প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ থেকে সরকার সরে আসেনি। তিনি বলেছেন, নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হচ্ছে। আমাদের যে উদ্যোগ- তাতে ভাটা পড়েনি। গত বুধবার লন্ডনে হোটেল সেন্ট প্যানক্রসে স্থানীয় বাংলা প্রচার মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইফতারের পর তাদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন শেখ হাসিনা।বিশ্ব ব্যাংক ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত পাল্টে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করলে সেটা তারা �নিজেদের বিবেচনায়� করবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা তাদের বিবেচনা। আর এটা ভুল ধারণা, আমরা পিছু হটিনি। আমরা পিছু হটবো না।উল্লেখ্য, পদ্মা সেতুতে পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক গত ২৯ জুন ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্থগিত করে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের রূপরেখা ঘোষণা করেন। এজন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহেরও সিদ্ধান্ত হয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে।তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ২২ জুলাই সাংবাদিকদের বলেন, সরকার এ প্রকল্প বাস্তবায়নে চারটি বিকল্প নিয়ে এগোচ্ছে, যার মধ্যে প্রথমটি হলো বিশ্ব ব্যাংককে ফেরানো এবং সর্বশেষ পথ নিজস্ব অর্থায়ন।সূত্র জানায়, বিশ্ব ব্যাংককে পদ্মা প্রকল্পে ফেরাতে সরকারের চেষ্টার অংশ হিসাবে গত সোমবার মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেন সৈয়দ আবুল হোসেন, যিনি বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির সময় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। বিগত বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০৫ সালে যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, সে সময়ের মন্ত্রী কী পদত্যাগ করেছিল?এ সরকারের মেয়াদেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর প্রত্যয় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ব ব্যাংক আসুক আর না আসুক- আমরা পদ্মা সেতু করব। আমাদের নিজেদের প্রস্তুতি আছে। বিশ্ব ব্যাংক কী করে- এটা তাদের এখতিয়ার।বর্তমান মহাজোট সরকারের মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব দেওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মন্ত্রীরা প্রতি বছর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সম্পদের হিসাব দিচ্ছেন। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের ওয়েব সাইটে গেলেও তাদের সম্পদের হিসাব পাওয়া যাবে। তাছাড়া আয়কর দেওয়ার সময়ও তারা হিসাব দেন।বর্তমান সরকার বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ডের বৈধতা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, তারা বৈধতা পেলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমরা আর জয়ী হতে পারতাম না। জনগণ তাদের কর্মকাণ্ড গ্রহণ করেনি বলেই আমাদের ভোট দিয়েছে।তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করার কারণেই তাকে ২০০৭ সালে তাকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল। তখন তো কেউ টু শব্দটা করেনি। বিএনপির এক নেতার অবিবাহিত মেয়ে গ্রেপ্তরার হওয়ার প্রতিবাদ আমিই করি। বিএনপি নেত্রী তো প্রতিবাদ করেন নাই।বর্তমানে বিরোধী দলে থাকা বিএনপিরও সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা দেশের উন্নয়ন করতে এসেছি। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে আসি নাই। তারা তো এখন স্ব-নির্ধারিত নির্বাসনে চলে গেছেন। তাদের বিচার করতে লাগে নাই। আল্লাহই তাদের বিচার করেছে।কথিত গুম ও ক্রস ফায়ার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির লোকেরাই চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতা জামালউদ্দিনকে হত্যা ও গুম করেছিল। তিনি বলেন, বিএনপি চালু করে দিয়ে গেছে। এখন রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় মানবাধিকারের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রী জানান।আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি কারো নাম বলতে চাই না। যারা সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যারা যে কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সে কাজেই পতন হয়। সিলেটে কতো নেতা গুম হয়েছে? তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে কতো হত্যা ও গুমের ঘটনা ঘটেছিল- তা খুঁজে বের করার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি আহবান জানান।লন্ডনে হোটেল সেন্ট প্যানক্রসে ইফতার অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিগত বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে �হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের� ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন এবং ২০১৬ সালে লন্ডনে বাংলা প্রত্রিকা প্রকাশনার শতবর্ষ উদযাপনের জন্য প্রবাসী সাংবাদিকদের উদ্যোগ নিতে বলেন।বিদ্যুৎ উৎপাদান ও স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, তথ্য প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্যের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, গত সাড়ে তিন বছরে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি হয়েছে।এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়ায় সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রশংসা করে বলেন, তার গাটস্ আছে বলেই রিজাইন দিতে পেরেছে। দেশপ্রেম আছে বলেই রিজাইন দিয়েছে। তবে বিশ্ব ব্যাংক আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো তথ্য প্রমাণ দিতে পারেনি বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা (বিশ্ব ব্যাংক) এক মন্ত্রীর দিকে হাত তুলেছে। সে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আমার কাছে রিজাইন লেটার দিয়ে গেল। তিনি বলেন, তার গাটস্ আছে বলেই রিজাইন দিতে পেরেছে। দেশপ্রেম আছে বলেই রিজাইন দিয়েছে।সূত্র জানায়, অর্থায়ন চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্ব ব্যাংক যে চারটি শর্ত দিয়েছিল তার মধ্যে চতুর্থটি ছিল- যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই সব সরকারি ব্যক্তি অর্থাৎ আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের তদন্ত চলাকালে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে ছুটি দিতে হবে।এ নিয়ে টানাপোড়েনের পর গত ২৯ জুন ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক। এরপর গত সোমবার মন্ত্রিত্ব ছাড়েন ওই সময় যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা সৈয়দ আবুল হোসেন। মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াও ছুটিতে যান, যিনি ওই সময় সেতু বিভাগের সচিব ছিলেন।অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পরদিন আশা প্রকাশ করেন, বিশ্ব ব্যাংকের �সব শর্ত� পূরণ হওয়ায় তারা হয়তো চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে।আবুল হোসেনের পদত্যাগ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা লন্ডনে সাংবাদিকদের বলেন, সেও চায় পদ্মা সেতু হোক। আপনারা অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। আওয়ামী লীগ বলেই পারে।এ সরকারের মেয়াদেই পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরুর ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা পিছু হটছি না। আমরা ভিক্ষা নিই না। আমরা সুদসহ ঋণ নেই। বিশ্ব ব্যাংক আসুক আর না আসুক। আমরা পদ্মা সেতু করব। আমাদের নিজেদের প্রস্তুতি আছে। বিশ্ব ব্যাংক কী করে- এটা তাদের এখতিয়ার, যোগ করেন শেখ হাসিনা।সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময়ের পর প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে নৈশভোজেও অংশ নেন।অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. এম সাইদুর রহমান খান, অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ এম জিয়াউদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বুধবার লন্ডনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী।তিনি ২৭ জুলাই লন্ডনে অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকবেন। এর আগে, সেদিন বিকালেই বাকিংহাম প্যালেসে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের দেওয়া রাজকীয় সংবর্ধনায় যোগ দেবেন।এছাড়া বৃটিশ পার্লামেন্টের বিরোধীদলীয় নেতা লেবার পার্টির এড মিলিব্যান্ডের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের কথা রয়েছে।লন্ডন থেকে রোববার বিকালে দেশের উদ্দেশে রওনা হবেন প্রধানমন্ত্রী। সোমবার সকাল সাড়ে ৮টায় তার দেশে পৌঁছাবেন।এদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি বিশেষ প্যানেল গঠনে করা হবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। বুধবার দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয়ে (দুদক) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান।গোলাম রহমান বলেন, পদ্মা সেতু দুর্নীতির তদন্তে বিশেষজ্ঞ তিন জনের সমন্বয়ে একটি বিশেষ প্যানেল গঠন হবে। এই প্যানেল দুদকের সঙ্গে কাজ করবে।প্রাকযোগ্যতা নির্বাচন এবং পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতুতে প্রতিশ্র�ত ঋণচুক্তি স্থগিত করে বিশ্ব ব্যাংক। এছাড়া প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্তের জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট সচিব ও কর্মকর্তাদের অপসারণ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক তদন্তের শর্তারোপ করে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা এই সংস্থাটি।তদন্তের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাঙ্কের শর্ত ছিল অভ্যন্তরীন তদন্তের পাশাপাশি বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন এবং তদন্ত সম্পর্কিত তথ্য ওই টিমের সঙ্গে বিনিময় করা।কিন্তু সরকার বিশ্বব্যাঙ্কের পরিপূর্ণভাবে পালন করেনি অভিযোগে গত ২৯ জুন ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক। এর এক মাসের মধ্যে গত ২৩ জুলাই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন সাবেক যোগাযোগ এবং বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন।দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের পর থেকে দুদক একক ভাবে তদন্ত কাজ পরিচালনা করে এলেও বুধবার সংস্থটির চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বললেন, কমিশন তথ্য বিনিময়ে সম্মত রয়েছে। খবর:-ফেয়ার নিউজ
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়