ২৫ এপ্রিল)। বক্তব্যটির প্রতিক্রিয়ায় কী বলব তা ভাবছি। একটি নয়তলা ভবনের ভার সহ্য করার মতো পিলার বা স্তম্ভের  জন্য  কিছু ব্যক্তিবিশেষের নাড়াচাড়া বা ঝাঁকুনি  নিত্তান্তই এক সামান্য ব্যাপার । আর ধসে  পরা তো অনেক দূরের ব্যাপার। ভবনটি ধসে পরার পেছনে নির্মাণকালের কারিগরি ত্রুটিই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। এই যৌক্তিক ব্যাপারটি একজন  ডক্টরেট ডিগ্রিধারী  ব্যক্তির বোধগম্য না হওয়া-টা একদিকে যেমন বিস্ময়কর আর অন্যদিকে দুর্ভাগ্যজনক। বক্তব্যটি শুধু  এই বিস্ময় আর দুর্ভাগ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার জন্যই এটা একটা বিরাট হুমকিস্বরূপ। কেননা এখানে মূল কারণ-কে পাশ কাটিয়ে অন্য পক্ষকে  জড়িয়ে  ঘটনাকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার  অথবা সন্দেহবশত অযৌক্তিক ভিন্ন-কারণ সংযোজন করে ঘটনার মূল-কারণকে লঘু করার একটা  হীন-প্রয়াস প্রকাশ পাচ্ছে। যা রাজনীতি বা এর বাইরের যেকোনো সুস্থ মানুষের কাছে কখনই কাম্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। এখানেই শেষ নয়। এহেন নীতি /মতাদর্শন-সম্পন্ন  ব্যক্তির অধীনস্থ অন্যান্য সব বিষয়গুলোর স্বচ্ছতা-কার্যকারিতাও আজ অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। নিখোঁজ ইলিয়াস আলী, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রূনি হত্যাকাণ্ড, সংখ্যালঘু নির্যাতন, প্রধান বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ও আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার- ইত্যাদি বিষয়গুলো কিভাবে চলেছে বা এখনো চলছে তা সহজেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যটি আজ শুধু আমাদের ব্যথিত-ই করেনি আন্তর্জাতিক  পরিমণ্ডলে স্বয়ং এদেশের স্বরাষ্ট্র  মন্ত্রণালয়কে এক ধরনের হেয়ও  করেছে।

অতএব সরকারপ্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য দু’টির  অনতিবিলম্বে  যথাযথভাবে প্রত্যাহার দাবি করছি। পরিচিত ক্যামেরার সামনের বিশিষ্ট মানবধিকার ব্যক্তিত্ব বা সংগঠন বা কর্মীদের কার্যত অদৃশ ভূমিকায় এক ধরনের দুঃখ-ই  প্রকাশ করছি। ক্রান্তিকালে চলমান হরতাল প্রত্যাহার-সহ উদ্ধার প্রক্রিয়া পরিদর্শনের জন্য বিরোধীদলীয় নেতা সত্যিকার অর্থেই আজ ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন। আহ্বান জানাচ্ছি খেটে-খাওয়া শ্রমজীবীদের স্বার্থ-সম্বলিত বিষয়গুলো  তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রাধান্য দেয়ার।

পরিশেষে, চলমান উদ্ধার  প্রক্রিয়ায়  সম্ভাব্য সর্বোচ্চ দ্রুততা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় সব মহলের প্রতি  আন্তরিক অনুরোধ জানাচ্ছি। উদ্ধার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল জনসাধারণের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আবেদন করছি। ভবন মালিক রানা, গার্মেন্টস মালিকরা, ভবন-মালিক রানার আশ্রয়দাতা, সাভার পৌরসভা, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, রাজউক ও বিজেএমই-বিকেএমই কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে বিবেচনায় এনে দ্রুত ও নিরেপক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিসমূহের  দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি। এমন  দুর্ঘটনাগুলো চিরতরে নির্মূলে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ আশা করছি।

ড. ইকবাল হোসেন: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
iqbalhossain.press@gmail.com(নতুন বার্তা)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়