Tuesday, July 24

নুহাশপল্লীর লিচুবাগানে চিরনিদ্রায় হুমায়ূন আহমেদ

জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার প্রিয় স্থান গাজীপুরের নুহাশপল্লীর লিচু বাগানের শীতল ছায়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। দিনভর টানাপোড়েনের পর মঙ্গলবার বেলা দুইটায় তাকে দাফন করা হয়।সূত্র জানায়, হুমায়ূন আহমেদের বর্তমান স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন ও সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের সন্তানদের ভিন্ন চাওয়ার কারণে গত সোমবার দিনব্যাপী টানাপোড়েন চলে এই নিয়ে।এর আগে নুহাশ পল্লীতে দুপুর দেড়টায় তার তৃতীয় ও শেষ নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ জানাজায় অংশ নেন। মঙ্গলবার সকাল থেকেই নুহাশ পল্লীতে জনতার ভিড় বাড়তে থাকে। শুভানুধ্যায়ী ও ভক্তসহ সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে। তার মরদেহ দুপুর পৌনে ১২টার দিকে নুহাশপল্লীতে পৌঁছলে এক শোকাতুর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।দিনভর সিদ্ধান্তহীনতার পর গতকাল সোমবার গভীর রাতে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রয়াত লেখককে নুহাশপল্লীতেই সমাহিত করা হবে। সে অনুযায়ী মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বারডেমের হিমঘর থেকে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ নিয়ে নুহাশপল্লীর দিকে রওয়ানা দেন তার স্বজনেরা।হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ পৌঁছার আগেই নুহাশপল্লীতে যান তার মেয়ে নোভা, শীলা ও নুহাশ, লেখকের ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীবসহ অন্য স্বজনেরা। এছাড়াও সেখানে যান হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন ও তার পরিবারের সদস্যরা।নুহাশপল্লীতে প্রবেশ করে মাঠ ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই হাতের বাঁ পাশে শেফালিগাছের ছায়ায় নামাজের ঘর। এর পাশেই তিনটি পুরানো লিচুগাছ নিয়ে একটি ছোট্ট বাগান। লিচুবাগানের উত্তর পাশে জামবাগান আর দক্ষিণে আমবাগান। ওই লিচুগাছের ছায়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন হুমায়ূন আহমেদ। নুহাশপল্লীর ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বুলবুল জানান, জীবদ্দশায় হুমায়ূন আহমেদ যেমন এখানে থাকতে ভালোবাসতেন, তেমনি মৃত্যুর পর এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চেয়েছিলেন তিনি। নুহাশ পল্লীর সবুজ গালিচার পাশে তিনটি পুরনো লিচু গাছ রয়েছে। যেখানে তিনি সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন। আর তার ইচ্ছায় সেখানেই লেখককে কবর দেয়া হলো।এর আগে সোমবার কয়েকদফা বৈঠকের পর গতকাল মঙ্গলবার ভোররাতে হুমায়ূনের ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, নুহাশ পল্লীতেই দাফনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাত আড়াইটার দিকে সংসদ ভবন এলাকায় স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই সিদ্ধান্ত জানান তিনি। জানা যায়, পরিবারের মধ্যে মতদ্বন্দে�র অবসানে প্রতিমন্ত্রীসহ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা কয়েক দফা দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। নানকের বাড়িতে তখন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রীর তিন সন্তান নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ ও নুহাশ হুমায়ূন; যারা নুহাশ পল্লীতে বাবার দাফনে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন।জাফর ইকবাল জানান, তার ভাইয়ের তিন সন্তান মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের পক্ষে থাকলেও কার্যত বাধ্য হয়ে নুহাশ পল্লীতে দাফনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, তার প্রথম পক্ষের সন্তানরা খুব করে চাচ্ছিল, তাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করতে। তাহলে তারা সহজে যেতে পারত। দেশের মানুষও সহজে যেতে পারত। আমাদের মা-ও এটা চাচ্ছিলেন। আমরা দিনভর শাওনকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি। বোঝাতে পারলে ভাল হত, কিন্তু বোঝাতে পারিনি।শাওনের দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে জাফর ইকবাল বলেন, তার (হুমায়ূন) সন্তানরা মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করতে চাইলেও তারা এটাও চায়নি যে তাদের বাবা বারডেমের হিমঘরে থাকুক। তারা যে কোনোভাবে তাকে মাটির নিচে ফিরিয়ে দিতে চায়। এই জন্য নুহাশ পল্লীতে কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। আর দেশের মানুষও যেন মনে না করতে পারে যে আমরা তাকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া করছি। তিনি জানান, মঙ্গলবার জোহরের নামাজের পর হুমায়ূনকে দাফন করা হবে। সকালে বারডেম থেকে লাশ নিয়ে যাওয়া হবে।সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় জাফর ইকবালের সঙ্গে ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক গোলাম কুদ্দুস, চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজ।নুহাশ পল্লীর কর্মচারী খলিলুর রহমান বলেন, নুহাশ পল্লীতে একটি লিচু তলা রয়েছে, যেখানে এক সময় বাংলো ছিল, সেখানে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছার কথা আগে একবার বলেছিলেন লেখক।এদিকে নুহাশ পল্লীতে দাফনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ায় হুমায়ূনের ধানমণ্ডির বাড়ি দখিন হাওয়ায় অবস্থানকারী শাওন সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।সূত্র জানায়, সোমবার দেশে ফেরার পর থেকেই কবরের স্থান নিয়ে পরিবারের মধ্যে মতদ্বন্দে�র কারণে হুমায়ূনের দাফন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা যায়। হুমায়ূনের সাবেক স্ত্রীর সন্তানরা বুদ্ধিজীবী কবরস্থানসহ ঢাকার কোনো স্থানে সমাহিত করার পক্ষে অবস্থান নিলেও তাতে আপত্তি জানান যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বামীর লাশ নিয়ে ফেরা শাওন। মরদেহ ঢাকায় আনার পর সোমবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের এক ফাঁকে শহীদ মিনারের পাশে পরিবারের সদস্যরা আলোচনায় বসেন। সেখানে হুমায়ূনের মা আয়েশা ফয়েজ, স্ত্রী শাওনসহ পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। কিন্তু তাতে মতৈক্য হয়নি।এরপর বিকালে মিরপুরে হুমায়ূনের ছোট ভাই আহসান হাবীবের বাড়িতে আলোচনায় বসেন পরিবারের সদস্যরা। সেখানে জাফর ইকবাল, আহসান হাবীব ছাড়াও ছিলেন নোভা ও শীলা, তাদের স্বামী এবং নুহাশ। নোভা ও শীলার আরেক বোন বিপাশা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন।সন্ধ্যার পর নোভা সাংবাদিকদের বলেন, তার বাবা বেঁচে থাকতেই বলেছেন, নুহাশ পল্লী কবরস্থান হোক- তা তিনি চান না। এই বিষয়ে ডকুমেন্ট আমাদের কাছে রয়েছে। আমরা চাই, মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান বা অন্য কোথাও কবর হোক, নুহাশ পল্লীতে নয়। আমরা চাই, এমন একটা জায়গায় কবর হোক, যেখানে সবাই যেতে পারে।যত দ্রুত সম্ভব, হুমায়ূনকে দাফনের বন্দোবস্ত করার ওপর জোর দেন সন্তানরা। নোভা বলেন, বাবাকে এই অবস্থায় দেখে আমাদের খুব খারাপ লাগছে।নোভার চাচি মুহম্মদ জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমিন হক সাংবাদিকদের বলেন, এরা হুমায়ূন আহমেদের সন্তান। কোথায় দাফন হবে, সে বিষয়ে তাদের স্ট্যান্ড (অবস্থান) আছে।তবে নোভাদের এই অবস্থান পরিবারের মিলিত সিদ্ধান্ত নয় জানিয়ে হুমায়ূনের ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, এই বিষয়ে পরিবারের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।এরপর নোভা, শীলা ও নুহাশকে নিয়ে জাফর ইকবাল রওনা হন সংসদ ভবন এলাকায় প্রতিমন্ত্রী নানকের বাড়ির পথে। আহসান হাবীব সাংবাদিকদের বলেন, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি দেখে প্রধানমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাই তিনি ডেকেছেন।আহসান হাবীবের বাড়িতে প্রয়াত লেখকের প্রথম স্ত্রীর সন্তানরা থাকলেও ছিলেন না বর্তমান স্ত্রী শাওন। দুই শিশু সন্তান নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে তিনি ছিলেন ধানমণ্ডিতে লেখকের বাড়ি �দখিন হাওয়া�য়।শাওন সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, গত ১২ তারিখ (জুলাই) সকাল ৫টায় অপারেশনে যাওয়ার আগে তিনি (হুমায়ূন) বলছিলেন- আমি জানি আমি ভালো হয়ে যাবো। তবে আমার যদি কিছু হয় আমাকে নিয়ে ওরা অনেক টানাহেঁচড়া করবে, তুমি শক্ত থেকো কুসুম। আমাকে নুহাশপল্লীতে নিয়ে যেও।এই বক্তব্যের প্রামাণ্য কোনো দলিল না থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো স্ত্রী, কোনো আ�ীয়-স্বজন অপারেশনের আগের দিন রাতে বলা কথা কি রেকর্ড করে রাখে?সূত্র জানায়, হুমায়ূন এক সময় নুহাশ পল্লীতে তাকে সমাহিত করার কথা বললেও অসুস্থতার সময় দেশে ফিরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, কবরকে কেন্দ্র করে নুহাশ পল্লীতে মাজার তৈরি হোক তা তিনি চান না। ক্যান্সারে আক্রান্ত হুমায়ূন ৬৪ বছর বয়সে গত ১৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে মারা যান। অস্ত্রোপচারের আগে গত ১২ মে নুহাশ পল্লীতে বসে সাক্ষাৎকার দেন তিনি, যার অডিও রেকর্ডও রয়েছে।তবে শাওনের দাবি, মৃত্যুর আগে তার স্বামী তাকে নুহাশ পল্লীতেই কবর দেওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথায় হুমায়ুন পরিবারের অন্য সদস্যদেরও আক্রমণ করেন শাওন। তিনি বলেন, জীবিত অবস্থায় যারা হুমায়ূন আহমেদের পাশে দাঁড়ায়নি, পারিবারিক মিটিং করেননি, তাদের অধিকার নেই এখন মিটিং করার।এদিকে গুলতেকিনের তিন সন্তান নোভা, শীলা, নুহাশকে নিয়ে জাফর ইকবাল প্রতিমন্ত্রী নানকের বাড়িতে বৈঠকে বসেন। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে সেখানে ছিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজ। এরপর রাত সাড়ে ১০টার পর দখিন হাওয়ায় যান তারা। তবে নোভা, শীলা ও নুহাশ দখিন হাওয়ায় যাননি। দখিন হাওয়ায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা শাওনের সঙ্গে বৈঠকেও কোনো মতৈক্য না হওয়ায় রাত ১২টা ৫০ মিনিটে পুনরায় প্রতিমন্ত্রীর নানকের বাড়িতে ফেরেন তিনি, জাফর ইকবালসহ সাংস্কৃতিক জোট নেতারা।তখন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সাংবাদিকদের বলেন, পরিবারের সদস্যরা মতৈক্যের কাছাকাছি এসেছেন। আমাদের ভূমিকা শেষ হয়ে গেল। এখন পরিবার সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদের মা প্রথম পক্ষের সন্তানদের মত সমর্থন করছেন বলে মুহম্মদ জাফর ইকবাল জানিয়েছেন। তবে শাওন নুহাশ পল্লীতে দাফনের বিষয়ে অনড় ছিলেন।এরপর নানকের বাড়িতে ফিরে নোভা, শীলা ও নুহাশের সঙ্গে আবার বৈঠক হয়। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর জাফর ইকবাল জানান, তার ভাইকে নুহাশ পল্লীতেই দাফন করা হচ্ছে।উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ২০ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদ আমেরিকার নিউ ইয়র্কে ম্যানহাটন বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ সময় তার পাশে ছিলেন স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, ছোটভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং বন্ধু মাজহারুল ইসলামসহ আরো স্বজনরা। মৃত্যুকালে এ তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। খবর:-ফেয়ার নিউজ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়